মনোজাল I কামিজ বনাম কুর্তা
দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের পোশাক হিসেবে সমাদৃত কামিজ আর কুর্তা। ক্রেতাপ্রিয়তার গহিনে আছে দর্শন আর জীবনযাপনের ইতিকথা
দুটোই ফ্যাশন-সচেতন নারীদের পোশাক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। গাঠনিক নকশা একই রকম মনে হলেও আদতে আছে পার্থক্য। কামিজ দেহের গঠন অনুযায়ী তৈরি আর কুর্তার প্যাটার্ন সরল। দেখতে মোটামুটি একই রকম। পার্থক্য খুবই সামান্য। কিন্তু এই সামান্যেই লুকিয়ে আছে অসামান্য মানব মনের হিসাব-নিকাশ। সালোয়ার, কামিজ আর ওড়না—তিনটি পিস মিলে একটি সেট। আর কুর্তা একদমই একলা। এর সঙ্গে যা কিছু যুক্ত করার—সবটাই নিজের মতো। আবার এই দুই পোশাকই যে শুধু মেয়েদের, তা কিন্তু নয়। কামিজ সম্পূর্ণভাবে নারী পোশাক, আর কুর্তা ইউনিসেক্স। অর্থাৎ, লৈঙ্গিক সীমারেখাবিহীন। যদিও উপমহাদেশে কুর্তাকে কুর্তি নাম দিয়ে লৈঙ্গিক পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা চলছে; তবে তা খুব একটা জনগ্রাহী হয়নি। কুর্তা নামেই বিক্রি করছে বহু প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড।
গবেষক লিন্ডকুয়েস্ট জে ডি এবং ক্রিশ্চিয়ান ও’ব্রায়েনের গবেষণা করা ফ্যাশন অ্যান্ড দ্য সাইকোলজি অব ড্রেস থেকে মন আর ফ্যাশনের সংযোগ বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। জানা যায়, কেউ যখন নিজের জন্য পোশাক কিনতে যান, তখন তিনি শুধু সৌন্দর্য দেখে কেনার সিদ্ধান্ত নেন না; চিন্তা-চেতনাও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। আবার সেখানে যাপিত জীবনের দর্শনও ভূমিকা রাখে। কুর্তা আর কামিজও এই হিসাবের বাইরে নয়। কামিজের ক্রেতা কুর্তা কেনেন না, কিংবা কুর্তার ক্রেতা কামিজে আগ্রহী হন না—বিষয়টি শতভাগ এমন নয়। তবে যেকোনো একদিকেই পাল্লা ভারী হয় বেশির ভাগ ক্রেতার।
কুর্তি ও কামিজ মডেস্ট ওয়্যারের অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের চিরায়ত পোশাক হিসেবে কামিজ সমাদৃত। সঙ্গতে থাকে সালোয়ার আর ওড়না। সরল নকশার কামিজসহ নান্দনিক নকশায়ও তা তৈরি করা যায়। ফরমাল ড্রেস হিসেবে ক্যাটাগরাইজড করা যায় কামিজকে। আর কুর্তি হচ্ছে কামিজের ক্যাজুয়াল ভার্সন। ইনফরমাল গ্রুপের। আরবান ফ্যাশনে চাহিদা বেশি। পেয়ার আপে জিনস, পালাজো কিংবা ট্রাউজার পরা হয়। ওড়না কিংবা স্কার্ফের ব্যবহার হয় ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী।
যারা ব্যক্তিগতভাবে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে বেশি আগ্রহী, তাদের মাঝে কামিজের প্রতি আকর্ষণ বেশি। আবার যারা নিজের মতো করে জীবন সাজাতে চান, তাদের রয়েছে কুর্তা কেনার আগ্রহ। সালোয়ার-কামিজ-ওড়না মিলিয়ে একটি স্যুট তৈরি হয়। ব্যাপকভাবে যা থ্রিপিস নামে পরিচিতি পেয়েছে। অফিস ওয়্যার হিসেবে এটি বেছে নিলে কর্মপরিবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ তারা ছকবাঁধা কাজের পরিবেশ বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করেন। কুর্তায় নিজেদের সাজান যারা, তাদের অফিস এনভায়রনমেন্ট তুলনামূলক ফ্লেক্সিবল। পোশাকের বিষয়ে বিধিনিষেধ সে রকম থাকে না। ম্যাচ অ্যান্ড মিক্সে তাদের আগ্রহ। নিজেকে আনকোরা রূপে প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ।
উৎসবের দিন, বিয়েবাড়ি, দাওয়াতেও অনেককে দেখা যায় সালোয়ার-কামিজে। নান্দনিকতা আর আরামদায়কতার সন্ধিতে তৈরি হয় এসব। ফ্যাব্রিক, অলংকরণ, প্যাটার্ন—সবেতেই সম্ভব। উৎসবে যেহেতু আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সে সময় নিজেকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মানুষ আলাদা গুরুত্ব দেয়। সামাজিক সম্পর্ক যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের মাঝে সালোয়ার স্যুট বেছে নেওয়ার প্রবণতা বেশি। আবার যারা সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চান, তারা সালোয়ার-কামিজ বেশি বেছে নেন। কারণ, সমাজে মেয়েদের মাঝে যারা তুলনামূলক বেশি বয়সী, তাদের বড় অংশ এখনো সালোয়ার স্যুটের ক্রেতা। আর ফ্যাশন বেশ খানিকটা প্রভাবিত হয় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাধ্যমে। কুর্তার ক্রেতাদের বয়স কামিজের নিয়মিত ক্রেতাদের তুলনায় কম। স্টুডেন্ট, ওয়ার্কিং প্রফেশনালদের মাঝে কুর্তা কেনার আগ্রহ বেশি।
উৎসবের পোশাক হিসেবে কুর্তার চেয়ে কামিজের চাহিদা বেশি। কিন্তু কুর্তা পরে যে উৎসবে যাওয়া যাবে না, তা নয়। তবে কামিজের তুলনায় কম মানুষ কুর্তা বেছে নেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তারা কুর্তার সঙ্গত নির্বাচন করেন। হয়ে ওঠেন আনকোরা। সামাজিক স্বীকৃতির চেয়ে নিজেকে নিজের মতো তৈরিতে গুরুত্ব দেন।
সারাহ্ দীনা
মডেল: আনসা, সারিকা, প্রমা ও ইলা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কে ক্র্যাফট
ছবি: সালেক বিন তাহের