skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I শ্রান্ত সন্ত

টানা ২৩ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে মানবদেহে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে সাফল্যের অবিশ্বাস্য মুহূর্তের সাক্ষী এই স্থিরচিত্র

হাসপাতালের অস্ত্রোপচারকক্ষ। শরীর ভর্তি তারের জটলা নিয়ে শুয়ে আছেন রোগী। অচেতন দেহ। ফ্রেমের মাঝখানে তাকে রেখে, পেছনে ডান কোনায় দেয়ালে হেলান দিয়ে, মেঝেতে আধশোয়া হয়ে বেঘোর ঘুমে একজন। আরেকজন বসে আছেন একদম সামনে, ফ্রেমের বাঁ দিকে। সার্জনের পোশাক পরনে। গ্লাভস পরা হাতে ধরে রেখেছেন চশমা। মুখে মাস্ক। চোখে ক্লান্তি ছাপিয়ে উৎকণ্ঠা। যেন নিজ হাতে ঘটানো অলৌকিকতার সফল মঞ্চায়নের অপেক্ষায় কোনো পরিশ্রান্ত সন্ত!
এই ছবি পোল্যান্ডে তোলা। ১৯৮৭ সালের ৫ আগস্ট। জট পাকানো তারের ফাঁক গলে তাকিয়ে থাকা সার্জনের নাম জিবিগনিউফ রেলিগা [১৯৩৮-২০০৯]। উদ্বিগ্নভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন একটি স্ক্রিনের দিকে, হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন বা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের পর রোগীর অবস্থা বোঝার জন্য। আর আধশোয়া, ঘুমন্ত লোকটি তার সেই সহকর্মীদের একজন, যারা তাকে সহযোগিতা করেছেন টানা ২৩ ঘণ্টার এক বিস্ময়কর অস্ত্রোপচারে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই অস্ত্রোপচার একটি যুগান্তকারী ঘটনা হয়ে রয়েছে। আর সফল অস্ত্রোপচার শেষে একই ফ্রেমে রোগী, মূল সার্জন ও তার এক সহকারীর এই স্থিরচিত্র হয়ে আছে এর একটি অনুপ্রেরণাদায়ী সাক্ষী।
ডা. রেলিগা ছিলেন পোল্যান্ডের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন। নিজ দেশে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের একজন অগ্রদূত। যদিও সে সময়ে এ ধরনের অস্ত্রোপচারকে এককথায় অসম্ভব হিসেবে গণ্য করা হতো, তবু তিনি একটি সুযোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সফলও হয়েছেন। রোগী তাদেয়ুশ জিৎকিয়েভিচের বয়স তখন ষাটের ঘরে। সেই রোমাঞ্চকর অস্ত্রোপচারের পর আরও ৩০ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। এটিও পোল্যান্ডের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। কেননা, এ ধরনের রোগী গড়ে বাঁচেন ১৭ বছর।
ছবিটি তুলেছেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের আমেরিকান আলোকচিত্রী জেমস এল. স্ট্যানফিল্ড [১৯৩৭-২০২৩]। তিনি ১৯৮০-এর দশকে পোল্যান্ডে চলমান জাতীয় সংকটের কারণে বিনা মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ভেঙে পড়ার ওপর কাজ করছিলেন তখন। ১৯৮৭ সালের বর্ষসেরা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০০ আলোকচিত্রের তালিকায় এই ছবিকে স্থান দিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।
জানা যায়, পোল্যান্ডের মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব ভারসাভা [ইংরেজি উচ্চারণ ‘ওয়ারশ’ হিসেবে অধিক পরিচিত] থেকে ১৯৬৩ সালে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন ডা. রেলিগা। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেন ভারসাভার নগর হাসপাতাল জপিতাল ভলস্কিতে। সেখানে অস্ত্রোপচারে বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করেন। এর মধ্যে ভাসকুলার সার্জারির প্রশিক্ষণ নিতে ১৯৭৩ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। একই বছর অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। ১৯৭৫ সালে মিশিগানের ডট্রয়েট শহরে গ্রহণ করেন কার্ডিয়াক সার্জারির প্রশিক্ষণ। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সালে ভারসাভা ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওলজিতে প্রভাষক হিসেবে পাঠ দেন। ১৯৮৪ সালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং জাব্রজে শহরের কার্ডিওসার্জিক্যাল ক্লিনিকের পরিচালকের দায়িত্ব সামলান। পোল্যান্ডে মানুষের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের একজন পথিকৃৎ হিসেবে তিনি এমন একটি টিমের নেতৃত্ব দেন, যেটি সে দেশে এ ধরনের অস্ত্রোপচার প্রথম সফলভাবে করতে পেরেছে। শুধু তা-ই নয়, মৃত মানুষের শরীর থেকে উপাদান নিয়ে আর্টিফিশিয়াল হার্ট ভাল্‌ভ সৃষ্টির সাফল্য দেখানো প্রথম সার্জনও তিনি। রাজনীতিক হিসেবেও সফল ছিলেন ডা. রেলিগা। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর [২০০৫-২০০৭] দায়িত্ব সামলেছেন। এমনকি তাকে নিয়ে ২০১৪ সালে মুক্তি পেয়েছে জীবনীভিত্তিক পোলিশ চলচ্চিত্র ‘গডস’। ২০০৯ সালের ৮ মে ৮৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন আলোচ্য ছবির আলোকচিত্রী ও রোগী।

দায় স্বীকার:
রেয়ার হিস্ট্রিক্যাল ফটোস ডট কম; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top