skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I সোনালি সাহারা

তপ্ত দিন পেরিয়ে, সাহারা মরুভূমির বুকে পূর্ণিমার রাতের মায়াবি দ্যুতি উপভোগের দুর্লভ সৌভাগ্য কজনারই-বা হয়! হয়েছে ফাতিমা জাহানের। শোনাচ্ছেন সেই গল্প

গাড়িতে আরবি গান বাজছে। গানের ডিজে আরব দেশের একটি মেয়ে। তার সঙ্গে গাড়ি কাঁপিয়ে পারলে নেচে উঠেছেন ভ্রমণকারী বাকি সঙ্গী-সাথিরা। আমি বসে আছি সামনের সিটে। পাশের সিটে কলম্বিয়া থেকে আসা মারিয়া। এক বর্ণও ইংরেজি জানেন না। আমিও এক বর্ণ স্প্যানিশ জানি না। গতকাল সকালে পরিচয়। আমরা গ্রুপ ট্যুরে যাচ্ছি সাহারা মরুভূমির মাঝে মেরজুগা নামের একটি জনমানবহীন মরু প্রান্তরে। এই গ্রামের অবস্থান মরক্কোর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে।
মাইক্রোবাসের পেছনে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা ট্যুরিস্ট। এদের মাঝে যে দুটি মেয়ে আরবি গান পছন্দ করেন, নিজেদের সেলফোন গাড়ির স্পিকারের সঙ্গে সংযুক্ত করে এই ট্যুরের বিনে পয়সার ডিজে হয়ে বসে আছেন। তারা আরব বংশোদ্ভূত; তবে বসবাস ফ্রান্সে। এদের বেশভূষায়ও কিছুমাত্র আরব দেশের সংস্পর্শ নেই। তবে গাড়িচালক আজোজা ভাইয়ের সঙ্গে গড়গড় করে আরবিতে বাতচিত করে যাচ্ছেন, যার এক-দশমাংশ টেনেটুনে উদ্ধার করতে পারছি আমি।
উদ্দাম আরবি গানের তালে তালে একেকটা হেয়ার পিন ব্যান্ড আসে, আর চালক ভাই কীভাবে যেন গানের তালে তালে নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে ভয়াবহ বাঁকগুলো পার হয়ে যাচ্ছেন। যেন বাঁকে বাঁকে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরানো তার প্রিয় কাজ। আমাদের গাড়িতে আরও দুজন কলম্বিয়ান আছেন। একজন মোটামুটি ইংরেজি জানেন, অপরজন শুধু হাসি বিনিময় করে যান। এরাও দেখি তালে তালে বেশ দুলছেন।
বাইরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। অবশ্য গাড়িতে এয়ারকন চালু আছে, তাই রোদের আঁচ গায়ে লাগছে না। বাইরে এখন লাল উঁচু উঁচু সোনালি পাহাড় আর তার নিচে সবুজের চাদর বিছিয়েছেন গ্রামের কৃষকেরা। এদিকটায় সাধারণত মরক্কোর ব্যারব্যার জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা মূলত পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন অল্প কিছু মানুষ কৃষিকাজও করে থাকেন।
ফসলের খেত আর পিচঢালা আঁকাবাঁকা পথের মাঝখানে দেয়াল তুলে দিয়েছে সারি সারি খেজুরগাছ। জানান দিচ্ছে, একটু পরই মরুভূমির দিকে নিয়ে যাবে আমাদের।
ব্যারব্যার জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলোও দেখার মতো। এরা লাল মাটি দিয়ে ঘর বানান। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সোনালি প্রাসাদ একেকটি। মাঝে কিছু গাছপালা। অবশ্য মরক্কোর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে গাছপালা কম। ব্যারব্যার জনগোষ্ঠী খুব রক্ষণশীল হয় বলে শুনেছি। কিন্তু এখানে দেখছি মেয়েরাও বাইরে নিজের কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদের পরনে মরোক্কান কাফতান আর মাথায় ছোট স্কার্ফ। মরক্কোয় অপরিচিত কারও ছবি তোলার অনুমতি নেই; সে নারী হোক বা পুরুষ। এ ক্ষেত্রে এরা বেশ রক্ষণশীল। তবে ট্যুরিস্ট স্পটের দোকানিদের দয়া হলে মাঝেমধ্যে ছবি তুলতে দেন।
আমি আবার গ্রামের দিকে মনোযোগ দিলাম। এত ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন যে, এই লোকালয়কে গ্রাম বলে মনেই হচ্ছে না। পিচঢালা পথ থেকে বহুদূরে বিন্দুসম ঘরবাড়ি, অসীম নীল আকাশ, সবুজ চিলতে উঠোন, সোনালি পাহাড়ের উড়ে যাওয়া আর একা একটি সোনালি পথ চলে যাচ্ছে গ্রামের দিকে। আমরা এখন আছি হাইওয়েতে। অবশ্য আশপাশে কোনো গাড়ি নেই। তবে ঘোড়াসদৃশ গাধা আছে। এই গাধার পিঠে চড়েই ব্যারব্যার জনগণ চলাফেরা করে। গাধাকে স্থানীয়রা ব্যারব্যার ট্যাক্সি বলে ডাকেন। মাঝেমধ্যে ব্যারব্যার ট্যাক্সিতে চড়া মানুষ দেখা যাচ্ছে।
মারাক্কেশ থেকে রওনা দেওয়ার সময় আশপাশে বেশ ঝলমলে সবুজ ছিল, যা ধীরে ধীরে সোনালি প্রান্তর হয়ে যাচ্ছে। কখনো দুপাশে জায়গা করে নিচ্ছে আকাশছোঁয়া সোনালি পাহাড়; কখনো একেবারে সমতল, সোনালি রং তার। হঠাৎ হঠাৎ নদীর চরের মতো পাশ দিয়ে সরে যায় অল্প কিছু সবুজ গাছ। কিছু পথ পেরোবার পর দেখি, ব্যারব্যার ট্যাক্সিতে এক নারী বসে কোথায় যেন যাচ্ছেন। নারীদের গাড়ি, ঘোড়া, উট বা হাতির পিঠে চড়তে দেখেছি; তবে এই প্রথম কোনো নারীকে গাধার পিঠে চড়ে চলাচল করতে দেখলাম। জীবনে কত কিছু যে দেখার বাকি থাকে!
পথের দুপাশের মুঠো মুঠো রত্ন ফেলে রেখে আমাদের একটি রেস্তোরাঁয় থামতে হলো দুপুরের খাবারের জন্য। খাবার টেবিলে আমার দুপাশে দুই কলম্বিয়ান। এক পাশে মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোন মারিয়া, অন্য পাশে নিকোলাস! এদের মাঝে নিজেকে হারিয়ে যাওয়া বোনের মতোই মনে হচ্ছে আমার। আমি যা অর্ডার দিচ্ছি, ওরাও একই খাবার অর্ডার দিচ্ছেন। আমরা মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী খাবার তাশিন অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। রেস্তোরাঁটি একটি পাহাড়ের পাশে। পাহাড়ের গায়ে দুলছে নানা গাছপালা আর পায়ের কাছে বয়ে চলছে ক্ষীণকায় এক নদী। হু হু করে বাতাস আছড়ে পড়ছে, আর আমরা পনেরোজন টেবিলে পরিবেশন করা খাবার দিয়ে পিকনিক করছি।
খেয়ে আমাদের মোটামুটি ঘাড় ধরে এখানকার গাইড পাশের স্যুভেনির শপে নিয়ে গেলেন কিছু বিক্রি করার জন্য। গিয়েই লেকচার শুরু করলেন, মরুভূমিতে এত গরম থাকবে যে, সেখানে বিশাল আকারের স্কার্ফকে পাগড়ির মতো পেঁচিয়ে না পরলে নাকি মান-ইজ্জত থাকবে না! মানে, গায়ের চামড়া ঠিক থাকবে না; পুড়ে যাবে। আমরাও তাই তাগেলমাস্ত বা লিতাম কিনে ইজ্জত রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম! মানে, একে একে সবাই সেই স্কার্ফ কিনলাম চড়া দামে। মরক্কোয় এসে এখন অবধি কিছু কিনিনি; কিন্তু পাগড়ির নাম করে আমাকে সুতি কাপড়ের ওড়না গছিয়ে দিল। আগে জানলে দেশ থেকে সাদা রঙের আড়াইগজি ওড়না নিয়ে যেতাম। বাড়িতে এমনিতেই ছয়-সাতখান পড়ে আছে।
এরপর আজোজা ভাই গাড়ি হাঁকালেন মরুভূমির দিকে। বেলা প্রায় হেলে পড়ছে। মরুভূমির মাঝে আমাদের রাত কাটাতে হবে, তাই সন্ধ্যের মধ্যেই সেখানে নিয়ে যাবেন। লম্বা ধূসর পিচঢালা পথ পেরিয়েছি কখন, জানি না। হঠাৎ আবার পেছন থেকে চিৎকার। দুর্ঘটনার দেশের মানুষ আমি, মনে হলো, কেউ কি দুর্ঘটনায় পড়েছে? আসলে সামনে সোনালি যে রেখা দেখা যাচ্ছে, তা সাহারা মরুভূমির শুরুয়াত। এ জন্যই পেছনের মেয়েরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। ওদের চিৎকার শুনে আমরাও সামনে থেকে তারস্বরে চেঁচানো শুরু করলাম। অবশ্য আমার চেঁচানো শুনলে গাধাও ভয় পেয়ে যাবে!
যতই বিশ্রীভাবে চেঁচাই না কেন, সামনে ধীরে ধীরে সাহারা তার স্বর্ণের চাদর মেলছে। কাছে আসতে আসতে পুরো জগৎ সোনালি হয়ে গেল। এ এক জাদুর পৃথিবীতে এসে পড়েছি। যা দেখছি, তা-ই যেন স্বর্ণ হয়ে স্বর্গ দেখাচ্ছে। আমি এতই মোহিত হয়ে পড়লাম, সংবিৎ ফিরল মারিয়ার ধাক্কায়। গাড়ি থেকে নামতে হবে। এখান থেকে আমাদের উটের পিঠে করে মরুভূমির মাঝখানে নিয়ে যাবে। অবশ্য গাড়ি করেও যাওয়া যায়; তবে ট্যুর বুক করার সময় বলে দিয়েছিলাম, আমি বালিয়াড়িতে উটের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে চাই। সাহারার সোনালি বালু দেখে সামনেই একজন মধ্যবয়স্ক নারী শিশুর মতো হুটোপুটি করছেন। আমাকে বললেন ছবি তুলে দিতে। এখানে আরও অনেক ট্যুরিস্ট জড়ো হয়েছেন। তারাও বালিয়াড়ির পাহাড়ে চড়ে ছবি তুলছেন। ছবি তুলে দেওয়ার পর জানলাম, ভদ্রমহিলা বেলজিয়াম থেকে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। মেয়েটি একদম গ্রিক দেবীর মতো দেখতে। ভদ্রমহিলার নাম ক্লারা আর মেয়ের নাম লিয়া। ক্লারা এখন আমাকে চোখে চোখে রাখছেন, যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া তার মেয়ে আমি। কী আশ্চর্য, সাহারায় এসে দেখি, মেলায় হারিয়ে যাওয়া পরিবার খুঁজে পাচ্ছি পদে পদে!
ওদিকে মারিয়াও হাতছানি দিচ্ছেন। বালুর পাহাড়ের একদম ওপরে উঠে গেছেন তিনি। আমি ক্লারাকে হাত ধরে বালুর পাহাড়ের ওপর টেনে তুলে দেখালাম, এখান থেকে দিগন্ত কেমন লাগে। ক্লারার ওজন এক শ কেজির কাছাকাছি। একা উঠতে পারছিলেন না। তার মেয়েকে বহুদূরে বিন্দুসম দেখা যাচ্ছে। সেখানে সে মহানন্দে সেলফি তুলছে। ক্লারার চোখে এখন স্নেহ ঝরে ঝরে পড়ছে। হয়তো ভেবেছিলেন, কখনোই বালুর পাহাড়ে চড়তে পারবেন না।
এদিকে দিগন্তের কাছে সারি সারি উট এনে দাঁড় করানো হয়েছে। এ দৃশ্য এক জনমে চোখের পাতায় আটকে রাখতে হয়। উটের সারি এখন বসে পড়েছে। পাশেই বালুর টিলার মতো উঁচু জায়গায় আরেক সারি উট এসে জায়গা করে নিয়েছে। উটের এই সারির পেছনে সোনালি সূর্য ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চারদিকে এখন স্বর্ণে মোড়া জগৎ, আর সেখানে বসবাস করছি আমরা। এমন ক্ষণ যেন এ জগতের নয়। ঠিক যেন কোনো এক স্বর্গের একটি সোনালি উদ্যান স্রষ্টা পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য।
এদিককার ফটোসেশন শেষ করে আমরা চলে গেলাম উটের কাছে। মারিয়াকে খুঁজে পেলাম এখানেই। এমনভাবে আমার পাশে আছেন, যেন আমি এখনি হারিয়ে যাব। খুব সম্ভবত মরুভূমির রিসোর্টের গাইড কয়েকজন এসেছেন আমাদের উটে চড়িয়ে নিয়ে যেতে। সারি সারি উটের সামনে দাঁড়িয়ে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। নাম এবেনি। আফ্রিকান মেয়ে; তবে থাকেন ফ্রান্সে। আপাদমস্তক কালো বোরকার মতো পোশাকে মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় লিতাম জড়ানো। আমিও গাড়ি থেকে নেমেই গাইডদের একজনকে দিয়ে মাথায় পাগড়ির মতো লিতাম বেঁধে নিয়েছি। আমি পাগড়ির লেজ দিয়ে মুখ ঢাকিনি; তবে এবেনি মুখ ঢেকে রেখেছেন। মেয়েটিকে বেশ হাসিখুশি মনে হলো। শুরু থেকেই হইহল্লা করে যাচ্ছেন। আমিও কি এদের কারও চেয়ে কম কিছু!
এদিকে রিসোর্টে ক্লারা উটে চড়ে যাবেন না। সাহস পাচ্ছেন না। তিনি আর কয়েকজন গাড়ি করে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে কাতর নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বি সেইফ।’ ক্লারার মেয়ে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের এই অধিক যত্ন কিছুতেই মানবে না। তাই ক্লারা মায়ার কলসের পুরোটাই আমার ওপর ঢেলে দিয়েছেন। ইউরোপীয় নারীরা এত মায়াবী হন, কে জানত! আজকাল তো আমাদের দেশেও অপরিচিতের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না।
আমার সামনের উটের পিঠে এবেনি আর পেছনে ক্লারার মেয়ে। একে একে উটের পিঠে বসার পর উটগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার গ্রুপের সব ছেলেমেয়ে লিতাম মাথায় বেঁধে নিয়েছেন। উটের পিঠে সবাইকে এখন আরব্যোপন্যাসের কাফেলা বলে মনে হচ্ছে।
উটগুলো একটার পেছনে আরেকটা চলছে হেলেদুলে। আমি আগেও উটের পিঠে চড়েছি; তবে অল্প সময়ের জন্য। এই সফর মনে হচ্ছে দীর্ঘ হবে। আমাদের সঙ্গে সামনের উটকে দিকনির্দেশনা দিতে একজন উটের লাগাম ধরে বালুর ওপর হাঁটছেন। বাকি উট একে অন্যকে অনুসরণ করে যাচ্ছে। এদিকে এবেনি আমার আর ওর উটের সঙ্গে সমানে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, আমার উটের বয়স বেশি নয়। দেখে একদম কিশোরের মতো মনে হচ্ছে।
আমার এসব কিছুতেই মন নেই। উটের পিঠ থেকে এখন আরও দূরের দিগন্ত দেখা যাচ্ছে। অবাক করা এক ভিন্ন জগৎ যেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী আকাশ, যে কারও কথা শোনে না, সে-ও এখন সোনালি বালুকে অনুকরণ করে সোনারং ঝরিয়ে দিতে চাইছে। কার কাছে বেশি ঐশ্বর্য আছে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে যেন। এদিকে রোদের আঁচ মরে গেছে। বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে। এবেনির খিলখিল করে হাসির আওয়াজ আসছে। পাশে আরেকটা উটের কাফেলা আমাদের ছাড়িয়ে চলছে। আরেক দিকে দিগন্ত এখন স্বর্ণে মেখে কোথাও আর যেতে চাইছে না। উট তার নিজস্ব গতিতে চলছে; কিন্তু আমার এই সন্ধ্যা আকাশ আর বালিয়াড়ি কীভাবে যেন এক বেলার জন্য স্বর্গ দেখিয়ে গেল। মন বদল করে সোনালি আকাশ কথার ফুলঝুরি ফোটাচ্ছে। যেন আকাশ বেয়ে বেয়ে সোনার মোহর গলে গলে পড়ছে বালুতে। আর মরূদ্যান তো সেই কবে থেকে আকাশের রোজকার আলাপ শুনছে। কী শান্ত, কী অসাধারণ অভিযোগহীন!
এ পথের শেষ না হলে আমি সবচেয়ে বেশি লাভবান হতাম; কিন্তু মরুভূমির ঠিক মাঝখানে সারি সারি তাঁবুর সামনে এসে আমাদের নামিয়ে দিল। ক্লারা আগেই এসে পড়েছেন। গাড়িতে তার আসতে ১০-১৫ মিনিট লেগেছে; আর আমাদের লেগেছে দুই ঘণ্টা। কিন্তু এই দুই ঘণ্টায় আমার মনে হয়েছিল, জীবনের শ্রেষ্ঠ বাহনে চড়ে মরুপাড়ের হাওয়া গায়ে মেখে, সোনালি আনন্দে মন ডুবে যাচ্ছে।
উটের পিঠে থাকাকালেই সূর্যাস্ত দেখেছি। এখন দেখছি তার বাকি জৌলুশ। চারদিক লাল আভায় ছড়িয়ে গেছে। আমি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েছি, আশপাশে কী হচ্ছে, খেয়াল নেই। আমাকে আমার তাঁবু দেখিয়ে দিতে রিসোর্টের একজন দাঁড়িয়ে আছেন; কিন্তু তার কথা আমার কানে ঢুকছে না। আমি ঘোরগ্রস্তের মতো দিগন্তের দিকে চলছি। সামনের লালিমা আমাকে জাদু করেছে। আমি চলেছি সেই জাদুকে মুঠোবন্দী করতে।
হঠাৎ হাত ধরে কে যেন টেনে নিল। প্রায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া চরাচরে দেখি মারিয়া। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার পেছন-পেছন এসেছেন। ওর সঙ্গে কথা হয় ইশারায়। বললেন, ‘চলো।’ আমি চললাম মারিয়ার সঙ্গে; তবে মুঠোয় ধরে রেখেছি সেই অদ্ভুত সুন্দর লালিমা।
তাঁবুর সামনে এখন নাচ-গানের আসর বসেছে। ব্যারব্যার ছেলেরা ডাফলি, ঢোল বাজিয়ে গাইছেন আর নাচছেন। ক্লারা জোর করে আমাকে তার পাশে বসালেন। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলাম না। আমার মন ছুটে যাচ্ছে আকাশের পানে। আমি সারা জীবন অপেক্ষা করেছি মরুভূমিতে পূর্ণিমা দেখার। আজ পূর্ণিমার রাত। অনেক হিসাব কষে পূর্ণিমার রাতে মরুভূমিতে এসেছি। আমার নিজের জন্য আলাদা সময় চাই চাঁদ দেখতে। কোলাহল, ভিড়, ট্যুরিস্টদের নাচ-গানের আসর ফেলে চলে গেলাম তাঁবুগুলোর পেছনে। এখানে কেউ নেই। আমি আর চাঁদ, আর মরুভূমির বালিয়াড়ি।
চাঁদ আমার দিকে কোনাকুনি দিক থেকে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণে এই মরুভূমি চাঁদের আলোয় রুপালি হয়ে উঠেছে। অপরূপ এক জ্যোৎস্না আকাশ থেকে হাওয়ার মতো চারদিকে ছেয়ে রয়েছে। মরুর বালুও সোনালি থেকে ধীরে ধীরে রুপালি রঙে রেঙে উঠেছে। পায়ের নিচের গরম বালু ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে; আর বসার জন্য পেছনের নাচ-গান ফেলে একটু দূরে একেবারে সুনসান একটা জায়গাও মিলল। অবশ্য আশপাশে কয়েক মাইল দূরে কেউ নেই, কোনো তাঁবু নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। এর মাঝেই এরা রিসোর্ট তৈরি করেছেন আমাদের জন্য।
আকাশে পেঁজা তুলার মতো গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ এসে ভর করেছে এইমাত্র। জোছনাকে এখন আরও মোহময় করে তুলেছে। মেঘের জন্য চাঁদ আরও ছড়িয়ে পড়েছে আর মনে হচ্ছে, হাজার হাজার চাঁদের কণা এখন আকাশ থেকে হাসছে।
কতক্ষণ ধরে বসে আছি, জানি না। পেছন থেকে একজন ব্যারব্যার ছেলে এসে রাতের খাবারের জন্য ডেকে নিয়ে গেলেন। খাবার টেবিলে পৌঁছাবার আগেই মারিয়া আর ক্লারার হাতে ধরা পড়লাম। এরা আমায় খুঁজে খুঁজে হয়রান। আমিও মজা করে বললাম, আমি ম্যাজিক কার্পেটে করে সাহারা মরুভূমিতে সফরে গিয়েছিলাম। ওদের রাগ ছিল দেখার মতো!
রাতের খাবারেও নানা ধরনের তাশিন পরিবেশন করা হলো। ভোর চারটার আগে উঠতে হবে, সূর্যোদয় দেখার জন্য। রাতের খাবারের পর একদল ইউরোপীয় ছেলেমেয়ে আমায় ঘিরে ধরেছে ভারতীয় উপমহাদেশের গল্প শুনবে বলে। ক্লারা বললেন, ‘আমাদের তাঁবুতে একটা এক্সট্রা বিছানা আছে, তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে এসে গল্প করতে পারো। ঘুম পেলে ঘুমাতেও পারো।’ এদিকে আমি নির্জনতা চাইছি; চাইছি চাঁদের হাট থেকে বেরিয়ে একাকী চাঁদের কাছে যেতে।
চাঁদ এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। এক কোনা থেকে আরেকটু ওপরে গিয়ে রাজ করছে। আমার তাঁবুর দুয়ার খোলা চাঁদের জন্য। যেকোনো সময়ই সে চাইলে আসতে পারে। সে এলো। বাঁকা একটা আলো ফেলে তাঁবু দখল করে আলো সাজিয়ে মেঝেতে ঝলসে উঠল। মরুভূমিতে আমার পূর্ণিমা উদ্‌যাপন হলো সার্থক।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top