বিশেষ ফিচার I মধ্যপ্রাচ্যে মেইড ইন বাংলাদেশ
গেল বছর এই ইন্ডাস্ট্রি পেরিয়েছে ২৯৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা। ২০২৫ এর টার্গেট বিশ্বব্যাপী ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের বাজার দখল। এর পেছনে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর ভূমিকা কতখানি? জানার চেষ্টা জাহেরা শিরীনের
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার সমন্বিত মধ্যপ্রাচ্যে মূলত হিজাব, আবায়া আর টিউনিকের মতো পণ্যগুলো মডেস্ট মার্কেটের সম্প্রসারণে নেতৃত্ব দেয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের মডেস্ট অ্যাপারেল রপ্তানি করে মধ্যপ্রাচ্যে; যা ২০২৩ এর তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বাড়তি। সুখবরই বটে।
মার্কেট মাইগ্রেশন
বিশ্বব্যাপী মডেস্ট মার্কেটের সাবস্টেনশিয়াল আয় ৩১১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই ইন্ডাস্ট্রির সম্মিলিত বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। প্রধানতম কারণ, বাড়তি চাহিদা। মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়া ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যেও যা পৌঁছে গেছে। সম্প্রতি দুবাই চেম্বার অব কমার্সের একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। সে মোতাবেক ৭৮ শতাংশ মিডল ইস্টার্ন ভোক্তা সুতি, লিনেন এবং ব্যাম্বুর মতো পরিবেশবান্ধব পণ্যে বেশি আগ্রহী; যা সেখানকার উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য মানানসই। এই অঞ্চলগুলোর আমদানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় কাস্টমাইজড প্রোডাক্টের ক্রমবর্ধমান চাহিদা চোখে পড়ার মতো। মূলত তরুণ ভোক্তাদের ফ্যাশনে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে আরও আধুনিকভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা বৃদ্ধির ফল এটি।
দুবাই বেসড মডেস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ডিজাইনারদের মধ্যে বাংলাদেশের টেক্সটাইল নিয়ে বাড়তি আগ্রহ দেখা গেছে গেল কয়েক বছর। তুলনামূলক সস্তা এবং কাজ করা সহজ বলে। হাল ফ্যাশনের সঙ্গেও সুন্দর মানিয়ে যায়, ট্র্যাডিশন এবং ফ্যাশনের সঠিক সংমিশ্রণের মাধ্যমে।
মধ্যপ্রাচ্যে মূল চাহিদা
এই অঞ্চলের ভোক্তারা সাধারণত এমন পোশাক খোঁজেন, যেগুলোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মূল্যবোধ; যেমন শালীনতাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। তবে ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এতটুকু আপোস না করে। এ ছাড়া প্রাধান্য পায় আরও কয়েকটি বিষয়:
মান ও দীর্ঘস্থায়িত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় পোশাকের ক্ষেত্রে। মধ্যপ্রাচ্যের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য। এ জন্য ম্যাটেরিয়ালের দৃঢ়ভাবে পাশাপাশি সেলাইয়ে এবং ব্যবহৃত উপাদানের গুণমানের ওপরও প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ইনক্লুসিভ ফ্যাশনে ঝোঁক বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সাইজের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি প্লাস সাইজ মডেস্ট ওয়্যার যোগ করা ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল গ্রুপের সিইও রহমান আলমের ভাষ্য, ‘বহু বছর ধরেই পাশ্চাত্যের বাজারে বাংলাদেশ পণ্য সরবরাহ করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য এ ক্ষেত্রে নতুন দিক উন্মোচন করে দেবে। আমরা জানি, মডেস্ট ফ্যাশন মার্কেটে ক্রেতা চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটু কৌশলী হতে হয়, থাকতে হয় ফ্লেক্সিবল। আগামী বছরগুলোতে এগুলোকে প্রাধান্য দিয়েই কাজ চলবে।’
মধ্যপ্রাচ্যের মার্কেটে বাংলাদেশ
চাহিদার ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের এমন শক্তিশালী সরবরাহকারী হয়ে ওঠার পেছনে বেশ কিছু বিষয় ভূমিকা পালন করেছে।
দক্ষ সাপ্লাই চেইন এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ গেল কয়েক বছরে এ খাতে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তারই প্রভাব রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে; বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সাপ্লাই চেইনের উন্নয়ন সাধন, যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ রপ্তানি বাণিজ্য হয়। রিয়েল টাইম ট্র্যাকিং, অটোমেশনের মতো উন্নত প্রযুুক্তির যোগ মধ্যপ্রাচ্যে চালান পাঠানোর কাজকে দ্রুততম সময়ে সারতে সহায়তা করছে। সাধারণত ১৫-২০ দিনের মধ্যেই পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যস্থলে।
বাংলাদেশের এয়ার ফ্রেইট ক্যাপাসিটির উন্নয়ন। একটি নতুন শিপিং প্রক্রিয়া অনুযায়ী দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা মোট পণ্যের ২০ শতাংশের বেশি আকাশপথে পৌঁছানো হয়। উচ্চমানের পণ্যের দ্রুত ডেলিভারি নিশ্চিত করার জন্য এ পন্থাই বেছে নেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি।
সাপ্লাই চেইনের স্বচ্ছতা নিয়ে দারুণ সচেতন এখনকার বাংলাদেশি সাপ্লাইয়াররা। মডেস্ট ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা প্রায় ৬০ শতাংশ ফ্যাক্টরি; যারা মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য সরবরাহ করে থাকে, তারা এরই মধ্যে ডিজিটাল ট্র্যাকিং টেকনোলজি আয়ত্ত করে নিয়েছে।
দুবাই ও রিয়াদের মতো শহরগুলোতে বাংলাদেশি ফ্যাক্টরিগুলোর সম্ভাব্য বণ্টন কেন্দ্রের স্থাপন করার উদ্যোগ শুরু হতে যাচ্ছে। এতে করে স্বল্প সময়ে ভোক্তা অব্দি পণ্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে, খরচটাও কমে আসবে অনেকখানি।
ই-কমার্স এবং সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্টের জন্য নিত্যনতুন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে ব্র্যান্ড এবং কোম্পানিগুলো। ক্রমবর্ধমান অনলাইন ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যবহারকারীবান্ধব ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল অ্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে কমিউনিটি এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কাজও শুরু হয়েছে। ইনফ্লুয়েন্সারদের সাহায্যে আরও বেশি ভোক্তার কাছে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরির সুযোগ নিয়েও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে ব্র্যান্ডগুলো।
উপসংহার
এরই মধ্যে বেশ কিছু বাংলাদেশি ব্র্যান্ড মধ্যপ্রাচ্যের মডেস্ট অ্যাটায়ারের বাজারে ঢুকে যেতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এখনো সেগুলো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এ ছাড়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ দেওয়া এমন অনেক পোশাক তৈরি হচ্ছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে পৌঁছে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কেটে। নানান বিদেশি এবং খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের মাধ্যমে। এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ সরকার। মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্য মেলা ছাড়াও নানা ধরনের টেক্সটাইল-সংশ্লিষ্ট মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলো তাদের পরিচিতি বাড়াতে পারে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য মডেস্ট মার্কেটে নতুন দুয়াল খুলে দিতে পারে।
এ ছাড়া প্রতিযোগিতার ব্যাপারটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতাদের আকর্ষণের জন্য এথিক্যাল ও সাসটেইনেবল প্রোডাকশন এবং ফ্যাক্টরিগুলোর উন্নয়ন প্রয়োজন। GOTS এবং OEKO-TEX স্ট্যান্ডার্ড 100 এর মতো আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনে গুরুত্ব দিতে হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষ স্থান পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যপ্রাচ্যের মার্কেটের নানা ধরনের সুযোগ নিয়ে নিরীক্ষা শুরু করেছে। ফলও মিলছে ইতিবাচক। অংশীদারি আরও জোরদার করে বাংলাদেশ একদিন মধ্যপ্রাচ্যে মডেস্ট ওয়্যারের কাঙ্ক্ষিত সরবরাহকারী হয়ে উঠতে পারবে বলে আশাবাদী এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। আগামী পাঁচ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের মডেস্ট ফ্যাশনের বাজারে বাংলাদেশের শেয়ার ১০-১২ শতাংশ অব্দি উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। সে অঞ্চলের ব্র্যান্ড এবং কোম্পানিগুলো ছাড়াও স্থানীয় বিতরণ ও সরবরাহ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন কোলাবোরেশনের মাধ্যমে।
ছবি: ইন্টারনেট