ফিচার I নেইল পলিশ হেনা পলিশ
সুখবর! বোতলবন্দি হয়েছে মেহেদির রং। নখে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে। বাটাবাটির ঝক্কি নেই। রঙের জন্যও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার জরুরত পড়ে না। একদম জাদুকরী
ঐতিহ্যের সঙ্গে মেহেদির মিশেল বহু পুরোনো। যা কিছু শুভ, যা কিছুতে আনন্দ—সবকিছুতে এই সবুজ পাতায় লুকিয়ে থাকা লাল-কমলা রঙের উপস্থিতি। পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে আরবের মানুষ নখ ও চুলে মেহেদি ব্যবহার করতেন। না, রূপে মুগ্ধ হয়ে নয়; তারা বিশ্বাস করতেন, এই পাতার রসে আরোগ্য মেলে। ঔষধি গুণসম্পন্ন মেহেদি তাই আরবের রূপচর্চার উপাদানে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এরপরে ভারতীয় উপমহাদেশের অধ্যায়ে মেহেদিকে পাওয়া যায় বিশেষভাবে। সুপ্রসন্ন ভাগ্য, যৌনস্বাস্থ্য, সন্তানধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে—এই বিশ্বাসে উৎসবের সঙ্গে মিশে যায় মেহেদি। সেই প্রথা এখনো আছে। বিভিন্ন উপলক্ষ ঘিরে আজও আয়োজিত হয় মেহেদি উৎসব। মূলত নারীদের প্রসাধন এবং বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর ভেষজ উপকরণ হিসেবে এর পরিচিতি। তবে পুরুষেরা যে একেবারেই ব্যবহার করেন না, তা নয়। হাতভর্তি মেহেদির পাশাপাশি এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নখে এর ব্যবহার। বাণিজ্যিকভাবে ‘হেনা পলিশ’ নামেও পরিচিত।
হেনা পলিশ
প্রাকৃতিক রং এই মেহেদি। শতভাগ প্রাকৃতিক অবস্থায় ব্যবহার করা সম্ভব। শিল-পাটায় মেহেদি পাতা বেটে নিয়ে সরাসরি নখে প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে। এরপরে যত সময় গড়াবে, নখে তত গাঢ় হবে রং। লালচে কমলা একটু একটু করে হয়ে যাবে টকটকে লাল।
মেহেদির গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে হেনা কোন ব্যবহার করেও নখ রাঙিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এখন সব দোকানি জানেন এই চাহিদার কথা। তাই সহজে মেলে হাতের নাগালে।
বোতলবন্দি হেনা পলিশ এখন ইন-ট্রেন্ড। ব্রাশের সাহায্যে নখে হেনা পেস্টের প্রলেপ দিয়ে অল্প সময় অপেক্ষা করে শক্ত হয়ে যাওয়া আস্তরণটি তুলে নিলেই হবে। নখে ফুটে উঠবে মেহেদির রং। বেশ কিছু কসমেটিক লেবেল তৈরি করছে এই নেইল প্রোডাক্ট। এর মধ্যে কয়েকটি আবার অজুবান্ধব। তাই ইবাদতে বসা যাবে নেইলপলিশ হাতেই। পলিশের প্রলেপ ব্রিদেবল হওয়ায় বাতাস চলাচল সহজ হয়। মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে দৃঢ়বন্ধন থাকায় এসব গুণ গুরুত্বপূর্ণ। আর এই অনন্যতা হেনা পলিশ জনপ্রিয়তায় ভূমিকা রেখেছে।
ওপরে সবুজ, ভেতরে রক্ত লাল
গাঢ় সবুজ মেহেদি পাতা থেকে টকটকে কমলা-লাল শেড পাওয়া যায়, কিন্তু হেনার রং নিয়েও চলে নিরীক্ষা। সে কেমন? বিভিন্ন শেডে পাওয়া যাচ্ছে হেনা পলিশ। উদাহরণে বলা যায় লাল, মেরুন, ব্রাউন, ডার্ক ব্রাউন, ব্ল্যাকের কথা। কেউ যদি চিরায়ত মেহেদির রঙের বাইরে শেড চান, তা-ও বেছে নেওয়া যাবে মনমতো। আবার মেহেদিগাছের পাতার রংও ছোট ছোট কৌশলে দেওয়া যেতে পারে। ঘরে বসেই। যেমন যদি বিট রুট যোগ করা হয়, তাহলে গোলাপের লাল রং ধারণ করবে নখ। এর নাম দেওয়া হয়েছে রেড নোজ। আবার যদি মেহেদি রসে যুক্ত করা যায় এক চিমটি হলুদ, লাল বদলে হবে ওয়ার্ম সানসেট। এসব বাসাতেই সম্ভব। কালো মেহেদি এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। কালো চা ব্যবহার করে এটিও বাসায় বানিয়ে নেওয়া যাবে।
হেনা নেইল কৌশল
হেনা নেইল পারলারে তো করা যাবেই, বাসায়ও মেহেদির রঙে নখ সাজিয়ে নেওয়া সম্ভব। সহজ চারটি ধাপে।
পছন্দসই আকারে নখ ফাইল করে, ধুয়ে তারপরে অ্যাপল সিডার ভিনেগারে ভেজানো একটি তুলার সাহায্যে মুছে নিতে হবে। এতে নেইল সারফেস থেকে দূর হবে ময়লা, তেলের মতো উপাদান। এসবের পরে পানিতে ধুয়ে নিলেই ব্যস! নখ তৈরি মেহেদির রঙে রাঙাতে।
মেহেদি যদি নখের বাইরের কিউটিকল স্পর্শ করে, তাহলে সেখানেও পৌঁছে যাবে এই রং। তাই কিউটিকল রাঙাতে না চাইলে অল-পারপাস অ্যাডহেসিভ হতে পারে সমাধান। এটি ভেদ করে নখের চারপাশে রং পৌঁছাতে পারবে না। তবে অ্যাডহেসিভ নখের চারপাশে ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গেই হেনা নিয়ে বসে পড়লে বিপত্তি বাড়বে। একটু ধৈর্য ধরে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা চাই।
একটি ব্রাশের সাহায্যে নখে মেহেদির প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে। একবারেই শেষ, এমন নয়। বারবার ব্যবহার করলে ভালো। এতে থিন হেনা লেয়ার তৈরি হবে। তারপরে অপেক্ষা করতে হবে শুকিয়ে যাওয়ার জন্য। মেহেদি যেন নখে বসে থাকে, সে জন্য পাতলা কাপড়ে জড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। ‘দীর্ঘ অপেক্ষা বিরক্তিকর, কিন্তু ফল দারুণ সুন্দর’—সে কথার প্রমাণ পাওয়া যায় হেনা নেইলে। যতক্ষণ রাখা যাবে, ততই গাঢ় রঙের নিশ্চয়তা। সারা রাত রেখে দিতে পারলে তো কথাই নেই! সকালের রোদে কালচে কমলা-লাল নখ খুশির উচ্ছ্বাস বাড়াবে।
নখের মেহেদি শুকিয়ে যাওয়ার পরে একটি কটন বল লেবুর রসে ভিজিয়ে নিয়ে তার সাহায্যে নখ পরিষ্কার করে নিতে পারেন। বাসায় লেবু না থাকলে অ্যাপল সিডার ভিনেগারই সই। পরিপূর্ণভাবে পরিষ্কার করে নিয়ে সব শেষে ক্লিয়ার নেইলপলিশ ব্যবহারে কোটিং দিতে পারেন। তাতে সৌন্দর্য বাড়বে বৈ কমবে না।
হেনা ব্যবহার করে নখে নকশাও করা যেতে পারে। অর্থাৎ, হেনা নেইল আর্ট। এ জন্য মেহেদির কোন অথবা চিকন কাঠি ব্যবহার করা যায়। নকশা শুরুর আগে নেইল সারফেস পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপর মনমতো ডিজাইন এঁকে নেওয়ার পালা। ঈদে মেহেদির নকশায় ইসলামিক মোটিফ যেমন চাঁদ, তারা থাকতে পারে। এ ছাড়া ফুল, জ্যামিতিক মোটিফও বেশ লাগবে। নখজুড়ে নকশা করা যেতেই পারে। আবার চাইলে নখের অর্ধেকে হতে পারে নকশা। সঙ্গে স্টোন এমবেলিশমেন্ট করে নিলে উৎসবের মুখরতা আরও বাড়বে।
প্রকৃতির রং, প্রাকৃতিক রং
ঈদকে কেন্দ্র করে মেহেদির ব্যবহার হয় নানাভাবে। এ বছরেও এই ধারা চলমান থাকবে বলে ধারণা করছেন সৌন্দর্যবিশেষজ্ঞরা। ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার বিষয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে সচেতনতা বাড়ছে। মেহেদি প্রাকৃতিক। নখে কোনো সমস্যা তৈরি করে না। স্মাজ ফ্রি। অমসৃণ হওয়ার ভয় নেই। নখ রুক্ষ করে না। কারণ, এতে নেইলপলিশের মতো ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি নেই। বরং নখ শক্ত করে। ভঙ্গুর নখে মেহেদি ওষুধের মতো কাজ করে। অল্পতেই নখ ভেঙে যায় যাদের, তাদের নখে মেহেদির প্রলেপ দিয়ে কিছুটা সময় বসে যদি শুকিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে নখ শক্ত হবে। কারণ, মেহেদিতে কেরাটিনের উপস্থিতি আছে; যা নখের শক্তি বাড়ায়। নখকে হুট করে ভেঙে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। নখের কিউটিকল জীবাণুর সংস্পর্শে আসে। সেখান থেকে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁঁকি থাকে। নখে মেহেদি দেওয়া থাকলে এই সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর সুযোগ থাকে। ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণ এড়ানো যায়। রং একই থাকে। মলিন হয় না। রি-ইউজের তাড়াহুড়া থাকে না। দীর্ঘদিন টিকে থাকে। কারণ, মেহেদির পলিশ নখ থেকে উঠে যায় না। নখ ফাইলিং করতে করতে একসময় মেহেদি রাঙা নখ কেটে ফেলা হয়।
মেহেদি পাতা নখকে রাঙিয়ে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। একে জোর করে তুলে নেওয়া যায় না। তাই ব্যবহারের আগে বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
সারাহ্ দীনা
ছবি: মমতাজ-এর সৌজন্যে