skip to Main Content

টেকসহি I প্রবীণ প্রাণ

১ অক্টোবর। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য পালিত হয় দিবসটি। বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রবীণ জীবনচিত্রের ওপর আলোকপাত করেছেন সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু

ফিলিপাইনের ১০৮ বছর বয়সী এক উল্কিশিল্পী, আপো ওয়াং-ওডকে নিয়ে গল্প শুরু করা যাক। বিশ্বখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তার স্থান হয়েছিল বিশ্বের প্রবীণতম মডেল হিসেবে। ১৬ বছর বয়স থেকে ওয়াং-ওড উল্কিশিল্পে নিয়োজিত। তবে তার উল্কির সঙ্গে আধুনিক সুচ বা কৃত্রিম রঙের কোনো সম্পর্ক নেই। ওয়াং-ওডের উল্কির ধরন প্রাচীন বাটোক পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে বাঁশের কঞ্চি, পামেলার কাঁটা, পানি ও কাঠকয়লার মাধ্যমে জীবন ও গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়। তার কাজ শুধু শিল্প নয়; বরং ফিলিপাইনের প্রাচীন সংস্কৃতির সাক্ষ্যও বটে।
উল্কিশিল্পী ওয়াং-ওডের জীবন আমাদের শেখায়, প্রবীণেরা কেবল অতীতের নির্দেশক নন; তারা সাংস্কৃতিক ও মানবিক শিক্ষার জীবন্ত উৎসও। তার হাতের রেখা ও উল্কির গল্প প্রকাশ করে বয়সের সঙ্গে পাওয়া অভিজ্ঞতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়।
জাতিসংঘ ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ওল্ডার পারসনস) হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা ১৯৯১ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখে প্রস্তাবিত রেজল্যুশন ৪৫/১০৬-এর মাধ্যমে এ দিবস ঘোষণা করে। জাতিসংঘের বার্ধক্য প্রোগ্রাম প্রবীণদের অধিকার ও কল্যাণের জন্য সচেতনতা ও প্রচারণা চালাতে এই নেতৃত্ব দেয়। এই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রবীণদের জীবন ও জ্ঞানকে সম্মান করা এবং তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
দিবসটির মূল উদ্দেশ্য সমাজে প্রবীণদের অবদান, অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ৬০ বছর বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বজুড়ে এদিনে বয়সকে কেবল সংখ্যা হিসেবে নয়; প্রবীণদের জীবন ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব নতুন প্রজন্মের চলার পথে কতটা পাথেয়, সেটিকেই গুরুত্ব দেয়।
বাংলাদেশেও প্রতিবছরের ১ অক্টোবর দিবসটি উদ্‌যাপিত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০০০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৬০ বছর বয়সী প্রবীণ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে এই সংখ্যা দুই কোটির ওপরে পৌঁছবে। ২০৫০ সালে প্রতি পাঁচজন নাগরিকের মধ্যে একজন প্রবীণ হবেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশের সমান। আশ্চর্যজনকভাবে, একই সময়ে শিশুর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৯ শতাংশে। এর মানে, ভবিষ্যতে দেশজুড়ে শিশুদের চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বেশি হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক-২০২৩ সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ৬০-এর বেশি। অর্থাৎ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ১ কোটি ৬৪ লাখের বেশি মানুষ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, চলতি প্রবণতা অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের দেশের ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৬ কোটি এবং তা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ হয়ে যাবে। এটি বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে অনেক উন্নয়নশীল দেশই দ্রুত প্রবীণপ্রধান সমাজের দিকে এগোচ্ছে।
এখানেই রয়েছে চিন্তার আরেক জায়গা। যে হারে প্রবীণ বাড়ছে, সে হারে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রবীণ জনসংখ্যা শুধু সামাজিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাতে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। তাই প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা, একাকিত্ব, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং অসহায়ত্ব বাড়ায় তাদের কল্যাণের জন্য বিশেষ নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রবীণবিষয়ক নীতি ও পরিকল্পনা অনেক আগেই গড়ে উঠছে। ১৯৩৮ সালে রাশিয়ায় এ ধরনের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৬৫ ও ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনার আয়োজন করা হয়। ১৯৮২ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে ‘ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন অন এজিং’ গৃহীত হয়, যেখানে ১৪টি মূলনীতি এবং ৬২টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়।
এরপর, ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছরের ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়। ২০০২ সালে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে ‘মাদ্রিদ ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন অন এজিং’ গৃহীত হয়, যা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদিত। এই আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা প্রবীণদের কল্যাণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়।
বার্ধক্য মানুষের জীবনে একটি স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণতি। বার্ধক্যের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও বিজ্ঞানীরা সাধারণত বয়সের মাপকাঠি অনুসারে এটি চিহ্নিত করেছেন। শারীরিক, মানসিক, আচরণগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনা করে বার্ধক্যকে মানুষের জীবনের একটি বিশেষ পর্যায় হিসেবে দেখা হয়। এটি শুধু বয়সের বৃদ্ধি নয়; বরং অভিজ্ঞতা, সামাজিক অবদান ও জীবনের নতুন ধারা গ্রহণের সময়ও নির্দেশ করে। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহে ৬৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসাবে বিবেচনা করা হলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ বলে অভিহিত।
বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য সমস্যাবলির মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা অন্যতম। আমাদের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে পরিবার ছিল প্রবীণদের জীবনযাত্রার মূল ভিত্তি। অতীতে প্রবীণেরা যৌথ পরিবারে সবার কাছ থেকে সেবা ও সহায়তা পেতেন এবং এভাবেই তাদের সময় কেটে যেত। পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনসহ তাদের যত্ন নেওয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক চর্চা। কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। প্রবীণেরা হারাচ্ছেন পরিবারের সহানুভূতি, বাড়ছে অবহেলা এবং তারা শিকার হচ্ছেন বঞ্চনার। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় দেখা যাচ্ছে, তারা প্রথমত নিজ পরিবারে এবং পরে সমাজের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে ক্ষমতা ও সম্মান হারাচ্ছেন; বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণেরা বার্ধক্যজনিত সমস্যা ও চরম আর্থিক দীনতার কারণে পরিবারের সহায়তা হারাচ্ছেন এবং সমাজের সব ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়ছেন, যা আগামীতে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৯৯৮ সালে দরিদ্র প্রবীণদের জন্য ‘বয়স্ক ভাতা’ কার্যক্রম চালু করেছে। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্তদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা সহজীকরণ ও সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তবে প্রবীণদের বৃহত্তর স্বার্থ, অর্থাৎ তাদের অধিকার, সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
২০১৩ সালে গৃহীত জাতীয় প্রবীণ নীতিমালায় প্রবীণদের অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি প্রদানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, আজকের সমাজ ও সভ্যতার পথপ্রদর্শক হলেন প্রবীণেরা। তারা শুধু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেন না; বরং পরিবার, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিও স্থাপন করেন। তাই তাদের অবদান স্বীকার, অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এটি তাদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সমাজে মর্যাদা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
একই সঙ্গে প্রবীণদের উৎপাদনশীল শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কাজে তাদের পরামর্শ কাজে লাগানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ও সামাজিক উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের সমান অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা সমাজে স্থিতিশীলতা ও সমতার জন্য অপরিহার্য। প্রবীণদের স্বীকৃতি, অংশগ্রহণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়; দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে প্রবীণদের বিষয়টি সরাসরি সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও দেশের সকল অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনমান দৃঢ়ভাবে উন্নত করা। এর মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা উল্লেখযোগ্য। এটি প্রবীণদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি; কারণ, দেশের সমাজে তাদের নিরাপত্তা ও সেবা প্রদান কার্যক্রম মূলত এই নীতির ওপর নির্ভরশীল।
সংবিধান আরও নিশ্চয়তা দিয়েছে নাগরিকদের কর্মসংস্থান, যৌক্তিক মজুরি, বিশ্রাম ও বিনোদনের অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার; বিশেষ করে বেকারত্ব, অসুস্থতা, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যের কারণে যারা অভাবগ্রস্ত, তাদের সরকারি সহায়তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রবীণদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা আজকের দিনে জাতীয় নীতিমালা, পেনশন, বয়স্ক ভাতা এবং অন্যান্য সামাজিক সেবার মাধ্যমে বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে।
প্রবীণেরা আমাদের জীবনের এক প্রাণবন্ত ইতিহাস, অনন্য প্রাচুর্য। তারা অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাদের মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল মানবিক দায়িত্ব নয়; বরং সামাজিক উন্নয়নেরও অপরিহার্য শর্ত।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top