ফিচার I ট্র্যাডিশনাল টু ট্রেন্ডি
বেসিক এথনিক স্টাইলগুলো ভোল বদলে হয়ে উঠছে কোয়ার্কি, হালের ফ্লুয়িড ফ্যাশনের পরিপূরক। পুরোটাই কি পুরুষদের পাল্টে যাওয়া ফ্যাশন-ভাবনার প্রতিফলন? তার খোঁজে রত্না রহিমা
সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় এই উপমহাদেশ; বিশেষ করে খাদ্যে, নানান রঙিন উৎসবে এবং অবশ্যই পোশাকের বৈচিত্র্যে। কেবল নারী পোশাকের ক্ষেত্রে নয়; যেকোনো উদ্যাপন, বিয়ে ও উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী পুরুষ পোশাকেও প্রাণবন্ততা, শক্তি ও গতিশীলতার প্রতিফলন উল্লেখ করার মতো।
সেই শুরু থেকে এ দেশের পুরুষদের ফ্যাশনে একটি সমৃদ্ধ বিবর্তনের ধারা দেখা যায়। যদি প্রশ্ন করা হয়, উপমহাদেশে পুরুষদের মৌলিক জাতিগত পোশাক কী—উত্তরটা কি এককথায় দেওয়া সম্ভব হবে? না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ কুর্তা-পায়জামার কথা বলা হয়; যার শিকড় সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রোথিত। কুর্তা, যা আগে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সুতির পোশাক ছিল, এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক বলে ধরা হয়। গবেষকদের ধারণা, মধ্য এশিয়া ও পারস্যের প্রভাবে কুর্তা পুরুষের জাতিগত পোশাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে কুর্তা-পায়জামা, শেরওয়ানি এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুর্তা-ধুতিকে বলা হয় পুরুষের জন্য সর্বোত্তম পোশাক; যা এখনো মেল-ফ্যাশনে ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্যের ধারক এবং রাজকীয়তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। বিবাহ, উৎসব বা যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্যই হোক না কেন; নেহরু জ্যাকেট, আচকান ও শেরওয়ানির সঙ্গে কুর্তা-পায়জামা সেট বর্তমান আধুনিক পুরুষদের প্রথম পছন্দ।
শতাব্দী ধরে, ব্যক্তিগত পছন্দ, রং, স্টাইল, উপলক্ষ, আঞ্চলিক স্টাইল এবং আধুনিকায়নের প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে পুরুষদের জাতিগত পোশাকে বিভিন্ন রূপান্তর ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, একসময় বাঙালি বাবু বলতেই যে ধুতি পরার প্রচলন ছিল, তার পরিবর্তে সংযোজন ঘটেছে পায়জামার। কিংবা রঙের পরিবর্তনের কথাও বলা যায়। কেবল কমলা ও লাল রঙের পরিবর্তে আউট অব দ্য বক্স ও ট্রেন্ডি রঙে ঝোঁক বেড়েছে। কোমরে আরামদায়ক ড্রস্ট্রিং ও ইলাস্টিক কিংবা বিলাসী অনুভূতির স্পর্শের জন্য রাজকীয় কাপড় ব্যবহার—সবই সেই বিবর্তনের অংশ। অনুষ্ঠান অনুযায়ী এখন এমন সব প্রিন্টের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া হচ্ছে, যা একসময় কল্পনার অতীত ছিল।
যদিও এসব নানা পরিবর্তনের মাঝে ফ্যাশনেবল কিন্তু ট্র্যাডিশনাল পোশাকের ক্ষেত্রে এখনো শীর্ষে রয়েছে কুর্তা-পায়জামা, ট্রাউজারের সঙ্গে শেরওয়ানি, ধুতি বা চুড়িদার বা ফিউশনধর্মী নানা নকশার আচকান; যা হলুদ ও মেহেদির মতো বিবাহ-পূর্ব অনুষ্ঠান এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরার জন্য পছন্দের তালিকায় সবার আগে থাকে। তবে আগের সাদামাটা অবস্থা ছাপিয়ে সেখানে যুক্ত হয়েছে আকর্ষণীয় ডিজাইন, ট্রেন্ডি প্যাটার্ন, চটকদার প্রিন্ট, স্টাইল, ভিন্নধর্মী কাঠামো। নেহরু জ্যাকেট আর স্কার্ফের মতো মাল্টি-ফাংশনাল পিসের যোগে তৈরি হচ্ছে স্টেটমেন্ট স্টাইল। ফিউশনধর্মী পোশাক হিসেবে জমকালো অনুষ্ঠান এবং বিয়ের সময় পুরুষ পোশাকের একটি আদর্শ বিকল্প ধরা হয় এগুলোকে। বিলাসবহুল টেক্সচার, পরিশীলিত লুক এবং সূক্ষ্ম সূচিকর্ম ব্যবহার করে জনপ্রিয় ডিজাইনার ও ফ্যাশন লেবেলগুলো সেই পছন্দকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়। যেখানে যুক্ত হয়েছে তাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও ব্যক্তিত্ব।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজাইনার বা ফ্যাশন লেবেলগুলোই আসলে এথনিক ড্রেসআপের পরিধি প্রসারিত হওয়ার প্রধান কারণ। যেসবের কল্যাণে নিজেকে সুদর্শন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা অনেক সহজ হয়ে গেছে ছেলেদের জন্য। তাদের মধ্যে আধুনিক বোধ জাগ্রত হওয়া থেকে শুরু করে মার্জিত থাকা কিংবা নিজেকে ট্রেন্ডি দেখানোর জন্য বিকল্পের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন তারা। ডিজাইনারদের ব্যবহৃত জটিল সূচিকর্ম, নানা রকম ইউনিক মোটিফ, ব্রোচের ব্যবহার, লেয়ারিং স্টাইলের নতুন নতুন সংযোজন পোশাকগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্যাস্টেল শেডের জনপ্রিয়তা, শেরওয়ানির বহুমুখী ব্যবহার, নেহরু জ্যাকেট সেটের মতো নানা কিছু সেই সংযোজনে ক্রমেই উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে এথনিক ওয়্যার হয়ে উঠেছে পুরুষের রুচি ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের বড় মাধ্যম।
আজকাল অবশ্য অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। কারও কারও পছন্দ জাতিগত পোশাক থেকে পরিবর্তিত হয়েছে ইন্দো-পশ্চিমা পোশাকে। একসময় চোখে খটকা লাগলেও এখন ফুলেল প্রিন্টে কুর্তা-পায়জামা পরার ব্যাপারটি স্বাভাবিক, সহজ হয়ে উঠেছে। তাই আধুনিক বরদের পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক সৃজনশীল হতে দেখা যায়। প্লেইন, চেক, স্ট্রাইপ বা ঐতিহ্যবাহী লাল-হলুদ শেডের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন ফুলেল মোটিফে। আগে পুরুষদের পোশাকে ফুল, পোলকা বা পেইজলির মতো প্রিন্টের ব্যবহার দেখাই যেত না। কিন্তু আজকাল পুরুষেরা এই মোটিফগুলো ব্যবহারে আকর্ষণীয় স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করতে দ্বিধা করেন না একেবারেই; বরং গর্বের সঙ্গে ফ্লোরাল প্রিন্টেড, নেহরু জ্যাকেট, কুর্তা সেট, শেরওয়ানি এমনকি আচকানও পরে বেড়ান। তবে একটা কথা আছে, সুন্দর দেখাতে হলে আরামকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। সেটি মাথায় রেখে এখন পুরুষেরাও লিনেন, সুতি, অথবা র সিল্কের ফিউশন স্টাইল পোশাক দেদার বেছে নিচ্ছেন।
আবার কেউ কেউ সাধারণ কুর্তা-পায়জামার মতো পোশাকের নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কাট ও প্যাটার্নে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচিং পদ্ধতির আশ্রয় নেন। যেমন নেহরু জ্যাকেট সেটের নিচের কুর্তাটি হয়তো ট্রেন্ডি কাউল প্যাটার্ন বা অ্যাসিমেট্রিক স্টাইলের। এথনিক স্যুট, শেরওয়ানি ও কুর্তা সেটে অতিরিক্ত মাত্রা এবং নাটকীয় প্রভাবের জন্য ব্যবহার করা হয় ট্রেইল, বেল্ট, প্লিট ও লেয়ার; পাশাপাশি বেড়েছে নতুন নতুন শেড পরার প্রচলন। আধুনিক ডিজাইনাররা ফিউশন এবং ট্রেন্ডি এথনিক পোশাকের সঙ্গে পশ্চিমা স্পর্শের মিশ্রণ ঘটান খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। ব্যতিক্রমী করে তোলার জন্য নিয়ন শেড, অনিয়ন পিঙ্কের মতো প্যাস্টেল শেডসহ অন্যান্য কোমল ও ফেমিনিন কালার পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। শেরওয়ানি, স্যুট, যোধপুরি, কুর্তা অথবা আচকানের জন্য রঙের এমনতর বাছাই ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরাও বাহবা দিচ্ছেন। তাদের মতে, এই পছন্দ কেবল দেশের উচ্চ চেতনার সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করছে না; বরং ডিজাইনারদের শৈল্পিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটারও সুযোগ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি জাতিগত ও পশ্চিমা প্রভাবের এই সংমিশ্রণ পুরুষদের পরিবর্তিত ফ্যাশন সংবেদনশীলতার একটি উদ্ভাবনী সমাধান হিসেবেও কাজ করছে। কারণ, সামগ্রিকভাবে, পশ্চিমা ফ্যাশন উপাদান ও কাঠামোর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত পোশাকগুলোও ফ্যাব্রিক, রং, আবেদন এবং সামগ্রিক স্টাইলিংয়ে দেশীয় ফ্যাশন সংবেদনশীলতার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়।
মডেল: জামি, সালেকিন ও পলাশ
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ওয়্যারড্রোব: বালুচর
ছবি: সালেক বিন তাহের