ফিচার I অস্থিরতার অশনি
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নাকাল গত এক দশকের বিশ্ববাজার। মূলধন খোয়ানো, কর্মসংস্থান হারানো, ক্রেতা ধরে রাখতে না পারার মতো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা খাত
দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলে সেখানে বসবাসকারীদের জীবনে নানা রকম প্রভাব পড়ে। দৈনন্দিন জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হয়। সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত মানুষ তখন প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নিরাপত্তাহীনতা দুশ্চিন্তা বাড়ায়। সুস্থির পরিবেশ ফিরে আসার সময় কবে, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। ফলাফল স্ট্রেস শপিং, পরিকল্পনাহীন ব্যয় এবং পরবর্তী আয় নিয়ে আশঙ্কাগ্রস্ততা। এতে প্রভাবিত হয় ফ্যাশন বাজার। ২০২৪ সালে যার আকার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বজুড়ে ৭৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ সরাসরি যুক্ত এই সেক্টরে।
জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে ফ্যাশন পণ্যের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। নিত্যনতুন পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। ফলাফল—ফ্যাশন বাজারও কলেবরে ব্যাপ্ত হয়েছে। কর্মসংস্থান সংকট কমেছে। একই সঙ্গে ২০১৯ সাল থেকে একের পর এক অভূতপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। করোনাকালে ফ্যাশন শিল্পসহ সবকিছুই একটি কঠিন সময় পার করেছে। দীর্ঘ দুই বছর বিশ্ব মহামারির ভয়ে আতঙ্কিত ছিল। ফ্যাশন নিয়ে চিন্তার উপায় ছিল না বললেই চলে। ২০২০ সাল পুরোটাই জুজু ঘিরে রেখেছিল মানব মন। ২০২১ এ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জনজীবনে ফিরতে শুরু করে মানুষ। বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশন নিয়ে ভাবনা আগাতে থাকে খুব ধীরে। এরপরে বিভিন্ন যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা রঙিন ফ্যাশন বাজারকে অস্থির করেছে বারবার।
আকস্মিক ক্ষতি
রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা, ভূরাজনৈতিক ইস্যুসহ যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাতেই ব্যক্তিমানুষ এবং তার কর্মজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফ্যাশন বাজারের ছোট থেকে বড়—সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রেতার অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়; যা তাদেরকে কেনাকাটায় বিমুখ করে। ফলাফল, বিক্রেতার পণ্যের আকস্মিক দরপতন। এর পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের সম্মুখীন হলে আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়ে।
গতি রোধ
প্রতিটি ব্যবসার নিজস্ব গতি রয়েছে। ফ্যাশন বাজার সাধারণত ঋতুকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন সংগ্রহ বাজারে নিয়ে আসে। আকস্মিক অস্থিরতায় ব্যবসার স্বাভাবিক গতি রোধ হয়। যার কারণে পুরো বছরের ব্যবসায়িক পরিকল্পনামাফিক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। নকশা করা থেকে শুরু করে ক্রেতার দরজা অবধি পৌঁছে দেওয়া, প্রতিটি ধাপেই অশান্ত রাষ্ট্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেশ যখন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যায়, তখন র ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহ ঝুঁকিপূর্ণ হয়। তাই নতুন পণ্য তৈরি করার আয়োজন সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। কারিগরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। উৎপাদন গতি হারায়।
ক্রেতা সংযোগে বিঘ্ন
ফ্যাশন বাজারের জন্য প্রচারণা দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ক্রেতার কাছে ব্র্যান্ড-সম্পর্কিত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ খুব দরকারি। কারণ, ক্রেতা ফ্যাশন সম্পর্কে জানতে পছন্দ করেন। দেখেশুনে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে চান। অস্থিতিশীল সময়ে ফ্যাশন পণ্যের প্রচার বাধাগ্রস্ত হয়। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের উদ্দেশ্যে দ্রুত সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন পড়ে। যার জন্য একটি শক্তিশালী টিম প্রয়োজন। ফ্যাশন বাজারের সব ব্র্যান্ডের পক্ষে আপৎকালীন টিম গঠন এবং পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তারা এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়।
ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কে দূরত্ব
সরাসরি যোগাযোগের অভাবে ক্রেতার অনুভূতি জানা যায় না। ক্রেতা সন্তুষ্টি, ক্রেতা আস্থা—সবই ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখে। নতুন পণ্য তৈরিসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ক্রেতার পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়। অস্থিতিশীল সময় ক্রেতা-বিক্রেতার দূরত্ব বাড়ে; যা পরবর্তী সময়ে বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পণ্য সংরক্ষণ
পণ্য বিক্রি অনিয়মিত হলে বিক্রেতাকে পণ্য সংরক্ষণ করার জায়গা বাড়াতে হয়। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া ঠিকঠাকভাবে এই কাজ করা কষ্টসাধ্যই বটে। যথাযথভাবে পণ্য মজুত না করা হলে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। যার জন্য বড় ব্যবসায়ীদের পক্ষে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হলেও যারা ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি ব্যবসা করে থাকেন, তাদের জন্য সহজ নয়। গোডাউন না থাকা, জায়গার অপর্যাপ্ততা অল্প পুঁজির ব্যবসাকে বড় ক্ষতির মুখোমুখি করতে পারে। এমনকি অনেকে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হন।
অনলাইনে অরাজকতা
বর্তমান সময়ে ফ্যাশন ব্যবসায় ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরযোগ্যতা অনেকাংশে বেড়েছে। মার্কেটিংয়ে যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক কিছু। ফ্যাশন বাজারে ভিডিও কনটেন্ট, লাইভ, ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে পার্টনারশিপ এখন নিয়মিত বিষয়। বহু মানুষের আয়ের মাধ্যম। এফ-কমার্স এবং ই-কমার্স ক্রেতাদের আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে ক্রমেই। এই দুই খাত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যায়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রচারণাকে নেতিবাচকভাবে দেখার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি ব্যবসায়ীকে অপদস্থ করার মতো অপরাধও সংঘটিত হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যারা ব্যবসা করেন, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে, তাদের আয়ের পথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা
বর্তমান সময়ের জনজীবনে ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা শতভাগ। অল্প সময়ের জন্য এই সেবা বিঘ্নিত হলে আধুনিক মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মতো ঘটনা হরহামেশাই, যা যোগাযোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ব্যাপকভাবে। ইন্টারনেটের গতি নিয়ন্ত্রণ, সাইবার সিকিউরিটির অভাব, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মনুষ্যসৃষ্ট বিপদ তৈরির মতো কাজ মানুষের আয় ও মানসিকতার ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অপরিকল্পিত মূল্যহ্রাস
অস্থিরতা-পরবর্তী সময়ে তুলনামূলক স্থিতিশীল পর্ব আসে। আন্দোলনের চূড়ান্ত ক্ষণের পরে বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ক্রেতা আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন অফার দেয়। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে মূল্যহ্রাস করে দেওয়ার ঘটনা ইদানীং সব চেয়ে বেশিবার ফ্যাশন বাজারে দেখা যায়। ১০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যহ্রাসের অফার মার্কেটিং টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার বাই ওয়ান গেট ওয়ান অথবা বাই টু গেট ওয়ান—এমন অফারও বাজারে বেশ জায়গা পেয়েছে। অপরিকল্পিত ছাড় দেওয়া এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ে; যা সব ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই এ ধরনের সিদ্ধান্তে সবার পক্ষে মুনাফা করা সম্ভব হয় না। আবার এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে অন্য ব্র্যান্ডের সঙ্গে ক্রেতা আকর্ষণের দৌড়েও পিছিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
মতবিরোধ
আন্দোলন এবং এর পরবর্তী সময়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। কারণ, অস্থিতিশীল পরিবেশ জনগণের বিষয়ে পরিণত হয়। মানুষ নিজের মত প্রকাশ করতে শুরু করে। সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যবসা-সম্পর্কিত যোগাযোগকে নেতিবাচক বিষয় ধরা হয়; যা ব্যবসায়ীদের সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করে। দৈনন্দিন আয়ের পথ খোলা রাখাকে আন্দোলনবিরোধী কার্যক্রম হিসেবে অনেকে ভাবতে পারেন, এই আশঙ্কায় কিছু ব্যবসায়ী তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হন; যা ফ্যাশন বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য উদ্বেগের।
ফ্যাশন বাজারের কঠিন সময় চলছে ২০১৯ সালের শেষ থেকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ করোনার পরে যুদ্ধের দামামা বারবার ছুঁয়ে গেছে এই শিল্পকে। বিভিন্ন বিষয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও এই সেক্টরে আঘাত করেছে। তবু টিকে থাকার সংকল্প আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়েছেন নিষ্ঠাবান কর্মীরা। যুদ্ধ নয়, শান্তির পরশে সুন্দর হোক ফ্যাশন বিশ্ব, সেটাই সবার কাম্য।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট