যাপনচিত্র I ‘লাগে উরাধুরা’
দেবশ্রী অন্তরা। প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠশিল্পী। তার একান্ত জীবনে উঁকি দিলে দেখা মেলে যা কিছুর
ছোটবেলা থেকে নাচ-গানের সঙ্গে বেড়ে ওঠা দেবশ্রী অন্তরার। গান গাওয়া, নাচ, সংবাদ ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, করপোরেট চাকরি…কী করেন না তিনি! এককথায় বহু গুণে গুণান্বিত। ‘তুফান’ মুভিতে প্রীতম হাসানের সঙ্গে তার গাওয়া ‘লাগে উরাধুরা’ গানটি প্রকাশের পর থেকে মানুষের মুখে মুখে। সিনেমায় তার কণ্ঠে ঠোঁট মিলিয়েছেন ভারতীয় অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের ট্রেন্ডিং লিস্টে এই গানের জয়জয়কার; পাশাপাশি নান্দনিক জীবনযাপন ও ব্যতিক্রমী ফ্যাশন সেন্স তাকে আর দশজনের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।
তার জীবনে গানের শুরু কীভাবে? জানালেন, সূচনা রেকর্ডিং শুনে। ‘সারেগামা’র প্রথম ‘সা’-এর পাঠ নিয়েছেন মা-বাবার কাছ থেকে। হারমোনিয়ামের পাঠ ভাইয়ের কাছ থেকে নেওয়া। অন্তরার পছন্দের শিল্পী রুনা লায়লা, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, শ্রেয়া ঘোষাল, সুনিধি চৌহান, ন্যান্সি, কনা প্রমুখ। ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে এক শিক্ষকের উৎসাহে গান শেখা শুরু করেন ছায়ানটে; নেন রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও লোকগীতির পাঠ। অন্যদিকে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ও-লেভেল ও এ-লেভেল শেষে ভর্তি হন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে; মার্কেটিং ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস নিয়ে সম্পন্ন করেন উচ্চশিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতে ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা ‘আরটিভি-ডাবর ভাটিকা ক্যাম্পাস স্টার’ নির্বাচিত হন। এ ছাড়া বেসরকারি টিভি চ্যানেল ডিবিসিতে ইংরেজি সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি ‘মিট দ্য এনভয়’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন; তাতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তার। হাবিব ওয়াহিদের কম্পোজ করা ডুয়েট গান ‘প্রেমে পড়া মন’ ও ‘মন বোঝে না’ তাকে গায়িকা হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। তবে ক্যারিয়ারে শুরুতে তাকে কাজের মাধ্যমে আলোচনায় আনেন মিউজিক কম্পোজার আপেল মাহমুদ এমিল।
দেবশ্রী অন্তরার অলস-অবসর দিন অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন। বাকিরা এমন দিনের জন্য অপেক্ষা করলেও তিনি কিছুটা বিষাদে ভোগেন! কারণ, তিনি কাজপাগল; এমন দিনের দেখা তার জীবনে খুব কম মেলে। এমন সব দিনে বিছানা ছাড়তে ছাড়তে দুপুর নেমে আসে; বেজে যায় ১২টা-১টা। ফ্রেশ হয়ে সারেন ব্রেকফাস্ট। মেনু পাস্তা, নাগেটস, রুটি-সবজি ইত্যাদি। এরপর ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে মুভি ও সিরিজের দুনিয়ায় হারিয়ে যান।
পারিবারিক রেওয়াজ আছে সন্ধ্যায় পূজা আয়োজনের; বাসায় থাকলে তাতে অংশ নেন। রাতের খাবার সারেন ৯টা-১০টার দিকে। স্বল্পাহারী এই তারকার এ বেলার মেনু খুব সাধারণ। প্রিয় খাবার ঘিয়ে মাখানো ভাত, সঙ্গে মুরগির মাংস; আর থাকে সবজি।
ক্যারিয়ারে নানা কাজের ব্যস্ততায় দিনপ্রতি চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারেননি বহুদিন। তবে কাজের বিরতিতে পাওয়ার ন্যাপ নিতেন। আর তা থেকে ঘটে বিপত্তি; পড়েন ব্রেন হরমোনজনিত সমস্যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে এখন ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করেন। কর্মব্যস্ত দিনে সকাল ৬টার মধ্যে বিছানা ছাড়েন; তারপর হাঁটতে বের হন। শরীরচর্চায় গুরুত্ব দিতে সম্প্রতি জিমে যাচ্ছেন।
দর্শক হিসেবে বলিউড ও সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি বেশি পছন্দ অন্তরার। সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা ‘বাহুবলী’। এ ছাড়া বিশেষ পছন্দের তালিকায় আছে ‘ম্যায় হু না’, ‘কাভি খুশি কাভি গম’ প্রভৃতি। সমকালীন দেশি মুভির মধ্যে ‘তুফান’ ও ‘উৎসব’ তাকে বেশ মুগ্ধ করেছে। বড় পর্দার বিদেশি প্রিয় তারকার তালিকায় রয়েছে হলিউডের ব্র্যাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি; বলিউডের শাহরুখ খান, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ও দীপিকা পাড়ুকোন; সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমার প্রভাস, নানি ও আনুশকা শেঠির নাম। স্বদেশের নিরিখে এই তালিকা একটু দীর্ঘ। শাকিব খানের সাম্প্রতিক ট্রান্সফরমেশন অন্তরাকে বিমোহিত করেছে। এ ছাড়া তালিকায় আছেন মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, ইয়াশ রোহান, সোহেল মণ্ডল, নুসরাত ইমরোজ তিশা, অপি করিম ও তারিন। মডেল সাদিয়া ইসলাম মৌকে দেখে বড় হয়েছেন; ফলে তিনিও আছেন অন্তরার প্রিয় তারকার তালিকায়। আর সেলিব্রিটি ক্রাশ প্রসঙ্গে তার বাজি নানির পক্ষে।
নিজের বাসা মনমতো সাজিয়েছেন এই গায়িকা। হলুদাভ ওয়ার্ম লাইট তার পছন্দ। ঘরের পরিপাটি আবহে দেখা মেলে ভিনটেজ স্টাইলের ফার্নিচারের। দেবশ্রী অন্তরা আয়োজন করে রান্না করতে ভালোবাসেন; তবে একা নয়, সঙ্গে কেউ না কেউ থাকা চাই। অবশ্য রান্নার ক্ষেত্রে মন-মর্জির সায় দেওয়া চাই। নিজে যতটা খেতে ভালোবাসেন, তার চেয়ে অন্যদের খাওয়াতে আনন্দ পান। নানা পদের রান্না করলেও তার হাতের মুরগির মাংস, পাস্তা ও নুডলসের রয়েছে বিশেষ সুনাম।
ভ্রমণ করতে ভীষণ ভালোবাসেন এই তারকা। চাকরির সুবাদে দেশের নানা প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন। এ ছাড়া ঘুরেছেন মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়। সমুদ্র, পাহাড়, বন্য প্রাণী ও ঐতিহ্যের মিলনে শ্রীলঙ্কা তার বেশি ভালো লেগেছে। পাহাড়ের তুলনায় সমুদ্র তাকে বেশি টানে। পারিবারিক আপত্তির কারণে আগে কখনো রাতে বাসার বাইরে থাকা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণ করা না হলেও গেল বছর সেই নিয়ম ভেঙেছেন। বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন সিলেটে। সেই ভ্রমণের বাজেট ছিল জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা! এর মধ্যে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী দর্শনীয় গ্রাম ভোলাগঞ্জে গিয়েছিলেন; যে অঞ্চল সাদাপাথরের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার পাথর, রোপ ওয়ে, পাথর কোয়ারি আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য এখনো তার চোখে লেগে আছে। আরও গিয়েছিলেন শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে, জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখালে। সেখানকার পাহাড়ে সবুজ বন, নানা জাতের বৃক্ষের সমাহার এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। জাফলংয়ে গিয়ে দেখেছেন পাহাড়, পাথুরে নদী, ঝরনা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জীবনধারা—সবই মোহনীয়। সবশেষে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে সবুজ কার্পেটে মোড়ানো চা-বাগানে গিয়ে সেই যাত্রা শেষ হয়। সেখানকার ব্যবস্থাপকের বাংলোতে গিয়ে অভিভূত হয়ে ভেবেছেন, এমন চাকরি নিজে করতে পারলে দারুণ হতো!
দেবশ্রী অন্তরাকে শাড়িতে দারুণ নান্দনিক, আত্মবিশ্বাসী ও মার্জিত দেখায়—এ কথা স্বীকৃত। এ ছাড়া পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় করপোরেট অ্যাটায়ার, সালোয়ার-কামিজ, ওয়েস্টার্ন, কোট-প্যান্টেও দেখা মেলে তার। ‘তবে হ্যাঁ, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে শাড়িতেই আস্থা। আর পছন্দের রং নীল,’ বললেন এই গায়িকা। জুতা সংগ্রহের নেশা আছে তার; প্রিয় ব্র্যান্ড জিমি চু। ব্রেসলেট পরেন সব সময়; কানের দুল পরতেও ভালো লাগে। অবশ্য সবচেয়ে পছন্দের অ্যাকসেসরিজ ঘড়ি।
‘ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ’ টার্ম প্রসঙ্গে নিজেকে স্টাইলিশ দাবি করেন অন্তরা; তবে ফ্যাশনেবল বলতে নারাজ। তার মতে, ফ্যাশনেবল হওয়ার সঙ্গে দামি ব্র্যান্ড ওতপ্রোত। অন্যদিকে স্টাইলিশ হওয়া মানে, যা কিছু আছে; তা দিয়ে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন।
তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব বড় ভাই জয়ন্ত রায় চৌধুরী। দুজনের বয়সের ব্যবধান দেড় বছর। ভাইয়ের সম্পর্কে দেবশ্রী অন্তরা বলেন, ‘হি ডাজ এভরিথিং অ্যাট দ্য সেম টাইম অ্যান্ড হি ইজ ভেরি কনফিডেন্ট। আমার জীবন তার জন্য অনেক সহজ হয়েছে।’ জীবনদর্শন সম্পর্কে এই তারকার অভিমত, ‘লিভ ইচ মোমেন্ট অব লাইফ।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: রনি বাউল
