রসনাবিলাস I কাবাব কাব্য
টানা কদিন গনগনে সূর্যের গরমের পর একপশলা বৃষ্টির বিকেলে মন আই-ঢাই করছিল খানিকটা কাবাবের জন্য। তাই টিম ক্যানভাস হাজির রাজারবাগের তিন তারকা হোটেল গ্র্যান্ড সার্কেল ইন্-এর ছাদে
২০২০ সালে যখন গ্র্যান্ড সার্কেল ইন্-এর পথচলা শুরু, তখন তাদের রেস্টুরেন্ট ছিল মূলত রুফটপ। কয়েকটা ছাতা দিয়ে বসার ব্যবস্থা, ছোট্ট মেনু। পরের বছরেই সেটাকে পুরোদস্তুর রেস্টুরেন্টে রূপান্তর করা হয়, আধখানা ছাদ রেখে, যেখানে কাবাব আর নানা ধরনের জুস ও মকটেইল তৈরি হয় এখন। তাই এখন এই হোটেলের বরাতে তিনখানা আলাদা খাবারের জায়গা—দোতলায় প্রায় ২৫০ লোকের আয়োজন করার মতো ব্যাঙ্কোয়েট হল (একসঙ্গে ১৫০ জনের বসার ব্যবস্থা), সপ্তম তলায় ডাইনিংয়ে ৫০ জন আর রুফটপে প্রায় ৩৫ জনের বসার ব্যবস্থা।
রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই মসলা দেওয়া লাল চায়ের সঙ্গে স্বাগত জানালেন বিখ্যাত শেফ সজীব মোহাম্মাদ। তিনি আপাতত এই হোটেলের পুরো খাবারের ঝক্কি সামলাচ্ছেন পরামর্শদাতা হিসেবে। তার ও হোটেলের অপারেশন ম্যানেজার আবু শামস মোহাম্মাদ নাঈমের বরাতে জানা গেল ওপরের তথ্যগুলো। এখানকার ডাইনিং ফিউশন মাল্টিকুজিন—চায়নিজ, থাই, ইন্ডিয়ান, বাংলা তো বটেই, পাশাপাশি রয়েছে কন্টিনেন্টাল, আর কাবাব রয়েছে ইন্ডিয়ান থেকে পারসিক রন্ধনশৈলীর। এত বৈচিত্র্যময় খাবার তৈরির পেছনের দলটাও নিছক কম ভারী হওয়ার কথা নয়—জানা গেল রসবতীর কর্তা-ভৃত্য মিলিয়ে সংখ্যাটা ১৫।
চায়ে চুমুক দিতে দিতেই ডাইনিং হলটা দেখা হয়ে গেল। চমৎকার কালার কম্বিনেশন মেইনটেইন করা হয়েছে, সাদা মার্বেল রং আর মেহগনি কাঠের টেক্সচারের টাইলস পায়ের নিচে, দেয়ালে কাঠের রংকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, আর ওপরের ফলস সিলিংয়ে সাদার আধিপত্য। চেয়ার টেবিলেও সেই বৈপরীত্য বজায় রাখা হয়েছে। কাচের দেয়াল আর গাঢ় ক্রিম রঙের পর্দা ভেদ করে বিকেলের আলোর সঙ্গে অন্দরের কালো নকশাদার শেডের আড়ালের হলদেটে আলো চমৎকার ইন্টেরিয়রের পরিচয় দেয়। প্রতিটি টেবিলে আর বিভিন্ন কোনে সবুজের ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও সেটা কৃত্রিম। লিফট থেকে নেমে হাতের বাঁ দিকে এই ডাইনিং, আর ডান দিকে খানিকটা খোলা জায়গা। মূলত এক পাশে কাবাব, অন্য পাশে মকটেল কাউন্টার। চার-পাঁচটা টেবিল বসানো কাবাবখোর ও পানীয়ের নেশায় আসক্তদের জন্য। এখানকার গাছগুলো অবশ্য সত্যিকারের। এখানে বসে ঢাকা শহরের চমৎকার সিটিস্কেপ দেখা যায়। ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে বৃষ্টিবিলাস নামে অসাধারণ এক বসার ব্যবস্থা। মূলত বিকেলের পর ছাদের ওপরের এই অংশ খোলা হয় কাবাবখোর আর বৃষ্টিবিলাসীদের জন্য। ছাদজুড়ে ঘাস, ফার্ন, সিংগোনিয়াম, অপরাজিতা, ত্রিধারা, মধুমঞ্জরি, মাধবীলতা, ল্যান্টানাসহ নানা ধরনের ফুলগাছের রাজত্ব। ছোট্ট একটা পুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রঙের মাছ।
এসব দেখতে দেখতেই চলে এলো প্রথম প্ল্যাটার। একজনের এই প্ল্যাটারে রয়েছে টেংরি কাবাব, বারকিকিউ উইংস, হরিয়ালি কাবাব, রাইতা; এগুলোকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য গার্লিক নান, আর গলা ভেজাবার জন্য এলো স্ট্রবেরি মকটেইল। টেংরি কাবাব হলো কয়লা-পোড়া মুরগির রান; উত্তর ভারতীয় এই কাবাবের জনক বলা হয় তুর্ক ও আফগানদের। তবে এই ঝাল গোছের মসলার মিশ্রণ নিখাদ দেশি। উইংস আলাদাভাবে খাওয়ার প্রচলন হয়েছিল নিউইয়র্কের বাফেলো এলাকা থেকে, মধ্যরাতের খিদে মেটানোর জন্য। সেটারই এক ধরন বারবিকিউ উইংস। কয়লার স্মোকি আর হালকা মিষ্টি স্বাদ। আর সবুজরঙা হরিয়ালি কাবাব তো মুরগির টুকরোয় পুদিনা, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ ও নানাবিধ মসলার মিশ্রণ। এই এক প্ল্যাটারেই বাংলাদেশ থেকে ভারত-আফগান-তুর্ক এলাকা পেরিয়ে আমেরিকা দর্শন হয়ে গেল।
এরপরের প্ল্যাটারে যা এলো, সেটাও একজনের জন্য সার্ভ করা হয়—পারসিক চিকেন জুজেহ কাবাব, বিফ শিক কাবাব, ফিশ লেমন টিক্কা; সঙ্গতে ছিল জিরা রাইস (কেউ চাইলে অবশ্য এর বদলে গার্লিক নানও নিতে পারেন), গলা ভেজানোর জন্য লেমন মকটেইল আর ডিপ করার জন্য লেমন-মিন্ট সস। নরম চিকেন জুজেহ কাবাবে লেবু-জাফরানের সম্মিলিত অ্যারোমা দারুণ। বিফ শিক কাবাবও আমাদের চেনাজানা চাঙ্কি মাংসের টুকরো নয়; পারসিক কাবাবের আদলে কিমা করা, ফলে মাংস ও মসলার যুগলবন্দি জমে গিয়েছিল। লেমন-মিন্ট সসে ডিপ করে খেতে বেশ। আর দিল্লি দরবারের শাসকদের প্রিয় মাছ তাদের রীতির টিক্কা কাবাবে পরিণত হতে বেশি সময় নেয়নি। সুলতান-বাদশাহদের প্রিয় খাবারকে আমি কোন মুখেই-বা মন্দ বলি!
এরপর এসেছিল আরও একটি সিঙ্গেল প্ল্যাটার, সামুদ্রিক মাছের। দুটো কয়লা-পোড়া চিংড়ি ও একটা ম্যাকেরেল ওরফে নারকেলি, গার্ডেন স্যালাদ, পিটা ব্রেড (এখানেও রাইস নেওয়ার অপশন আছে) আর একটা মকটেইল। ম্যাকেরেলের স্বাদ এমনিতেই দুর্দান্ত, এর ওপরে আবার চার গ্রিল্ড হলে তো কথাই নেই। পিটা ব্রেডের সঙ্গে মন্দ লাগছিল না। আর একই পদ্ধতিতে করা চিংড়ির স্বাদও খোলতাই হয়েছিল। কুড়মুড়ে আস্ত খোসা ভেঙে ভেতরের গোলাপি-সাদা শরীরের চিংড়ির জন্য রেড মিটও ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে!
একাকী প্ল্যাটারের শেষ পদটা ছিল কুক্কুটময়। তবে এখানেও প্রাচ্য আর পারস্য মিলেছে। কারণ, পারসিক আদানা কাবাব আর ভারতীয় হরিয়ালি ও মালাই কাবাব এসে মিশেছে এই থালায়। সঙ্গে নান বা জিরা রাইসের যেকোনো একটা পদ, রাইতা, স্যালাদ আর মকটেইল। মোলায়েম মাংসের কিমায় মসলা বেশ ভালোভাবে মেশে আদানা কাবাবে। ফলে সেটা পরিণত হয়েছিল স্বাদের রায়টে। আর মালাই কাবাব পুরোটাই ক্রিম ও দইয়ের জাদু; ওপরটা ক্রাস্টি ও ভেতরটা দারুণ মোলায়েম। দারুণ সব কাবাবের অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন উঠি উঠি করছি, তখন দৃশ্যপটে এলো গোটা চারেক চিংড়ি, আস্ত গ্রিল্ড কোরাল আর কাঁকড়া। এই কাবাব অভিযানের একমাত্র ডাবল প্ল্যাটার। এর সঙ্গে সার্ভ করা হয় প্লেইন নান বা পিটা ব্রেড; আরও থাকে ফাত্তুশ বা গার্ডেন স্যালাদ, ধনেপাতা-পুদিনাপাতার সস ও দুটো মকটেইল। কোরালের মিষ্টি স্বাদের ফ্লেশ, সামান্য লেবুর রস চিপে মিন্ট-কোরিয়ান্ডার সসে চুবিয়ে খেতে দারুণ। সঙ্গে ছাদের বৃষ্টিবিলাসের আলো-আঁধারির অ্যাম্বিয়েন্ট দারুণ জমে গিয়েছিল। বিশেষত সিফুড প্ল্যাটারগুলো এত সাশ্রয়ী দামে অন্য কোনো তিন তারকা মানের হোটেলে পাওয়া দুষ্কর। আর যদি সেখানে থাকে আন্তর্জাতিক মানের শেফের ছোঁয়া, তাহলে তো কথাই নেই।
এই রেস্টুরেন্টে আরও নানা স্বাদের খাবার আছে, বিশেষত খিচুড়ি আর বিফ দুর্দান্ত। চায়নিজ কন্টিনেন্টালও দারুণ। উইকএন্ডের রাতে ডাইনিংয়ে রয়েছে বুফে খাবারের ব্যবস্থা। তবে এত আছের মাঝেও দৃষ্টিকটু দুটো জিনিস—আলা কার্তে মেনুতে ডেজার্ট আইটেম প্রায় শূন্য, আর ভালো বা বিন কফির অভাব। তা ছাড়া কেবল কাবাব, কন্টিনেন্টাল, চৈনিক ও থাই বা সকালের নাশতার জন্যও এই হোটেলের রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারা যায় অনায়াসে।
যোগাযোগ: ৮৭৩, আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগ, ঢাকা। ফোন: ৪৮৩১৭৭৯১, ৫৮৩১২৫০২। ওয়েবসাইট: grandcircleinn.com.bd।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক