যাপনচিত্র I বৈচিত্র্যে বুঁদ
নাহিদা আক্তার। করপোরেট ব্যক্তিত্ব। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডিফেন্স, আরএমজি সেক্টর, ব্যাংক, এনবিএফএস ও এমএফএস, পাওয়ার সেক্টর, এমএনসি, গ্রুপ অব কোম্পানিজ, নেটওয়ার্ক ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ডেটা সেন্টার, ভিডিও সার্ভিলেন্স অ্যান্ড কনফারেন্সিং, পেমেন্ট গেটওয়ে নিয়ে আছে কাজের বিশদ ও বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা। বর্তমানে ওরাকলের বিজনেস ম্যানেজার
কর্মচঞ্চল দিনের বাইরে, ছুটির দিনটি ধীরতালে শুরু করেন নাহিদা আক্তার। ঘুমকাতুরে স্বভাবের বলে সকালে একটু দেরিতে বিছানা ছাড়েন; তাই ব্রেকফাস্ট সারতেও অন্যান্য দিনের তুলনায় দেরি হয়ে যায়। তার মতে, শরীরে সারা দিনের প্রয়োজনীয় শক্তি জোগাতে ব্রেকফাস্ট হওয়া চাই যথাযথ। দুটি ডিম, সবজি, রুটি আর ফল থাকে মেনুতে; সঙ্গে অবশ্যই নিজ হাতে বানানো চা। একবারে বেশি না খেয়ে সারা দিন অল্প অল্প করে খাবার গ্রহণের পক্ষপাতী তিনি। দুপুরের পাতে তেমন কোনো নির্দিষ্ট মেনু থাকে না। গান শুনে, বই পড়ে, দীর্ঘদিন যাদের সঙ্গে কথা হয় না, তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং একমাত্র সন্তানকে সময় দিয়ে বিকেল পর্যন্ত কাটিয়ে দেন এই সিঙ্গেল মাদার।
একসময় ইয়োগা চর্চার অভ্যাস ছিল। তা থেকে পেতেন প্রশান্তি ও কর্মচাঞ্চল্য। তবে আজকাল অফিসের পর সময় পেলে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ অথবা জিমে গিয়ে ওয়ার্কআউট করেন। বাসায় রাতের খাবারে থাকে একেবারেই বাঙালিয়ানার ছাপ। মেনুতে সামান্য ভাত, সবজি আর ডাল। পরের দিন অফিস না থাকলে রাত ২টা, আর থাকলে ১টার মধ্যে ঘুমোতে যান। আর হ্যাঁ, নিজে ও মেয়ে মিলে পোষেন চারটি বিড়াল। সেগুলোর মধ্যে মা বিড়ালটির নাম কিটক্যাট; সেটির ছানাপোনাদের নাম ক্যাসপার, জিঞ্জার ও ক্যাডবেরি।
মেয়ের প্রসঙ্গে নাহিদার মন্তব্য, ‘মা-মেয়ের সম্পর্কের বাইরেও আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্ব কিংবা তারও বেশি কিছু। এমনকি সে কখনো কখনো অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে! সারা দিন ব্যস্ত থাকি আমি, তবে ব্রেকফাস্ট ও ডিনার মেয়ের সঙ্গেই করি। অবসরে আমাদের খুনসুটি, আড্ডা ভালোই জমে।’
বাসার অন্দরসজ্জা নিজের পছন্দমতো সাজিয়েছেন নাহিদা আক্তার; যা এককথায়, ‘সিম্পল অ্যান্ড কোজি’। তাতে দেয়ালজুড়ে রয়েছে নানা পেইন্টিং, যার বেশির ভাগ কন্যা মাহিয়াত তাসনিম প্রাপ্তির আঁকা। স্বভাবগতভাবেই বহির্মুখী ও আড্ডাবাজ নাহিদা; তবে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা বজায় রাখেন। তার আছে বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীর বিবিধ সার্কেল, যেগুলোতে ক্ষেত্রবিশেষে আড্ডার টপিক হয়ে ওঠে ইন্টেলেকচুয়ালিটি, ক্যারিয়ার, ফান প্রভৃতি।
নাহিদা গান শোনেন মন-মর্জির ওপর। তবে বিশেষভাবে বুঁদ হয়ে থাকেন রবীন্দ্রসংগীতের সুরের মায়ায়। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন বাংলাদেশে ওয়ারফেজ, অর্থহীনের মতো রক ব্যান্ডগুলো থেকে শুরু করে দেশে অনুষ্ঠিত এ আর রাহমান, মাইকেল লার্নস টু রক, কৈলাশ খের, জুলিয়ান মার্লে, আশা ভোঁসলেসহ অন্যান্য শিল্পীর কনসার্টে উপস্থিত থাকার কথা। সাহিত্যপাঠের অভ্যাসের সূচনা অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে; হাতেখড়ি হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে। বিশেষ পছন্দ করেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার প্রমুখের বই। এখন অবশ্য খুব একটা সময় পান না; তবে আগে ছিলেন সিনেমা ও টিভি সিরিজের পোকা। সম্প্রতি দেখা পছন্দের টিভি সিরিজ অ্যাডলেসেন্স। এ ছাড়া জানিয়েছেন মানি হাইস্ট সম্পর্কে মুগ্ধতার কথা। খুব পছন্দের সিনেমা দ্য গডস মাস্ট বি ক্রেজি। প্রিয় অভিনয়শিল্পী উত্তমকুমার, রাহুল বোস, ইরফান খান, টম ক্রুজ, জনি ডেপ, সুচিত্রা সেন, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও সালমা হায়েক। সেলিব্রিটি ক্রাশ টম ক্রুজ।
পরিধেয় নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। শাড়ি থেকে শুরু করে করপোরেট অ্যাটায়ার, ওয়েস্টার্ন, সালোয়ার-কামিজসহ নানা পোশাকে দেখা মেলে তার। পোশাকের রঙের ক্ষেত্রে সলিড ডার্ক পছন্দ; বিশেষত কালো ও লাল। সেলফোন, এয়ারপড, স্মার্টওয়াচের ক্ষেত্রে তিনি অ্যাপল গ্যাজেট ফ্রিক! সংগ্রহে আছে নানা ধরনের জুতা ও ব্যাগ; তবে এ ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড নিয়ে মাথা ঘামান না। সুগন্ধির ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষ বাছ-বিচার আছে তার; ডিওর, শ্যানেল ও বারবেরি পছন্দের ব্র্যান্ড। ‘যা আমাকে মানাবে, যা ক্যারি করতে পারব, তা-ই আমার কাছে ফ্যাশন,’ সার্বিকভাবে এমনটাই অভিমত নাহিদার।
তিনি ভ্রমণপিয়াসি। বললেন, ‘ভ্রমণের মাধ্যমে যেমনি জমে থাকা নেতিবাচক অনুভূতি ঝেড়ে ফেলা যায়, তেমনি সবকিছুতে নতুন উদ্যম ফিরে পাওয়া সম্ভব। তাই আমি অনেক সময় কাজের ক্ষেত্রে চাপ অনুভব করলে ছোট ছোট ট্রিপ দিই। বিশ্বাস করি, ভ্রমণে এমন জ্ঞান পাওয়া যায়, যা হয়তো পুঁথিগত বিদ্যায় পাওয়া অসম্ভব। বিভিন্ন দেশ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মানুষ দেখে মনে হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক বা ভুল বলে কিছু নেই।’ এখন পর্যন্ত নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়াসহ নানা দেশ ঘুরে দেখেছেন। অ্যাডভেঞ্চার ভীষণ পছন্দ; ১৪ হাজার ফুট উঁচু থেকে স্কাই ডাইভিং থেকে শুরু করে বাঞ্জি জাম্পিং—নানা অ্যাকটিভিটির অভিজ্ঞতা আছে তার। বললেন, ‘স্মরণীয় ভ্রমণস্মৃতি ভারতীয় শহর কার্শিয়াং ঘিরে। সেখানকার এমন এক পাহাড়ে গিয়েছিলাম, যার ওপর থেকে শিলিগুড়ি দেখা যায়। পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতায় বসে অনুভব করেছিলাম, প্রশান্তি সত্যিকার অর্থে কী! সেখানে বিকেল থেকে সন্ধ্যায় রূপান্তর কিংবা একটি অন্ধকার লোকালয়ে একে একে সব আলো জ্বলে উঠতে দেখার অনুভূতি আজও আমাকে আলোড়িত করে।’ ড্রিম ডেস্টিনেশন সম্পর্কে তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘লাস ভেগাস।’
নাহিদা শৈশব থেকেই ফুটবলের অনুরাগী। তখন আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ না বুঝেই কিংবা অন্যদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে আবাহনীর ভক্ত হয়ে ওঠেন। আন্তর্জাতিক ফুটবল বুঝতে শুরু করার পর থেকে আর্জেন্টিনার একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রীতি ম্যাচ থেকে কোপা আমেরিকা কিংবা বিশ্বকাপ ফুটবল—প্রিয় দলের খেলা মিস করতে একেবারেই নারাজ। প্রিয় ফুটবলার লিওনেল মেসি।
নাহিদা আক্তারের কর্মজীবন শুরু ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে, আমরা নেটওয়ার্কস লিমিটেডের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ক্রেডিট কন্ট্রোলে। কাজ দিয়ে নিজেকে বারবার ভেঙে গড়েছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় আট বছর ফিন্যান্সে কাজ করার পর যোগ দেন বিজনেস টিমে। এরপর কর্মস্থল পাল্টিয়ে, একে একে এসএসডি-টেকের (বর্তমানে ডটলাইনস) হেড অব করপোরেট বিজনেস এবং জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের বিজনেস ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। বর্তমানে আছেন ওরাকলে, আগেই যেমনটা বলেছি।
ফাইন্যান্স থেকে বিজনেস বিভাগে পাড়ি জমানো, অর্থাৎ ক্যারিয়ারের বাঁকবদল প্রসঙ্গে বললেন, ‘প্রথম এক বছর (২০১৩-১৪) ছিল চ্যালেঞ্জিং। যারা অভিজ্ঞ, ভালো কাজ করেন, তাদেরকে মেন্টর মেনে এবং তাদের কাজ দেখে শিখেছি। ক্লায়েন্ট অ্যাপ্রোচ, প্রোডাক্ট সলিউশন, কী কী প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, কোন ক্লায়েন্টের চাহিদা কী—এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজেছি। বাংলাদেশে প্রথম কোনো জাহাজে ভিডিও সার্ভিলেন্স সেটআপে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। মনে করি, চুজ আ গুড বস, নট আ কোম্পানি। এ ছাড়া ভালোভাবে কাজ করলে এমপাওয়ারমেন্ট হয়, এমপাওয়ারমেন্ট থেকে আসে ওনারশিপ, আর ওনারশিপ থাকলে কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে ড্রাইভ করা যায়। কাজের ক্ষেত্রে নিজের একটি অনন্য স্টাইল থাকা এবং আউট অব দ্য বক্স চিন্তা করতে পারাও গুরুত্বপূর্ণ।’
জীবনদর্শন সম্পর্কে এই করপোরেট ব্যক্তিত্বের ভাষ্য, ‘প্রথমত, জীবনে যা-ই করি, মন দিয়ে করি। সবাইকে বলি, “ডু ইওর বেস্ট, বেস্ট উইল কাম টু ইউ।” দ্বিতীয়ত বলব সিমপ্লিসিটির কথা; এর কারণে জীবনে লোভ থেকে দূরে থাকা যায়। আর তৃতীয়ত, মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা; সম্ভব হলে উপকার করা।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন
