skip to Main Content

ত্বকতত্ত্ব I গ্লো রিচুয়াল ২.০

কনের ত্বকযত্নে সুদূর অতীতের কিছু রেওয়াজ একেবারেই হারিয়ে যায়নি; বরং ফিরে এসেছে আধুনিক ও পরিমার্জিত সংস্করণে। উপকারিতায় বেড়েছে গ্রহণযোগ্যতা

বিয়ের আগের দিনগুলোতে কম-বেশি সব কনেই স্বপ্ন বোনেন, জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ দিনে তার মুখে যেন আভা ছড়ায়, চোখে থাকে প্রশান্তির ছোঁয়া। মেহেদির রং, অলংকার আর সাজের চাকচিক্যে তার ত্বকও যেন কথা বলে; হয়ে ওঠে কোমল, উজ্জ্বল আর আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ। বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতিতে এই প্রস্তুতি শুরু হতো বেশ আগেই। বিয়ের অন্তত কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে মেয়েরা শুরু করতেন নিয়মিত রূপচর্চা। ঘরোয়াভাবেই তৈরি হতো নানা ভেষজ ফেসপ্যাক, উপটান আর তেলের মিশ্রণ। চন্দন, হলুদ, গোলাপজল, মসুর ডাল বা বেসন—এসব ছিল ত্বক উজ্জ্বল করার প্রধান উপকরণ।
কনের ত্বকচর্চা এই উপমহাদেশে শুধু সৌন্দর্যের অনুশীলন নয়; ছিল একপ্রকার আচার, আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি আর নারীর গৌরবের প্রতীকও। প্রাচীন ভারতবর্ষে বিশেষত বাংলায়, আর্য-দ্রাবিড় প্রভাবিত সংস্কৃতিতে, আয়ুর্বেদিক ধারায় কনেদের জন্য ব্যবহৃত হতো নানা ভেষজ, ফুল, ফল, শস্য ও প্রাকৃতিক উপাদান। যেমন প্রাচীনকাল থেকে এই ত্বকচর্চার প্রধান উপাদান ছিল হলুদ। আয়ুর্বেদের ভাষায় একে বলে ত্বকের রক্ষক। কনের মুখে দীপ্তি আনতে, জীবাণু নাশ করতে এবং ত্বকের দাগ দূরীকরণে এর ব্যবহারের চল ছিল।
আরও ছিল চন্দনের ব্যবহার; মূলত অভিজাত ও রাজপরিবারের নারীদের পছন্দের উপাদান। এর শীতলতা ত্বককে প্রশান্ত এবং দাগ ও র‌্যাশ দূর করার পাশাপাশি সুঘ্রাণে ছড়াত প্রশান্তির আবহ। বিয়ের আগে কনের কপাল, গাল ও গলায় চন্দনের পেস্ট লাগানোর চল ছিল। প্রাচীনকালে চন্দনকেই দেখা হতো দিব্য সৌন্দর্যের ছোঁয়া হিসেবে, যা বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অন্তর্গত শান্তির প্রতীক। এ ছাড়া মেহেদি ছিল সাজের অপরিহার্য অংশ। হাত-পা ও নখে এর লালচে আভা শুধু অলংকরণ নয়; একধরনের শীতলতা ও শুভ লক্ষণের প্রতীকও হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, কনের মেহেদির রং যত গাঢ় হবে, নবদম্পতির সম্পর্ক হবে তত গভীর। মেহেদির নকশায় ফুটে উঠত প্রেম, সৌভাগ্য ও নবজীবনের বার্তা।
এর বাইরে গ্রামীণ ও নগরজীবনে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল বেসন ও দইয়ের মিশ্রণ। এতে থাকত বেসন, দই ও লেবুর রস এবং কখনো কখনো মধু। এই পেস্ট মৃতকোষ তুলে দিয়ে ত্বককে করত কোমল ও উজ্জ্বল। নববধূর ত্বক যেন হয় দুধে আলতা—এমন প্রত্যাশায় প্যাকটি ছিল অনেকের প্রিয় ঘরোয়া টোটকা।
বিয়ের দিন নববধূকে বিশেষ স্নান করানোর রেওয়াজও ছিল; যাকে বলা হতো মঙ্গলস্নান। এই স্নানে ব্যবহৃত হতো বেসন, হলুদ, চন্দন, গোলাপজল, কাঁচা দুধ, তিলের তেল ও জাফরান। এটি ছিল একাধারে ত্বকচর্চা ও আধ্যাত্মিক রীতি; নতুন জীবনে প্রবেশের আগে শরীর ও আত্মা—দুটোকেই শুদ্ধ করার প্রতীক হিসেবে পরিগণিত।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
সময় বদলেছে। এখনকার কনে জানেন, শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, ভেতর থেকে ত্বক প্রস্তুত করাই আসল যত্ন। প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক স্কিন কেয়ারের বিজ্ঞান। সেই উপটানের পাশে জায়গা নিয়েছে হায়ালুরনিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি সেরাম কিংবা জেড রোলার। বাঙালি, ভারতীয় কিংবা উপমহাদেশীয় বিয়ের প্রস্তুতিতে ত্বকচর্চা কেবল সৌন্দর্যের বিষয় হিসেবে ধরা হয় না; একে মানা হয় আত্মবিশ্বাস তৈরির অংশ হিসেবেও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হলুদ অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে ত্বক পরিচর্যার প্রতীক। এ কেবল উৎসব নয়; বরং নিজের ভেতরের উজ্জ্বলতাকে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত।
শরীরে হলুদের প্রলেপ দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার পেছনে রয়েছে গভীর বৈজ্ঞানিক কারণও। রেজুভা ওয়েলনেস সেন্টারের ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. তাওহিদা রহমান ইরিন বলেন, ‘প্রাচীন আমলের এই স্কিন কেয়ার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অনেক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। যেমন হলুদের কারকিউমিন ত্বকের প্রদাহ কমায়, বেসনের প্রোটিন ত্বক এক্সফোলিয়েট করে। আর মধু বা গোলাপজল ত্বকের ময়শ্চার ব্যালান্স বজায় রাখে।’ তিনি আরও জানান, আধুনিক স্কিন কেয়ারের বিজ্ঞান এই ঐতিহ্যকে আরও কার্যকর করে তুলেছে। এখন এর সঙ্গে ক্লিনিক্যাল হাইড্রেশন ও ভিটামিন-সমৃদ্ধ সেরাম যোগের চল চালু আছে, যাতে ত্বকের ভেতর থেকে উজ্জ্বলতা আসে। একে বলা যায় বিজ্ঞান আর ঐতিহ্যের নিখুঁত মেলবন্ধন। আজকাল অনেক কনে বিয়ের আগে স্পা ট্রিটমেন্ট, হাইড্রা ফেশিয়াল কিংবা অর্গানিক স্কিন থেরাপি নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বাড়িতেই অনুসরণ করছেন নিজস্ব রুটিন; প্রতিরাতে জেন্টল ক্লিনজার, টোনার ও সেরাম ব্যবহার, সপ্তাহে দুদিন মাইল্ড স্ক্রাব আর মাস্ক। এতে ত্বক হয় গভীরভাবে পরিষ্কার ও প্রাণবন্ত। এই ধৈর্যপূর্ণ যত্নের ফলই বিয়ের দিনটিতে কনের মুখে এনে দেয় প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা, যা কোনো ফাউন্ডেশন দিয়ে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
অভয়ঙ্গা থেকে অ্যারোমাথেরাপি
আয়ুর্বেদে অভয়ঙ্গা বা তিলের তেল দিয়ে মাসাজ ছিল একসময়ের কনের জন্য আবশ্যিক রীতি। এটি ত্বকের পাশাপাশি মনকেও প্রস্তুত করত নতুন অধ্যায়ের জন্য। এখন সেই জায়গায় এসেছে এসেনশিয়াল অয়েল ব্লেন্ড। যেখানে ল্যাভেন্ডার, রোজ বা জেসমিন তেল যুক্ত হয়ে তৈরি করছে প্রশান্তির এক আধুনিক সংস্করণ। ত্বকচর্চার জগতে এখন এমন সব উপাদান যোগ হয়েছে, যেগুলো একদিকে প্রাচীন, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক। যেমন লোবান, যা আগে ব্যবহৃত হতো আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়, এখন তা পাওয়া যায় আধুনিক হাই-এন্ড সেরামে। এসব উপাদান ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায়; মুছে দেয় বয়সের সূক্ষ্ম রেখা।
একইভাবে, প্রাচীন ভেষজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক ডিভাইস। আজকের কনে ঘরেই ব্যবহার করেন জেড রোলার, কাঁসা ওয়ান্ড, ফেস স্টিমার। এগুলোর লক্ষ্য অভিন্ন—ত্বকে রক্তসঞ্চালন এবং কোষে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনা। বলা যায়, পুরোনো রীতির আধুনিক অবয়বই এখন সৌন্দর্যের নতুন সংজ্ঞা লিখছে।
আজকের কনেরা জানেন, সৌন্দর্য কেবল সাজে নয়, যত্নেও বাড়ে। বিয়ের দিনের গ্লো আসে কিছু ছোট ছোট প্রস্তুতি থেকে; যেমন নিয়মিত স্কিন কেয়ার রুটিন, যথেষ্ট ঘুম, মানসিক প্রশান্তি আর নিজের প্রতি ভালোবাসা। হলুদের হলুদে, গোলাপজলের সুবাসে কিংবা স্যাফরন তেলের নরম আভায় তিনি যেন হয়ে ওঠেন রূপকথার কনে, যার ত্বকের আলোতে ম্লান হয়ে যায় বিয়ের হাজার রোশনাই। এ যেন এক আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি, যেখানে উপটানের ঘ্রাণ মিশে যায় সেরামের স্বচ্ছতায়, আর প্রাচীন রীতির ছোঁয়া পায় আধুনিক বিজ্ঞানের আলো। সেই আলোয় কনে হয়ে ওঠেন নিজস্ব যত্নে, নিজস্ব দীপ্তিতে একেবারে অনন্য।

 উম্মে হানী
মডেল: স্নিগ্ধা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সাহার রহমান কতুর
পারান্দা: তাসা
ছবি: জিয়া উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top