তনুরাগ I আশীর্বাদে অবগাহন
দূর অতীতে বিয়ের গোসল ছিল বর-কনের শরীর ও মন শুদ্ধির প্রতীক। ফুল, হলুদ ও দুধ মিশিয়ে গোসল করানো হতো; গানের সঙ্গে চলত উৎসব। সেখান থেকে আজকের ব্রাইডাল শাওয়ার। গোসলের পাশাপাশি শহুরে থিম, ফটো-ফ্রেন্ডলি সাজসজ্জা, আচারে নতুনত্ব। শুদ্ধি রীতির সঙ্গে আধুনিকতার সঙ্গত
বিয়ের গোসল, মঙ্গলস্নান, অথবা তেলাই—যে নামেই ডাকা হোক, এটি বাংলাদেশের বিয়ের আচার। বিয়ের ঠিক আগে, হবু বর ও হবু কনেকে গোসল করানোর প্রথা। প্রচলন আদিতে। বর-কনে উভয়ের জন্যই আয়োজনের চল রয়েছে। মূল কাজে যুক্ত থাকেন আত্মীয়স্বজন। ভাবি-বোনেরা মিলে আনন্দযজ্ঞ সম্পন্ন করেন শুভকামনায়। সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে যেন নতুন দম্পতির ঘর ভরে যায়।
সাধারণত গায়েহলুদের পরের দিন অথবা বিয়ের দিন সকালে এই আয়োজনের চল ছিল। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় পরিষ্কার পানির অভাব ছিল না। তাই দল বেঁধে এদিন কলস ভর্তি করে পানি আনা হতো। যাওয়া-আসার সময়টাতে গাওয়া হতো গান। নতুন জুটির বিবাহিত আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা অংশ নিতেন। পানিতে ফুল, দুধ, হলুদ, চন্দন বা গোলাপজল মিশিয়ে গোসল করানোর রেওয়াজ; যা একধরনের আনন্দ ও আশীর্বাদের পরিবেশ তৈরি করত। এখনো করে। এই গোসলের মাধ্যমে কনে যেন সব দুঃখ-কষ্ট, অশুভতা ধুয়ে ফেলে নতুন জীবনের পথে পা রাখেন, এই বিশ্বাসই মুখ্য।
বাংলার জলে পথে-প্রান্তরে
বিয়ে-পূর্ব গোসল ঘিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় আয়োজনের ভিন্নতা। যেমন পুরান ঢাকার বিয়েতে পাকা কথা অনুষ্ঠান শেষে হলদি বা তেলাই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এই অনুষ্ঠানে গোসলের আগে বর ও কনের গায়ে হলুদবাটা মাখানো হয়। আয়ুর্বেদিকভাবে বিশ্বাস করা হয়, হলুদ বর ও কনের ত্বক উজ্জ্বল করে। বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলার অনেক গ্রামে এটি এখনো এক উৎসবমুখর সামাজিক আচার। কনের বান্ধবীরা পুকুর বা কূপ থেকে পানি আনেন; তাতে মেশানো থাকে হলুদ, দুধ ও সুগন্ধি ফুল। ‘লীলাবালি লীলাবালি বর অযুবাতি সই গো’সহ নানা রকম বিয়ের গান মিশে থাকে পুরোটায়। এটি কেবল আনন্দ নয়; বরং নতুন সংসারে শুভকামনার এক শক্তিশালী প্রতীক। চট্টগ্রাম ও সিলেটে রীতি কিছুটা প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় প্রভাব মিশ্রিত। পাহাড়ি অঞ্চলে বাঁশের টবে গোসল, সিলেটে ব্যবহার করা হয় ফুল ভাসানো জল। এখানেও শরীর পরিষ্কার এবং মন পবিত্র করার ধারণা বজায় থাকে। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুরে এই রীতি দেখা যায়। সেখানে নাম মঙ্গলস্নান। ধান, দুধ ও হলুদের মিশ্রণে কনেকে স্নান করানো হয়, যা নতুন সংসারে সমৃদ্ধি ও সুখ কামনার প্রতীক। খুলনা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নারীরা একত্র হয়ে বাউল ও পালাগানের তাল মিলিয়ে কনের গোসল সম্পন্ন করেন। এটি শুধুই শরীরের নয়; মন ও হৃদয়ের শুদ্ধি, নতুন জীবনের আশীর্বাদ এবং সামাজিক মিলনের এক অনন্য মুহূর্ত।
বিয়ের গোসল কেবল শরীর পরিষ্কার করার রীতি নয়। এটি হলো বাংলার আঞ্চলিক সংস্কৃতির এক জলে ভেসে থাকা ছবি, যা আশীর্বাদ ও আনন্দের সঙ্গে নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করার প্রতীক। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি গ্রামের নারীর হাতে হাত মিলিয়ে এই উৎসবমুখর রীতি আজও জীবন্ত। বাংলাদেশে চল্লিশের বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির রীতি আলাদা হলেও কিছু মিলও পাওয়া যায়। অনেক নৃগোষ্ঠীতে তেল ও হলুদ মেখে বর-কনেকে গোসল করানো হয়। এর নাম ‘তেলাই’। তাদের বিশ্বাসমতে, এতে বর-কনে পবিত্র হন এবং অপদেবতার কুদৃষ্টি রোধ করা যায়। চাকমা, মগ, টিপরা, দালুই, সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশী প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীতে বিয়ের পর মঙ্গলঘট থেকে আমপাতা বা জামপাতা দিয়ে জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করার রেওয়াজ বিদ্যমান।
বর্তমান বয়ান
মানুষের জীবন এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক। তাতে নতুনের সঙ্গে পুরোনো মিশেছে। গায়েহলুদের আয়োজনের পরে বিয়ের গোসলের আয়োজন হয়। অনেক সময় তাতে সঙ্গত দেয় রং খেলা; উপস্থিত সবাই একে-অপরকে রাঙিয়ে দেন। কনের খোঁপায় কাঁচা ফুল থাকে। গান বাজানো হয় প্লেলিস্ট থেকে বেছে বেছে। বিয়ের গান, সানাই সেখানে প্রাধান্য পায়। বর ও কনের আসন রঙে রাঙানো হয়; সামনে সাজানো থাকে হলুদবাটা, মেথিবাটা, চন্দন, মেহেদি, মটকা বা কলসি। অনেক অনুষ্ঠানে দুধও রাখা হয়, যা পানি দিয়ে মিলিয়ে ঢালার রেওয়াজ। আরও মিশে থাকে গোলাপের পাপড়ি। অনেক কনের জন্য এসবের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় ব্রাইডাল শাওয়ার। পশ্চিমা প্রভাবিত এই রীতি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের শহুরে পরিবারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের নারীরা একত্র হয়ে কনের নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানান, উপহার দেন, খেলাধুলা ও মজার মুহূর্ত তৈরি করেন। কেক আর ‘ব্রাইড টু বি’ লেখা শ্যাস সেখানে মাস্ট!
প্রকৃতিপ্রাণিত
শহর হোক কিংবা গ্রাম—সবখানেই ব্যবহার করা হয় নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদান। সেসবের গুণ কনেকে সামনের দিনের জন্য প্রস্তুত করে। কাঁচা হলুদ ও মেথি ত্বকের জন্য অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল। হলুদ বাড়ায় ত্বকের উজ্জ্বলতা; মেথি ও চন্দন শরীর থেকে সুগন্ধ বের করে শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। গোসলের পানিতে আমপাতার ব্যবহার ইতিবাচক শক্তি আনে; নেতিবাচক শক্তি দূর করে। এটি সমৃদ্ধি, উর্বরতা এবং মন্দের ওপর ভালোর জয়ের প্রতীক। আমপাতায় থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যা বায়ুদূষণ কমাতে কাজে দেয়। গোলাপের পাপড়ি গোসলকে আনন্দময় ও প্রশান্তিদায়ক করে এবং ত্বকের জন্য উপকারী। এটি ঐতিহ্যবাহী রীতি হিসেবে বিয়ের আনন্দ ও পবিত্রতার প্রতীক।
আরফাতুন নাবিলা
মডেল: স্নিগ্ধা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সাফিয়া সাথী
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: জিয়া উদ্দীন
