টেকসহি I আপসাইক্লিং আপগ্রেড
স্মৃতির গন্ধে সিক্ত একেকটি পুরোনো শাড়ি যেন যক্ষের ধনের চেয়ে কম নয়। দিনের পর দিন আগলে রাখতে অসুবিধা? বেশ বদলে হোক নতুনের সূচনা
আলমারিতে রাখা পুরোনো দামি শাড়িগুলো পোশাকের পেছনে পড়েই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে পরার জন্য নতুন কিছুর খোঁজ পড়েছে? কিংবা নতুন পোশাকের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কেনার জন্য টাকা খরচ করতে ইচ্ছে করছে না? উত্তরগুলো ‘হ্যাঁ’ হলে এসব সমস্যার চমৎকার সমাধান রয়েছে। আপসাইক্লিং। যা সবচেয়ে সুবিধাজনক, অর্থ সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান। কোনো বস্তুর ব্যবহার উপযোগিতা, মূল্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তার পুনর্ব্যবহারই আপসাইক্লিং। যেখানে একটি বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে বদলে একটি নতুন উপাদান তৈরি করা হয়; যা পরিবেশের জন্য খুব টেকসই এবং এটি ল্যান্ডফিলে বর্জ্য জমার হার কমায়। পাশাপাশি পণ্যের তাৎপর্য ও প্রাচীনত্ব সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো পণ্যের গুণমান বাড়ায়।
কল্পনাশক্তির সঠিক প্রয়োগে প্রায় যেকোনো জিনিসই আপসাইকেল করা সম্ভব। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, ক্যান, পিচবোর্ড এমনকি পুরোনো আসবাবও। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আপসাইকেল করার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয়, ফলপ্রসূ ও সহজ পণ্যগুলোর একটি হলো পোশাক। শাড়ির চেয়ে মূল্যবান, বিলাসবহুল এবং অবহেলায় পড়ে থাকা পোশাক আর কী হতে পারে! মায়ের কাছ থেকে নেওয়া সেই পুরোনো কাঞ্জিভরম সিল্ক শাড়ি অথবা অনেক আগে কেনা সুন্দর পিঙ্ক বেনারসির কথাই ধরা যাক। আসলে অনেকের এমন শাড়ি আছে, যা খুব পছন্দের হলেও পরার সুযোগ মেলে না। সেগুলোকেই যদি লেহেঙ্গা, স্টাইলিশ ড্রেস কিংবা সালোয়ার-কামিজ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ মেলে, তাহলে পুরোনো শাড়িগুলো আরও ঘন ঘন ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তা ছাড়া সাশ্রয় হয় অর্থ। প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য একটি নতুন পোশাক কেনা যুক্তিসংগত কিছু নয়। তাই যখন নতুন পোশাকের প্রয়োজন হয় কিন্তু নগদ টাকার অভাব থাকে, তখন কী করা যাবে?
পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি আপসাইক্লিং টেক্সটাইল শিল্পকে অতিরিক্ত কাপড়ের ব্যবহার কমাতেও ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। কেবল সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে, আলমারিতে পড়ে থাকা পুরোনো শাড়ি দ্রুত একটি স্বতন্ত্র এবং সমসাময়িক পোশাকে পরিণত হতে পারে। ব্যাপারটা তো রীতিমতো ম্যাজিক্যাল। তাই না? তবে পুনর্ব্যবহার করার রহস্য হলো এমন স্টাইল নির্বাচন করা, যাতে সহজে নিজের জন্য একটি ফ্যাশনেবল লুক তৈরি করা যায়। শুরু করার জন্য দরকার কেবল একটু ধৈর্য আর সৃজনশীলতা।
নতুন শাড়িতে রূপান্তর
ছিঁড়ে যাওয়া আঁচল কিংবা সামান্য ছিঁড়ে যাওয়া বর্ডারের জন্য পছন্দের শাড়িটি ফেলে দেবেন? কোনো মানে হয় না। ভিনটেজ সিল্ক এবং বেনারসি শাড়ির বর্ডার সাধারণত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাড়িতে নিজেই বা দর্জির সাহায্যে কেবল জীর্ণ বর্ডারটিকে জরি, সিকুইন বা কুন্দনের কাজের তৈরি প্যাচওয়ার্ক বর্ডার দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। অথবা শাড়ির বর্ডারে কিছু পম পম, মুক্তার লেইস, ট্যাসেল বা মিরর ওয়ার্ক যোগ করলেও দারুণ দেখাবে।
সালোয়ার-কামিজ
সবচেয়ে সহজ উপায়গুলোর একটি হলো পুরোনো শাড়িকে একটি বেসিক সালোয়ার-কামিজে রূপান্তর করা। ভিনটেজ শাড়িগুলোকে খুব সহজে চমৎকার সালোয়ার স্যুটে রূপান্তর করা সম্ভব। কামিজের জন্য শাড়ির মাঝখানের জমিন ব্যবহার করা যাবে। এমনকি যদি বর্ডারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতেও সমস্যা নেই। হাতা, নেকলাইন এবং হেমলাইনের জন্য ভিন্ন নকশার প্যাচওয়ার্ক বর্ডার যোগ করে নেওয়া যায়। সালোয়ার ও ওড়নার জন্য আরেকটি পুরোনো শাড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে, অথবা এ শাড়িরই বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে মিক্স-ম্যাচ করে নিলেও চলবে।
কুর্তা/কুর্তি
যদি পুরোনো শাড়ি থেকে পুরো সালোয়ার-কামিজ সেলাই করার মতো পর্যাপ্ত উপকরণ অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে কেবল একটি কুর্তা/কুর্তি তৈরি করে নেওয়াই যায়। জিনস, প্লেইন লেগিংস, প্যান্ট অথবা ম্যাচিং পালাজোর সঙ্গে পরে নেওয়ার জন্য। দারুণ দেখাবে।
সেলাই করা লেহেঙ্গা
পুরোনো সিল্ক শাড়ি থেকে লেহেঙ্গা তৈরি একটি দুর্দান্ত বিকল্প হতে পারে। পছন্দসই স্টাইল ও প্যাটার্ন অনুসারে লেহেঙ্গা ও ব্লাউজ সেলাই করার জন্য একটি বা দুটি পুরোনো শাড়ি থাকলেই চলবে। লেহেঙ্গাটিকে আরও অনন্য করে তুলতে বর্ডার, জারদৌসি, সিকুইন, সূচিকর্ম বা লেইসের মতো অলংকরণ যোগ করে নেওয়া যায়। ম্যাচিং ওড়না এবং ব্লাউজের জন্য শাড়ির গর্জাস আঁচল বা একই মোটিফের ফ্যাব্রিক কাজে আসবে।
স্কার্টে রূপান্তর
পুরোনো শাড়িকে সহজে একটি স্টাইলিশ, ফ্লোয়ি স্কার্টে রূপান্তর করা সম্ভব। সঙ্গে মানানসই টপ তৈরি করার মতো ফ্যাব্রিকও হাতে রয়ে যাবে। না থাকলেও সমস্যা নেই। স্কার্টটি সহজেই ট্যাঙ্ক টপ, শার্ট, অথবা কালো, সাদা রঙের একটি সাধারণ টি-শার্ট, অথবা যেকোনো রঙের ফতুয়ার সঙ্গে মিলিয়ে পরলেও মন্দ দেখাবে না।
শিফন কাফতান
কাফতান পোশাকটি একই সঙ্গে আড়ম্বরপূর্ণ ও আরামদায়ক। একটি পুরোনো জর্জেট বা শিফন শাড়িকে এই স্টাইলের জন্য সহজে কাস্টমাইজ করা যেতে পারে। শিফন ফ্যাব্রিকে চমৎকার কাফতান তৈরি করা যায়।
ওড়নায় রূপান্তর
র সিল্ক বা পাট সুতায় তৈরি আনারকলি স্যুটগুলো একটি ভারী কাজের জরির ওড়না দিয়ে পরলে অসাধারণ দেখায়। এ রকম একটি ওড়নার দাম জানা আছে? অনেক। অথচ প্রচুর অর্থ ব্যয় করার পরিবর্তে, প্রায় বিনা খরচে পুরোনো শাড়ি থেকে একটি অসাধারণ ওড়না তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। বর্ডারগুলো ভালো না লাগলে মনমতো লেইস জুড়ে নিলেই চলবে। ব্যস, হয়ে গেল।
শাড়ি থেকে আনারকলি
পুরোনো শাড়ির ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে চমৎকার আনারকলি স্যুট তৈরি করা যেতে পারে। পাজামা আর ওড়নার জন্য পর্যাপ্ত কাপড় না থাকলে একটি সাধারণ লেগিং এবং ম্যাচিং দোপাট্টা বেছে নিলেই চলবে। অন্য সবকিছু সাধারণ থাকলে ভারী কাজের আনারকলি টপ আরও আকর্ষণীয় লাগবে পরলে।
সন্তানের সঙ্গে ম্যাচিং
ব্যবহৃত শাড়ি আপসাইকেল করার অনন্য একটি উপায় হলো সন্তানের সঙ্গে ম্যাচিং পোশাক সেলাই করা। আজকাল খুবই ট্রেন্ডি ব্যাপারটা। অবশিষ্ট আরও শাড়ির টুকরা থাকলে, পুতুলের জন্যও ম্যাচিং পোশাক সেলাই করে দেওয়া যাবে। বাচ্চাও খুশি হবে, ছবিতেও দারুণ লাগবে।
গাউন বানাতে
ওয়ান পিস গাউন এখন দারুণ ট্রেন্ডি। তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে খুব পছন্দের পুরোনো কোনো শাড়ি। যদি পর্যাপ্ত ম্যাটেরিয়াল না থাকে, তবে বাড়তি ম্যাচিং কাপড় ব্যবহার করলেই চলবে। অলংকরণের জন্য লেইস, বিডস বা প্যাচ সই।
পাল্টে পালাজো প্যান্টে
সিল্ক, সুতি শাড়ি অথবা অন্য যেকোনো টেকসই ফ্যাব্রিক দিয়ে স্টাইলিশ পালাজো ট্রাউজার্স তৈরি করে নেওয়া যায়। সঙ্গে শুধু উপযুক্ত আস্তরণ ব্যবহার করাটা নিশ্চিত করতে হবে।
টপ/শার্টে রূপান্তর
শার্ট পরতে বেশি পছন্দ করেন? সালোয়ার বা কুর্তা ভালো লাগে না? সমস্যা নেই, পুরোনো শাড়িটিকে অনায়াসেই শার্ট বা টপে রূপান্তর করে নেওয়া সম্ভব। ট্রাউজার্স, জিনস বা শর্টসের সঙ্গে পরে নেওয়ার জন্য।
শাড়ি থেকে শারারা
কাপড় নষ্ট না করে পুরোনো শাড়ি পুনর্ব্যবহারের সবচেয়ে চমৎকার উপায় হলো সেগুলোকে শারারায় পরিণত করা। ভারী, সূক্ষ্ম কাজ করা শাড়িগুলো এই স্টাইলের মেকওভারের জন্য উপযুক্ত। শারারা প্যান্টের শাড়ির জমিন আর টপের জন্য আঁচল ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেক ফ্লেয়ারের পাশাপাশি শাড়িতে থাকা কাজও দারুণ ফুটে উঠবে শারারায়।
এত এত অপশনের মাঝে এতক্ষণে নিশ্চয় বোঝা হয়ে গেছে, স্টাইল ও স্থায়িত্ব সহাবস্থান করতে পারে। আসলে শাড়ি যত পুরোনোই হোক, কাউকে দিতে কিংবা ফেলতে ইচ্ছা করে না। ওই যে অনেক প্রিয় স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে! তাই তো পুনর্ব্যবহারের এত রকমের চেষ্টা।
রত্না রহিমা
মডেল: উষ্ণতা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ক্যানভাস
ছবি: কৌশিক ইকবাল