এডিটর’স কলাম I বিয়ের বয়স
প্রতিটি বয়সই নিজ সময়ের মতো করে সুন্দর। যেকোনো বয়সে, যেকোনো সময়ে, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার সক্ষমতা রয়েছে বলেই মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বেশি সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাশীল
‘সময় গেলে সাধন হবে না…’ বলে গেছেন লালন সাঁই। এই অমর বাণী মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে দর্শনমুখর বার্তা হয়ে নিগূঢ়ভাবে মিলে যায়। সবাই একে ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারে, তা নয়। কেউ কেউ একেবারে আক্ষরিক অর্থে ধরে নেয়, এমনকি বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বেলায়ও। তাই তো সমাজে বিয়ের সঠিক সময়, অর্থাৎ উপযুক্ত বয়স ঘিরে রয়েছে একধরনের চলতি ধারণা। সাধারণত যৌবনকালকেই এর উপযুক্ত সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যথায় দেখা হয় বাঁকা চোখে। অপরিণত বয়সে বিয়ে কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়, জানা কথা; রীতিমতো বিপজ্জনকও বটে। আবার অশীতিপর বয়সে বিয়ের সঠিক সুফল লাভ দুর্লভ, এমনটা আন্দাজ করাও সহজ। তবু বিয়েকে কি আক্ষরিক অর্থেই কোনো নির্দিষ্ট বয়সকালের গণ্ডিতে আটকে দেওয়া ঠিক, বিশেষত যখন সেটি দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এক সুতোয় বাঁধার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনা?
দুই
বাল্যবিবাহ যে রীতিমতো অভিশাপ, তা যেকোনো স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারে। দূর অতীত থেকে বহুকাল অবধি আমাদের সমাজে এই অভিশাপের স্রোত প্রবাহিত হয়েছে। সেই রেশ পুরোদস্তুর কাটেনি এখনো। তা থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে প্রবর্তন করা হয়েছে নানা বিধান। আপাতদৃষ্টে বৃহৎ মানবকল্যাণের জন্যই। বাংলাদেশের আইন অনুসারে, বিয়ের ক্ষেত্রে কনের ন্যূনতম ১৮ এবং বরের ন্যূনতম ২১ বছর বয়স হওয়া চাই। অন্যথায় এমন বিয়েতে সংশ্লিষ্টরা সাজার মুখোমুখি হবে। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭’-এ বাল্যবিবাহের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ‘প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে তিনি অনধিক ১ মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তিযোগ্য হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৮-এর অধীন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা দণ্ড প্রদান করা হইলে উক্তরূপ অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষকে শাস্তি প্রদান করা যাইবে না। উপ-ধারা (২)-এর অধীন বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে শিশু আইন, ২০১৩ (২০১৩ সালের ২৪ নং আইন)-এর বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে।’ সংশ্লিষ্টদের প্রসঙ্গে আইনে রয়েছে, ‘পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হইয়া বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করিবার ক্ষেত্রে কোনো কাজ করিলে অথবা করিবার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করিলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহটি বন্ধ করিতে ব্যর্থ হইলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ বৎসর ও অন্যূন ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ এবং ‘কোনো ব্যক্তি বাল্যবিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ বৎসর ও অন্যূন ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ তার মানে, আইন নির্ধারিত এই বয়সের গণ্ডি পেরোনো যে কেউ অধিকার রাখেন বিয়ে করার।
তিন
মানবজীবনের বাঁকে বাঁকে ছড়ানো থাকে ট্র্যাজেডির ছায়া। কেউ প্রত্যাশা না করলেও সেই ছায়া কখনো কখনো ঢেকে দিতে পারে গোটা জীবন। স্বপ্ন নিয়ে সুখের আশায় গড়ে তোলা দাম্পত্যজীবনে আসতে পারে অপার বেদনা। তবু মানুষ ঘর বাঁধে। সম্ভব হলে উঠে দাঁড়ায় ভাঙন পেরিয়ে। চারপাশে চোখ রাখলেই দেখা যায়, ধুঁকতে থাকা কোনো যুগল একসময় আচমকাই ছড়িয়ে দিয়েছে আভা, যেমন শীতের শেষে নবীন পাতা মেলে দেয় পুরোনো বৃক্ষ। জীবন এমনই! আর বিয়ে বা দাম্পত্য সম্পর্কটি শেষ পর্যন্ত দুজন মানুষের একান্তই। ফরাসি সাহিত্যিক অঁদ্রে মরোয়া বলে গেছেন, ‘সুখী দাম্পত্য হলো এমন এক দীর্ঘ কথোপকথন, যেটি সব সময় দেখতে খুবই ছোট আলাপ বলে মনে হয়।’ যেমনটা সব সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের বলতে শোনা যায়, সুখের দিন যেন কেটে যায় এক পলকেই। ভবিষ্যৎ যা-ই হোক, এমন সুখের স্বপ্ন নিয়ে দাম্পত্য গড়ার নেপথ্যে যে দুটি মানুষ, এটি শেষ পর্যন্ত তাদেরই একসঙ্গে চলার জীবন; তাই তাদেরই সিদ্ধান্ত হওয়া শ্রেয়। অথচ ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র ছায়া যেন কাটেই না! এই তুমুল আধুনিক সময়ে এসেও, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে হরদমই দেখা যায় নানা যুগলের বয়স নিয়ে নোংরা রসিকতার জাল বিস্তার; যা কাম্য নয় মোটেই।
চার
শুধু বিয়ে নয়, যেকোনো কর্ম ও উদ্যোগের জন্যই তারুণ্য ও যৌবনকাল শ্রেষ্ঠ সময়, এ কথা বলা বাহুল্য। কেননা, একজন সুস্থ-স্বাভাবিক ব্যক্তিমানুষ সকল দিক থেকে সে সময়ে সবচেয়ে কর্মঠ ও সক্ষম থাকে। তাই বলে কথিত বয়সের সীমারেখায় যৌবনকে আটকে দেওয়াও ঠিক নয়। কারণ, এর পরিমাপ শুধু আক্ষরিক অর্থে শরীরের বয়স গুনেই নির্ধারণ করা অনুচিত; এর সঙ্গে ব্যক্তিমানুষটির মনও জড়িত। তা ছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঝুলিও বাড়ে মানুষের; বাড়ে অন্তর্নিহিত তেজের সম্ভাবনা। তাই আপাতদৃষ্টে উদ্ভট ও বেমানান যদি মনে হয় কোনো যুগলকে, যদি যৌবন পেরোনো কোনো বয়স্ক মানুষকে—হোক নারী কিংবা পুরুষ—প্রথমবার কিংবা নতুন করে সংসার পাততে দেখা যায়, তাকে বা তাদের দাম্পত্যকে নিয়ে পরিহাস করার অধিকার কারও নেই। এ তাদের একান্তই জীবন ঘিরে নিজেদের সিদ্ধান্ত; জীবনেও বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত যেমন একইভাবে রয়েছে। তাই বয়সের চলতি ধারণাভিত্তিক গণ্ডিতে বিয়েকে আটকে দেওয়ার মানসিকতা থেকে রেহাই ঘটা চাই আমাদের।
পাঁচ
বিজ্ঞজনেরা বলেন, প্রতিটি বয়সই নিজ সময়ের মতো করে সুন্দর। যেকোনো বয়সে, যেকোনো সময়ে, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার সক্ষমতা রয়েছে বলেই মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বেশি সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাশীল।
সবার বোধোদয় হোক। জীবন হোক মঙ্গলময়।