বিশেষ ফিচার I বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন উদ্যাপনের উৎসব। জাতিসংঘ স্বীকৃত। এর পথচলা ও মর্মার্থ তুলে ধরেছেন সিলভিয়া নাজনীন
‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’
বাঙালির কণ্ঠে এভাবেই ধ্বনিত হয় তার চেতনা, চরিত্র এবং আকাঙ্ক্ষার সারাৎসার। অগণন ঝড়ঝাপটার পরেও বাঙালির মৌল প্রেরণা থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছেদ ঘটেনি। বর্ষবরণ বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এক সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। বাংলার কৃষক-বণিকসহ সব ধরনের পেশা-ধর্ম-বর্ণের মানুষ একাত্ম হওয়ার এই উৎসবে কালে কালে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। বর্ষবরণ উপলক্ষে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই নতুন মাত্রার উজ্জ্বলতম সংযোজন।
বৃহৎ বাংলার ভূমি সন্তানগণই বাঙালি, আর সংস্কৃতিমাত্রই চলমান। মানব প্রজাতির অর্জিত ব্যবহার বা অভ্যাস অথবা অনুশীলনজাত উৎকর্ষই হয় সমকালীন সংস্কৃতির রূপ। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় সমকালীনতা এবং চলনশীল বাঙালি সংস্কৃতির রূপটি বেশ সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়। আত্মবিকাশের ধারায় বাঙালির মিলন-বিরোধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে, বিকার-প্রতিকারের প্রয়াস রয়েছে, উত্থান-পতন, স্বাধীনতা ও পরাধীনতা আছে। উৎসব পার্বণ বিনোদনে বাঙালির মনোভূমি কর্ষণ করছে সযত্নে। সে এই মাটিকে ভালোবেসেছে, এ জীবনকে সত্য বলে জেনেছে। তাই সে দেহতাত্ত্বিক, তাই সে প্রাণবাদী, তাই সে যোগী ও অমরত্বের পিয়াসি। বৌদ্ধ আমলে তার সাধনা ছিল নির্বাণের নয়, বাঁচার; কেবল মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকার। মন ভোলানো ভুবনের বনে বনে, ছায়ায় ছায়ায়, জলে-ডাঙ্গায় প্রশান্ত জীবনকেই প্রাধান্য দিয়েছে বাঙালি। পাল আমলের গীতে মনে হয়, যোগে নয় ভোগেও নয়, মর্ত্যকে ভালোবেসে দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই যেন সে বাঁচতে চেয়েছে। সেন আমলের ব্রাহ্মণ্যবাদিতার প্রাবল্যে গীতা-স্মৃতি-উপনিষদের মতো সে মুখে গ্রহণ করলেও মনে মানেনি। কেননা সে ধার করে বটে, কিন্তু জীবনের অনুকূল না হলে তা অনুকরণ বা অনুসরণ করে না। ওহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের পরেও এখানে শরিয়তে ইসলাম তেমন আমল পায়নি। তখন পার্থিব জীবনের স্বস্তি ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য কল্পিত হয়েছিল পাঁচ গাজী ও পাঁচ পীর। নিবেদিত চিত্তের ভক্তি লুটেছে খানকা, অর্ঘ্য পেয়েছে দরগাহ, আর শিরনি পেয়েছে সুফিদের লোকায়ত ভাব। বাঙালি এই ঐতিহ্য আজও হারায়নি। বাঙালির শৌর্য-বীর্য হানাহানির জন্য নয়, তার প্রয়াস ও লক্ষ্য নিজের মতো করে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার। আনন্দে-আমোদে থাকার প্রবণতা, বাঙালির প্রাণের সঙ্গে মিশে যাওয়া বৈশিষ্ট্য। তাই ধর্মীয় বলয়ের বাইরে যেকোনো ঐতিহ্যবাহী পালা-পার্বণে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বর্ষবরণ সম্ভবত সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এই বর্ষবরণও সব সময়, সব কালে একই রূপে আবর্তিত নয়; বরং নতুন সময়ে নতুন চিন্তা ও মননের সুদক্ষ প্রয়োগ দেখা যায়। মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও প্রতিনিয়ত সংযোজন হচ্ছে নতুন চেতনার ভঙ্গিসমূহ।
বাঙালির শিল্পচর্চায় আকাঙ্ক্ষা আর সীমাবদ্ধতার মনোভূমিতে শিল্পীরা নতুন পথের সন্ধান খুঁজে বেড়ান। সময়ের প্রয়োজনেই শিল্পের সম্ভাবনা বিস্তৃত হয়। বাঙালির স্বকীয় জীবনধারার প্রতিটি ক্ষেত্রে শিল্পমগ্নতা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। প্রাচীনকাল থেকেই উৎসবপ্রবণ জাতি হিসেবে বাঙালির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
শিল্পচর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভূমিকা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নববর্ষ উদ্যাপন বাঙালির সুপ্ত চাহিদার দীর্ঘ অপেক্ষার প্রতিফলন। চারুকলা থেকেই বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বজনীন হয়ে উঠেছে; এই শৈল্পিক উৎসব নাগরিক জীবনে প্রাণসঞ্চার করলেও মূলত বাংলার মাটির গন্ধকে লালন করে চলেছে এবং ঐতিহ্যের পাখনায় নতুন নতুন পালক যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সালের সেই সময়টা ছিল স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের চূড়ান্ত সময়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল। এই বন্ধের নামকরণও হয়েছিল ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’, আর ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশই নিজ নিজ বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। এমন একটা সময় যশোরের শিশুদের শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চারুপীঠ’, যার সঙ্গে শিল্পী এস এম সুলতানের নাম জড়িত; সেই চারুপীঠের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা, যারা ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটেরও ছাত্রছাত্রী, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সাজসজ্জার বিভিন্ন কিছু বানিয়ে (ঘোড়া, পাখি, নকশা করা পাখা, চড়কি, মুখোশ ইত্যাদি) বৈশাখ বরণ করেছিলেন ‘বৈশাখী শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে। সালটা ছিল ১৯৮৬।
এর পরে, ১৯৮৮ সালে সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকা অঞ্চলে প্রবল বন্যা হয়। ওই সময়ে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে দেশের মানুষ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী যা করেছিল, তা অভাবনীয় কার্যক্রম। এর ব্যতিক্রম নয় চারুকলার ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রছাত্রী, শিল্পী এবং শিক্ষকদের একসঙ্গে দেশের দুঃসময়ে কাজ করার একটা নতুন নজির তৈরি হয়।
আবার ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মোৎসবকে কেন্দ্র করে জমজমাট এক আয়োজন হয়েছিল। চারুকলার ছাত্রছাত্রীরাই তাদের উদ্যোগে নানান কিছু তৈরি করেছিলেন—রাজা, রানি, মুখোশ, চড়কি, খেলনা ঘোড়াসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ। তারপর একটা শোভাযাত্রাও বের হলো। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহ করে জমজমাট একটা শোভাযাত্রা হতে পারে, সেটাও বেশ অভাবনীয় ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালে পয়লা বৈশাখ বরণ করা হলো ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে। ১৯৯০ সালে ‘এসো গাহি মঙ্গলের জয়গান’ স্লোগান সঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। আর ১৯৯৩ সালে (বাংলা ১৪০০ সন) এসে নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। উল্লেখ্য, মঙ্গল শোভাযাত্রা নামকরণের আগের বছর ১৯৯২ সাল অর্থাৎ বাংলা ১৩৯৯ সনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বর্ষবরণ উদ্যাপনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। শিল্পী ইমদাদ হোসেন এবং তার বন্ধু ওয়াহিদুল হক (‘ছায়ানট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা)—এই দুজন পরামর্শ করেই বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম করার প্রস্তাব করেন। শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী আর চারুকলার ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকেরাসহ যারা শোভাযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, সবাই আনন্দের সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটিকে স্বাগত জানান। ১৯৯৩ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে প্রথমবারের মতো নতুন বছরকে বরণ করা হয়, চারুকলায় এবং ব্যাপক আয়োজন করে উদ্যাপিত হয় এর আনুষ্ঠানিকতা। সে বছরই বাংলা বর্ষপঞ্জি নতুন শতাব্দীতে পা রাখে, চতুর্দশ শতাব্দী থেকে পঞ্চদশে।
যেকোনো অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে নতুন একটি বছর শুরুর উদ্দেশ্যেই এই অভিযাত্রা। নব্বইয়ে জাতির সংকটকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রতিবাদের ভাষায় স¤পৃক্ত হয়েছিলেন; আজ এত বছর পরে এসে নতুন প্রজন্ম খুব সহজে বুঝতে পারছে এর মর্মকথা আর উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে বেরিয়ে যে স্বদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেখানে বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অপশক্তির কালো ছায়া আমাদের আঁকড়ে রয়েছে এখনো। মঙ্গলের চেতনাকে জাতি ধারণ করে সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণের স্বপ্ন এঁকে চলেছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সব ব্যয়ভার বহন করে চারুকলা, তাদের নিজেদের অর্জিত অর্থ দিয়ে। প্রতিবছর মাসখানেক আগে থেকে এই আয়োজনের পরিকল্পনা শুরু হয়। মূলত এমএফএ শেষ পর্বের ছাত্রছাত্রীরাই এই আয়োজনের দায়িত্বে থাকেন; সঙ্গে সার্বিক তদারক আর সহায়ক হিসেবে অনুষদের ডিনের নেতৃত্বে শিক্ষকদের একটি কমিটি থাকে। চারুকলার সম্মুখভাগে ছবি আঁকা এবং নানা ধরনের সরা, কাগজের ফুল-পাখিসহ বিভিন্ন উৎসবের আমেজ তৈরি করার অনুষঙ্গ বানানো আর তা বিক্রির ব্যবস্থা থাকে। সাবেক ছাত্রছাত্রীরাসহ নতুনেরা এবং সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাই আঁকাআঁকি এবং বানানোর কাজে যুক্ত থাকেন। কাগজের নানান ধরনের মুখোশ, পাখি, সরাচিত্র, বিভিন্ন আকর্ষণীয় উপকরণ বানানো চলতে থাকে এবং বিক্রিও হতে থাকে। প্রায় মাসব্যাপী এই আয়োজনে বিক্রিলব্ধ অর্থ দিয়েই শোভাযাত্রার মূল উপাদানগুলো অর্থাৎ বড় স্ট্রাকচারসমূহ যেমন হাতি, ঘোড়া, বাঘ, পাখি, পুতুল ইত্যাদি তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এ ছাড়া চারুকলার শিল্পী-শিক্ষকেরাসহ দেশের খ্যাতিমান ও বরেণ্য শিল্পীদের নিয়ে একটা আর্টক্যা¤প হয়, যা বৈশাখ উদ্যাপন কমিটিই আয়োজন করে, সেই শিল্পকর্ম বিক্রির অর্থ এই আয়োজনের এক বৃহৎ অংশ হিসেবে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই একটি আয়োজন চলতে থাকে, আর প্রতিবছর চারুকলা নিষ্ঠার সঙ্গে এই আয়োজনকে সমৃদ্ধ করে। কোনো কোনো বছর উৎসব শেষে অতিরিক্ত অর্থ (অবশিষ্ট) থাকলে তা পরবর্তী বছরের জন্য জমা রাখা এবং একটি পুনর্মিলনীর আয়োজন করে বৈশাখ-সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
বাঙালির জন্য এমন এক উৎসব প্রয়োজন, যা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার নিজস্ব বলে মনে হবে এবং সমগ্র জাতি একাত্ম হয়ে উদ্যাপন করবে। আর সে কারণেই বাংলা নববর্ষ নির্ধারণ করা সহজ হয়েছে। এই উৎসবে শ্রেণি-বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বসিত অংশগ্রহণ উদ্দীপ্ত করে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রধান যে মোটিভ ব্যবহৃত হয়, তা স¤পূর্ণভাবেই এ দেশের লোকজ ঐতিহ্য থেকে সংগৃহীত। বাংলার আবহমানকাল থেকে কাঠ-মাটি-শোলার মাধ্যমে তৈরি বাঘ, হাতি, ঘোড়া, পাখি, প্যাঁচা, কুমির, টেপা পুতুল, গরুর গাড়ি, পালকি, নৌকা, পাখা, ঝালর—এসব মোটিভকে প্রাধান্য দিয়ে এই শোভাযাত্রায় মূল প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় প্রতিবছর। বাংলাদেশের এক অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য অঞ্চলের পরিচয় করিয়ে দেওয়ারও একটি উদ্যোগ থাকে এই মোটিভ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শিল্পী কামরুল হাসানের লোকজ শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ তাড়িত করে শিল্পীদের সব সময়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের (বিসিক) আয়োজনে বৈশাখী মেলা, লোকজ শিল্পের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বংশপরম্পরায় বাংলার লোকজ শিল্পীদের কারুকর্ম এবং দেশীয় সংস্কৃতিতে তাদের অবদানকে সম্মান জানানোর জন্যও এই মোটিভ নির্দিষ্ট করা একটি লক্ষ্য। আবার দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগসূত্র তৈরি করারও একটি আকাঙ্ক্ষা থাকে; এই নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতিতে ঢাকা চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আশাবাদী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য এই উৎসব উদ্দীপ্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয়, যা শিল্পাচার্যের স্বপ্ন এবং চারুকলার প্রধান প্রাণশক্তি। দেশের যেকোনো সংকটে এই নতুন প্রজন্ম আশাজাগানিয়া হয়ে উঠবে। এ ছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় সময়ের প্রয়োজনে দেশের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয়ভিত্তিক মোটিভও নির্মিত হয়; যা বক্তব্যসমৃদ্ধ অবস্থান তৈরি করে। এভাবেই শিল্পীদের সচেতন শৈল্পিক অবস্থানের চেষ্টা দেখা যায় এই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে। ২০০০ সালের পর ক্ষমতাধীন জোট সরকারের আমলে একবার ঢাকা চারুকলা বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছিল এই বর্ষবরণ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে। অনুষদের শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে বাইরের লোক দিয়ে এই উৎসব করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল সম্পূর্ণভাবে। এই সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল একটি চেতনা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। উদীচী, ছায়ানটের ভূমিকা, প্রো-পাকিস্তানি মনোভাব, সামরিক শাসনের দৌরাত্ম্য, ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের আক্রমণ—এদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটি প্ল্যাটফর্ম বা অবস্থান হিসেবেই আবির্ভূত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান থেকে) বিভিন্ন সময়ে শোভাযাত্রা হয়েছে; কিন্তু জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবার সম্পৃক্ততায় কোনো শোভাযাত্রা ছিল না। সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার একটি স্পষ্ট অবস্থান এবং সর্বোপরি সব দিক থেকে দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা থেকেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রা চলতে থাকে। পরবর্তীকালে এই উৎসবের ধরন একটি দৃঢ় ভিত পেয়েছে; শিল্পীদের সিদ্ধান্ত ছিল এই বর্ষবরণ উৎসব বাণিজ্যিকীকরণ না করা; স্বকীয়তা বজায় রেখে দেশব্যাপী বিস্তৃত করা।
এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন দেশীয় মেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায়, তা আবার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে উজ্জীবিত হয়েছে। লোককলা এবং শিল্পের উজ্জীবন, ঐতিহ্যের উত্থান সর্বোপরি অত্যন্ত জাঁকজমক ও নান্দনিকভাবে সম্ভবপর হয়েছে। সম্পূর্ণ শিল্প-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে যে অর্থ সংগৃহীত হয়, তা মূলত বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম, মুখোশ, সরাচিত্র আর কারুশিল্পের নানান উপাদান বিক্রয়ের মাধ্যমে। প্রতীকী হিসেবে রাজা-রানি আসে সর্বদাই; অচলায়তনের রাজা নয়, বরং রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে’—এটি সেই রাজা-রানি। আর প্যাঁচা-লক্ষ্মীর বাহন নয়; এই প্যাঁচা সত্যিই লক্ষ্মীপ্যাঁচা, যা কৃষিভিত্তিক সমাজের একটা ইতিবাচক প্রতীক। অর্থাৎ আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান—সব মিলিয়ে বাঙালি চেতনার একটা ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব। যার জন্য বাঙালি অপেক্ষা করে। আবার সব মুখোশ ট্র্যাডিশনাল না হলেও চারুকলার ছাত্রছাত্রীরাই একটা মুখোশের ভালো ট্র্যাডিশন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান চারুকলা অনুষদের নতুন সিলেবাসের কোর্স কারিকুলামে ‘জয়নুল স্টাডি’ (যা জয়নুল উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত) এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা চারুকলার সব কটি বিভাগেরই বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে শিল্প-শিক্ষার্থীদের আয়োজন আর ক্রমান্বয়ে তা জাতীয় উৎসবে পরিণত হওয়া—এই উপলব্ধি একজন শিল্পীর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকোর ‘ইনটেনজিবেল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে’র তালিকায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা সমাজের সব অশুভকে দূর করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতীক—এই বলে উল্লেখ করা হয় ইউনেসকোর স্বীকৃতিপত্রে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের মতো বিষয় উঠে এসেছে শোভাযাত্রার মূল ভাবনা হিসেবে। মানুষের মাঝে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্তর্নিহিত আহ্বান আছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার মাঝে।
চিন্তাজগতে বাঙালির বিদ্রোহের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বাস্তবে তাকে পরাস্ত করা গেছে ইতিহাসের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে; কিন্তু তার মেধা-মনন কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি। নীহাররঞ্জন রায় কথিত বেতস লতার চরিত্রটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। ঝড়ের তাণ্ডবে নুয়ে পড়া বাঙালি পরমুহূর্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। চেতনা ও ঐতিহ্যের জায়গায় তার সুস্পষ্ট অবস্থান ইতিহাস থেকে তাকে মুছে দিতে পারেনি। স্বকীয় বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে তত্ত্ব-তথ্যকে, প্রতিবেশ ও পরিস্থিতিকে নিজের জীবন-জীবিকার অনুকূল এবং উপযোগী করে তোলার সাধনাতেই বাঙালি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে। শান্তিপ্রিয়তা তার জল-ভূগোল-আবহাওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কৃষির ভিত্তিতে দাঁড়ানো বাঙালির অর্থনীতির বুনিয়াদ। কৃষকের চরিত্রটিও তাই প্রধান দিক। উৎসবে তার যত আগ্রহ, বিলিয়ে দেওয়ায় তার যত আনন্দ, আন্তরিক আপ্যায়নে তার যত প্রস্তুতি, ততটা আর কোথাও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। সারা বাংলায় এই বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে অনেক কিছু সামনে চলে আসে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় যত শিল্পীর যৌথ শ্রম (বিনা পারিশ্রমিক)—এটি বাঙালি চরিত্রের অংশ। তবে শুধু চেতনাগত দিকেই নয়, সময়ের প্রয়োজনে বাঙালি সরাসরি বিদ্রোহী হয়ে ওঠারও রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, ফকির-সন্ন্যাসীদের ফুঁসে ওঠা এবং নিজস্ব ভূখণ্ডের জন্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনের নতুন অধ্যায়।
বৈশাখী আয়োজনগুলো বাঙালির সর্বকালীন-সর্বজনীন উৎসব। যখন বাঙালি তার ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছে; মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ধর্ম, তখনই রক্তাক্ত হয়েছে এখানকার মাটি। আর এখন বাঙালি আত্মস্থ হয়েছে। তার আত্মজিজ্ঞাসা প্রখর হয়েছে, সংহতি কামনা হয়েছে প্রবল। ঔপনিবেশিক শিক্ষা তাকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি মাটির ঘ্রাণ। এই মাটি থেকেই ফুলের মতো ফুটে ওঠে শিল্পকলা আর কবিতার পঙ্ক্তি। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি জাতির আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের সীমাকে বিস্তৃত আর দীর্ঘায়িত করে।
লেখক: চিত্রশিল্পী, শিল্প শিক্ষক, গবেষক
ছবি: সংগ্রহ