skip to Main Content

মনোযতন I ডিস্টাইমিয়া ডিলেমা

এ এক স্থায়ী বিষণ্নতা ব্যাধি। বুঝতে অনেক সময় রোগীর তো বটেই, আশপাশের মানুষেরও পেরিয়ে যায় দীর্ঘকাল

প্রায় এক বছর ধরে মেয়েটি একদম চুপচাপ। স্কুলে যায় ঠিকই; কিন্তু আগের মতো কারও সঙ্গে মেশে না, হেসে ওঠে না, খায় কম, সারা দিন ঘরের কোণে বসে থাকে। মা ভাবছেন, বয়সের দোষ। বাবা বলেন, মেয়েটি একটু ইনট্রোভার্ট। কিন্তু মেয়েটি নিজেও জানে না, সে এত মন খারাপ নিয়ে কেন বড় হয়ে উঠছে।
মন খারাপেরও একটি দীর্ঘস্থায়ী ভার্সন আছে। ডিস্টাইমিয়া। সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘স্থায়ী মৃদু বিষণ্নতা’। কিন্তু এই মৃদু বা হালকা ব্যাপারই ধীরে ধীরে জীবনকে গিলে ফেলতে পারে!
অর্থ অনুসন্ধান
ডিস্টাইমিয়া বা পার্সিস্টেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার (পিডিডি) একধরনের দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা, যা সাধারণত দুই বছর বা তারও বেশি সময় ধরে আক্রান্তজনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। একে অনেক সময় লো-গ্রেড ডিপ্রেশনও বলা হয়। তবে ‘লো’ বলেই এটি কম গুরুতর, এমন ভাবার সুযোগ নেই; বরং এই ধীরগতির বিষণ্নতার পক্ষে চরম বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনা সম্ভব। কেননা, এটি ভয় দেখায় না; বরং নিঃশব্দে ভেতরটা নিঃশেষ করে ফেলে!
ডিস্টাইমিয়ায় আক্রান্ত একজন ব্যক্তি সারাক্ষণ কাঁদবেন, এমন নয়; বরং প্রতিটি দিন তার কাছে হতে পারে একটু বেশি ভারী, একটু কম উজ্জ্বল। কোনো কাজেই সত্যিকারের আগ্রহ পান না; ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে পারেন না। এমনকি কোনো সম্পর্কেও তেমন উষ্ণতা করেন না অনুভব।
যেন চিরকালীন মনখারাপের বাসা
ডিস্টাইমিয়া আদতে ডিপ্রেশনেরই একটি ধরন; তবে চেনা-জানা ধরনগুলোর চেয়ে আলাদা। এটি বড় কোনো মানসিক বিপর্যয়ের মতো আচমকা আঘাত করে না; বরং ধীরে ধীরে, নীরবে মানুষের মনকে গ্রাস করে ফেলে। মৃদু বিষণ্নতার মতো লাগলেও এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল। এতে আক্রান্ত কারও মুখে হাসি থাকলেও ভেতরে ধ্বংসের স্পর্শ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বিষণ্নতা থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে একটানা।
মানুষটি হয়তো চাকরিতে যান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেন; তবু সবকিছুতেই যেন ক্লান্তি, বিরক্তি আর একঘেয়েমির ছায়া লেগে থাকে। তার জীবনে যেন কিছুই ভালো লাগে না—না নিজেকে, না অন্যদের, না ভবিষ্যৎকে।
চেনার উপায়
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিংয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাঈদুল আশরাফ কুশল বলেন, ‘অনেকে দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্নতায় ভুগলেও বুঝতেই পারেন না, এটি কোনো রোগ। বরং একে ‘ব্যক্তিত্ব একটু চুপচাপ’ অথবা ‘এই বয়সে এমন হয়’ ধরনের হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, ডিস্টাইমিয়া একবার ভেতরে ঢুকে গেলে সম্পর্ক, শিক্ষা, কর্মজীবন—সবকিছুর ওপর ছায়া ফেলে।’
মানসিক ব্যাধির ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল ‘ডিএসএম-৫’-এ প্রকাশিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেউ যদি অন্তত দুই বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন বিষণ্নতায় ভোগেন এবং সঙ্গে থাকে ক্ষুধা পরিবর্তন, ঘুম সমস্যা, ক্লান্তি, আত্মমূল্যায়নের অভাব, মনোযোগে ঘাটতি, অথবা হতাশা; তবে তাকে ডিস্টাইমিয়ায় আক্রান্ত হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
সাধারণ ‘মন খারাপ’ নয়
মন খারাপ আমদের সবারই হয়। কিন্তু ডিস্টাইমিয়া হলো এমন একধরনের বোধ, যেটা চাইলেই বদলায় না। ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশলের ভাষ্যমতে, এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু লক্ষণ থাকে। যেমন প্রায় প্রতিদিনই মন খারাপ হওয়া, খুব সাধারণ কাজেও বিরক্তি বা ক্লান্তি অনুভব করা, কোনো কিছুতেই আনন্দ খুঁজে না পাওয়া, মনোযোগে ঘাটতি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা, আত্মসমালোচনা বা আত্মদ্বন্দ্বের পীড়ন, অতিরিক্ত ঘুম কিংবা অনিদ্রা, ক্ষুধা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া বা বাড়া, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা, নিজের মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতে না পারা, সব সময় ক্লান্তি বোধ করা, ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাশা প্রভৃতি। এই উপসর্গগুলো দিনে দিনে ব্যক্তি হিসেবে তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারে।
তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই কেন বেশি
কৈশোর কিংবা তারুণ্যের সময়কাল মানেই আত্মপরিচয় অনুসন্ধান, আত্মবিশ্বাসের সংগ্রাম, আর জীবন নিয়ে নানা প্রশ্ন। এ বয়সী কেউ অবমূল্যায়িত কিংবা বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হলে, পরিবারে সহানুভূতি না পেলে একটি স্থায়ী বিষণ্নতা তার মনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়; বিশেষ করে কোনো মেয়ে যখন নিজেকে তথা নিজ শরীর, সামাজিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, ডিস্টাইমিয়া তাকে খুব সহজ শিকারে পরিণত করতে পারে। ছেলেদের মধ্যেও এই মনোব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে; তবে তারা অনেক সময় প্রকাশ করতে চান না।
আলসেমি না ডিস্টাইমিয়া
আমরা প্রায়ই আমাদের মানসিক স্থবিরতাকে ‘আলসেমি’, ‘মন না চাওয়া’ কিংবা ‘বিষণ্ন মেজাজ’ বলে এড়িয়ে যাই। কিন্তু যদি একই অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এবং সেটি জীবন চালানোয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে একধরনের মানসিক অসুস্থতা, যেটির চিকিৎসা প্রয়োজন।
যারা বেশি ঝুঁকিতে
ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশল বলেন, ডিস্টাইমিয়া অনেক সময় কোনো ট্রিগার ছাড়াই আবির্ভূত হতে পারে। তবে কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা, অভিজ্ঞতা বা পরিবেশ একে ত্বরান্বিত করে।
 যাদের পরিবারে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি বা বাইপোলার ডিজঅর্ডার আছে;
 যারা শৈশবে ট্রমা কিংবা দীর্ঘ অবহেলার শিকার;
 অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, ইনট্রোভার্ট বা পারফেকশনিস্ট স্বভাবের ব্যক্তি;
 নারীরা, বিশেষ করে হরমোনাল পরিবর্তন অর্থাৎ কৈশোর, গর্ভবতীকাল কিংবা মেনোপজের দিনগুলোতে;
 সোশ্যাল আইসোলেশনে থাকা, বিশেষ করে শহরের তরুণ কর্মজীবী একাকিত্বে ভোগা মানুষ;
 লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতার গ্লানি যাদের আঁকড়ে ধরে;
 বিশেষ সম্পর্কে অবমাননা কিংবা মানসিক নির্যাতনের যারা শিকার;
 শারীরিক অসুস্থতায় নিরাশ মানুষ।
পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণদের প্রায় ১৫ শতাংশ কোনো না কোনো বিষণ্নতায় আক্রান্ত। অথচ তাদের অধিকাংশই চিকিৎসা নেন না। কেননা, সমস্যাটি সম্পর্কে তারা সচেতন নন কিংবা সামাজিক মানসিকতা তাদের তা চেপে যেতে বাধ্য করে।
সামাজিক ভূমিকা ও ভ্রান্ত ধারণা
‘বিষণ্ন মানেই কান্নাকাটি’, ‘যার বিষণ্নতা আছে, সে কাজ করতে পারবে না’, ‘ছেলে হয়ে বিষণ্নতা কিসের’—এই সব স্টেরিওটাইপের ভেতর দিয়ে অনেকে নিজেদের সমস্যাকে মিথ্যে গণ্য করেন। ফলে চিকিৎসার চেয়ে গোপন রাখাই যেন প্রধান বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনে ডিস্টাইমিয়া অনেক সময় কর্মক্ষেত্রের অতিরিক্ত চাপ কিংবা ব্যর্থ সম্পর্কের বেদনা থেকে শুরু হয়ে, নিঃশব্দে দীর্ঘ মেয়াদে বিস্তৃত হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব
আজকের তরুণেরা ‘অলওয়েজ প্রোডাকটিভ’, ‘পজিটিভ ভাইবস অনলি’, ‘রাইজ অ্যান্ড গ্রাইন্ড’—এসব সোশ্যাল ট্রেন্ডের মধ্যে চাপ অনুভব করেন। কেউ যদি বলেন, ‘আমি ভালো নেই’; তাকে ‘নেগেটিভ’ বলে অপমান করা হয়। ফলে অনেকে সত্যিকার মানসিক অবস্থা চেপে, মুখে হাসি অথচ ভেতরে তীব্র বিষণ্নতা জিইয়ে রাখেন।
ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশল বলেন, ‘এই “হ্যাপিনেস কালচার” অনেক সময় ডিস্টাইমিয়া বাড়িয়ে তোলে। কারণ, রোগী মনে করেন, ‘সবাই ভালো, শুধু আমি ব্যর্থ’। ফলে তিনি আত্মবিশ্বাস হারান; তার মনে আত্মঘৃণা তৈরি হয়।’
কী হতে পারে পরিণতি
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ডিস্টাইমিয়া ধীরে ধীরে মেজর ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার ডেকে আনতে পারে। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ স্পৃহা কমে যায়, আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত ক্ষয় ঘটে, উচ্চ মাত্রার কর্মক্ষেত্র ক্লান্তি ও বার্নআউট তৈরি হয় এবং তা তাকে আত্মহত্যামূলক চিন্তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
মুক্তির পথ
ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশল জানান, ডিস্টাইমিয়া সারিয়ে তোলা কঠিন; তবে অসম্ভব নয়। ধাপে ধাপে, সঠিক সহায়তা ও ধৈর্যের মাধ্যমে এই অসুখকে বশ মানানো যেতে পারে।
 সাইকোথেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিওয়ার থেরাপি (সিবিটি) ও গেস টক থেরাপি রোগীকে নিজের আবেগ চেনাতে সাহায্য করে।
 মেডিকেশন: অনেক সময় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রয়োজন পড়ে; তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করা চাই। অবশ্য থেরাপির সঙ্গে সমন্বয় করে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 জার্নালিং: নিজের অনুভূতির ডায়েরি রাখা মানসিক স্বস্তি আনে। ‘আজকের অনুভব’, ‘আমি কী নিয়ে চিন্তিত’, ‘কোন কথা কষ্ট দিয়েছে’—এসবের চর্চা নিজেকে বোঝার পথ তৈরি করে।
 জীবনধারা: নিয়মিত ঘুম ও খাবারের রুটিন অনুসরণ, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা অথবা ব্যায়াম করা, রাতে নির্দিষ্ট সময় থেকে ফোন বন্ধ রাখা এবং ছবি আঁকা, লেখা, গান শোনার মতো শখ বা ক্রিয়েটিভ অ্যাকটিভিটির মাধ্যমেও এই মানসিক সমস্যা সামলানো সম্ভব।
 সহানুভূতি: বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীদের উচিত বিনা প্রশ্নে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে থাকা, তাদের অনুভূতিকে সম্মান দেওয়া এবং দোষারোপ না করা।
নয় ভয়
ডিস্টাইমিয়া মানেই দুর্বলতা নয়; বরং এটি একটি বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অবস্থা। অনেকে যেমন ডায়াবেটিস বা অ্যাজমা নিয়ে বাঁচেন, তেমনি ডিস্টাইমিয়াও নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
অন্যদিকে, যারা এখনো বলেন, ‘মন খারাপ এমনিই ভালো হয়ে যাবে’—তাদের বোঝা উচিত, সময়মতো না বুঝলে এই মন খারাপই একদিন ডিপ্রেশন, প্যানিক ডিজঅর্ডার কিংবা আত্মঘাতী চিন্তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ডিস্টাইমিয়া একটি অন্তর্নিহিত ও নীরব ঘাতক। তাই সময়মতো সাড়া না দিলে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।

 সুবর্ণা মেহজাবীন
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top