দৃশ্যভাষ্য I অরণ্য আন্দোলনে
বন এমনই এক প্রাকৃতিক সম্পদ, যার ঋণ শোধরানো অসম্ভব। তবু নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব দাবি করা মানুষ নানাভাবে অরণ্য নিধনে ব্যস্ত। এ চিত্র দুনিয়াজুড়ে। আর তা প্রতিরোধের সংগ্রামী চিত্রও কম নয় অবশ্য
‘সহসায় নেমে পড়ে/ অরণ্যের গভীরতা/ ঘুম টুটে যায়/ চোখের সবুজ রাতে/ যত দূর দৃষ্টি যায়/ চিরহরিৎ… চিরহরিৎ…/ আশাবাদী রাতের চোখে/ বনানীর মুগ্ধতা/ পথ হেঁটে যায়/ সবুজ কার্পেটজুড়ে/ যত দূর দৃষ্টি যায়/ চিরহরিৎ… চিরহরিৎ…।’ কিংবদন্তি রকস্টার জেমসের উদাত্ত কণ্ঠে অরণ্যের বন্দনা, যা যেকোনো রক মিউজিকপ্রেমীকে মুহূর্তেই ঘোরগ্রস্ত করে তোলে, গহিন বনের আদিগন্ত অকৃত্রিম সৌন্দর্য ও সুগন্ধের ধ্যানমগ্ন পরিবেশে হারিয়ে যেতে বাধ্য করবে! এ গানের মতোই মন্ত্রমুগ্ধ আবহের দেখা মেলে এই আলোকচিত্রে। নাম না জানা বৃক্ষের চিরল পাতার আদর নিয়ে, হলুদ বুনোফুল হাতে দাঁড়িয়ে এক তরুণী। ফুলের মতোই হলুদ আভা তার মুখে। সঙ্গে যেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু—‘মোনালিসা’র অভিব্যক্তি! অথচ এই গভীর ধ্যানের নির্মল ও স্নিগ্ধ অনুভূতি ছড়ানো আলোকচিত্রটির নেপথ্য গল্প পাবলো পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’র মতো ধ্বংসযজ্ঞের বার্তা বয়ে বেড়ায়।
আলোকচিত্রের এই তরুণীর নাম ক্যাটা ও’ডোনেল। অস্ট্রেলিয়ান তিনি। নানা দোহাইয়ে চলা অরণ্য নিধনের বিরুদ্ধে এক লড়াকু যোদ্ধা। তার ভাষ্য, ‘অরণ্যের ভেতরই বেড়ে উঠেছি আমি। অরণ্যগুলোই ছিল আমার খেলার মাঠ, আমার শিক্ষক। জীবনকে এক সুতোয় গড়ে তোলার ও সামলে রাখার পাঠ অরণ্যই দিয়েছে আমাকে।’
এই ছবি ২০২১ সালের। খবর ছড়িয়ে পড়েছিল—অস্ট্রেলিয়ার দগ্ধ এরিনান্ড্রা মালভূমির কিনারায় থাকায় অদগ্ধ অরণ্যের একটি অংশকে বাছাই এবং জিপসল্যান্ড অঞ্চলের বেশ পূর্ব দিকের গুঙ্গেরার নিকটবর্তী ছোট্ট কমিউনিটিকে সতর্ক করা হয়েছে। গুঙ্গেরার অবস্থান মালভূমিটির কিনারায়। এই ‘সবুজ’ শহরের রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের এক দারুণ ইতিহাস। এখানকার বহু অধিবাসীই এখানে বসতি গড়েন ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে; রাজ্যটির ভেতর দিয়ে চলাচলের জন্য দ্রুতগামী ট্রেনের রেলপথ নির্মাণ আটকে দিতে। তাদের কল্যাণেই রেললাইন স্থাপনের কাজ এগোতে পারেনি।
এবার সেখানে ক্যাটা ও’ডোনেলসহ আরও বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছেন তেরপল ও ব্যানারের নিচে; আরেকটি অবরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে তারা যখন বহুকাল ধরে লড়াই করে বাঁচিয়ে রাখা বেশ পুরোনো অরণ্যগুলোকে পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হতে দেখেন, ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন। তখনো টিকে থাকা সবুজের অবশিষ্টাংশকে কাঠ কাটার করাতের দাঁত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই আবার ফিরে এসেছেন এখানে। এই লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার পেছনে ক্যাটার মতোই তাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ কারণ; তবে সবার লক্ষ্য অভিন্ন—অরণ্য বাঁচানো।
তাদের এই লড়াই ঘিরে বেশ কিছু ছবিসংবলিত একটি বিশেষ আলোকচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশ পায় ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ; ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ। ‘লাস্ট অব দ্য লার্জ ট্রিজ: আ ডে অ্যাট দ্য এরিনান্ড্রা ফরেস্ট ব্লকেড’ শিরোনামের সেই রচনার প্রতিবেদক কিংবা ছবিগুলোর আলোকচিত্রীর নাম অবশ্য ছাপা হয়নি। ফলে ওই সিরিজের অংশ, আলোচ্য তথা ক্যাটার ছবিটির আলোকচিত্রীর নামও অজানা আমাদের। তবু আলোকচিত্রটি এবং ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সেই লড়াইয়ের বিশদ জানার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা যাক!
ওখানে দেখা মিলেছিল ওই লড়াইকারীদের একজন—হেইলি সেস্টোকাসের। ২৭ বছর বয়সী এই তরুণী পেশায় ছিলেন শেফ। কাজ করতেন ব্রিসবেনে। অরণ্যরক্ষার আন্দোলনে যোগ দিতে সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, নিজ গাড়িতে মালপত্র ভরে, লার্ড ফরেস্ট মাউলস ক্রিক ব্লকেডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন ২০১৪ সালের মার্চে। ‘পুরোটাই ছিল অনিশ্চয়তার পানে ছুটে যাওয়ার ব্যাপার। নিজের ভেতর দায়ভারের এক গভীর অনুভূতি অনুভব করেছিলাম। আমার ভবিষ্যতের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য অঙ্গীকার করেছিলাম; এখানকার ক্রমাগত খারাপ হতে থাকা পরিস্থিতিকে থামানোর জন্য নিজের সর্বাত্মক শক্তি নিযুক্ত করেছিলাম।’ তিনি এখন অসংখ্য অরণ্যরক্ষার আন্দোলনকারীর একজন পরীক্ষিত যোদ্ধা; প্রতিটি অবরোধেই শিশুপুত্র মালেলুকাকে নিয়ে আসেন সঙ্গে। ‘কী ঘটছে—তা যেন নিজে উপলব্ধি করতে পারে, সেভাবেই ছেলেকে বড় করছি,’ বললেন তিনি। ‘ভবিষ্যতে যা ঘটতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে যেন সে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, এমন শিক্ষাই তাকে দিতে চাই; কেননা, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সত্যি শঙ্কিত।’
অন্যদিকে, ২৩ বছর বয়সী ইন্ডিগো ইয়র্কের প্রাথমিক শৈশবের বহু স্মৃতিই এ রকম: তার বাবা যখন অরণ্য অবরোধের সময়ে বেতার সংযোগ ঠিকঠাক করতেন, তখন গুঙ্গেরার ঝোপঝাড়ের নিচে, গাড়ির পেছনের আসনে ঘুমিয়ে থাকতেন সে সময়কার সেই ছোট্ট ইন্ডিগো। ‘আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলোজুড়ে জায়গা করে ছিল অবরোধ। কমিউনিটি এবং তৃণমূলভিত্তিক পরিবর্তন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই সম্পর্কে একটি সত্যিকারের উপলব্ধি এর মাধ্যমে পাওয়া যায় বলে মনে করি,’ বলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে এই তরুণী তখন তথা ২০২১ সালে মেলবোর্নের মনাশ ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে স্নাতকের শেষ বর্ষে পড়তেন। এ বিষয়ে পড়াশোনার কারণ ছিল অবরোধগুলোর পক্ষে লড়াই করা এবং আদালতের মাধ্যমে অরণ্যগুলোকে সুরক্ষা দিতে পারা। তার ভাষ্য, ‘এখানে বেড়ে ওঠার কারণে আমার মনে পড়ে মালভূমিটিতে হেঁটে বেড়ানোর স্মৃতি; আমি জানি, কী চমৎকার পরিবেশ এটি। এখানকার লিয়ারবার্ড (বিরল পাখিবিশেষ), পসাম (ইঁদুর ও বিড়ালের সংমিশ্রণের মতো দেখতে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীবিশেষ), পুষ্পশোভিত উদ্ভিদকুল, প্রাণীগুলোর অভিজ্ঞতা অন্যরাও যেন পায়, এমনটাই চাওয়া আমার। অথচ যেভাবে বন উজাড় ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, তাতে অন্যরা হয়তো এমন অভিজ্ঞতা কখনোই পাবে না, যা কিনা লজ্জার ব্যাপার,’ অভিমত তার। আরও বললেন, ‘দাবানল ও দখলদারির কারণে বহু প্রজাতি কোনো দিনই ফিরবে না আর; যেমন আগেকার সময়ে রাতে যে প্যাঁচার দেখা পেতাম আমরা। এই প্রাণীগুলোর আবাসস্থল সেই সব গহ্বর, যেগুলো শুধুই বয়স্ক গাছগুলোতে থাকে। উপযুক্ত অরণ্য প্রতিনিয়ত কমেই যাচ্ছে; আর, কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে সেগুলোও যদি বিনাশ বা দখল করা হয়, তা তো খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার।’
আরও দেখা মিলল ইস্ট জিপসল্যান্ড অরণ্যে এক দশকের অধিককাল অবরোধ করে কাটিয়ে দেওয়া অ্যানিটা ডেভিসের। ‘আমরা নিশ্চিতভাবেই একটি পার্থক্য গড়ে দিতে পেরেছি। এরিনান্ড্রা, গুলেনগুক ও স্নোয়ি অরণ্যকে যতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি, অবরোধ না করলে তা সম্ভব হতো না,’ বলেন তিনি। ‘আমার জীবনের বিশের কোঠার পুরোটা এবং চলমান ত্রিশের কোঠার অর্ধেককাল ধরে আমি এসব অরণ্যকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। এখন দেখতে পাচ্ছি, বহু অরণ্য এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে, যা ভীষণ মর্মাহত করে আমাকে,’ যোগ করেন অ্যানিটা। আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে ভিক্টোরিয়া রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কুয়ার্ক অরণ্য রক্ষার এক্সটেনশন আমরা মাত্রই জয় করেছিলাম; কিন্তু এখন সেই অরণ্য অতীত। এমন হারানোর ক্ষত ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। যতটুকু অরণ্য হারিয়েছি, তা ভাবতে গেলে মুষড়ে পড়ি আমি। আমার হয়তো কষ্ট পাওয়া উচিত নয়; তবু বেদনায় নীল হয়ে যাই। যেমন ধরুন, ইস্ট জিসপল্যান্ডের অরণ্যের ৮০ শতাংশই হারিয়ে গেছে এবং এর জাতীয় উদ্যান অরণ্যগুলোর ৫০ শতাংশের অস্তিত্ব নেই আর। তবু অরণ্য বিনাশ থেমে নেই। আমাদের এই অরণ্য রক্ষার অবরোধ এখন শুধুই ভীষণ পুরোনো অরণ্যগুলোর ক্ষেত্রে ঘটছে না; বরং আমরা অবশিষ্ট যেকোনো অরণ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।’
ওয়েন হ্যানসনের বয়স যখন ৮ বছর, ভিক্টোরিয়ায় নিজেদের মার্টিন ক্রিক সম্পত্তির জলাধার থেকে জীবনের প্রথম ক্রেফিশ ধরেছিলেন তিনি। সেদিন নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হয়নি! ওই চমৎকার সৃষ্টিকে তিনি জলাধারে আবার ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছাড়া পেতেই তার পায়ের ফাঁক গলে সেটি দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল। ‘আমরা লবস্টার পেয়েছিলাম,’ আনন্দে চিৎকার করে স্মৃতিচারণা করেছিলেন ওয়েন। ক্রেফিশ ও লবস্টার চিংড়ি গোত্রের হলেও এ দুটির মধ্যে পার্থক্য সেই বয়সে জানা ছিল না তার। জানতেন না, সেই সময়ের দেড় দশক পেরিয়ে এসে, আজকের দিনেও সেগুলোকে রক্ষার জন্য তাকে লড়াই করে যেতে হবে।
২০০৯ সালে কাঠ কাটার শ্রমিকেরা গুঙ্গেরায় ওয়েনের পারিবারের সম্পত্তি ও জলাধার-সংলগ্ন অরণ্যটির বেশির ভাগ অংশই সাফ করে ফেলেন। ‘বনায়নের সূক্ষ্মতার বিরুদ্ধে এ ছিল এক নারকীয় সূচনাপর্ব,’ বলেন তিনি। ‘আমাদের আঙিনার পেছনের দিকে যা ছিল চমৎকার এক অরণ্য, সেটিকে তারা ন্যাড়ামাথা বানিয়ে দিয়েছিলেন। এর পাঁচ বছর পর, ২০১৪ সালে একটি এবং এরপর ২০২০ সালে আরেকটি দাবানলের ধোঁয়ায় হারিয়ে যায় বাকি সব গাছ।’ এখন তাদের আঙিনার পেছনের দিকটিকে নেহাতই একটি পতিত ভূমি মনে হয়, জানালেন তিনি। ‘সেই সব সবুজের মেলা দূর অতীত এখন। চাইলেও একে অরণ্যের রূপে ফেরানো যাবে না কখনো।’
শৈশবে টেলিভিশনে লোকজনকে অরণ্য রক্ষার আন্দোলন করতে দেখার স্মৃতিচারণা করলেন টিফানি ট্যারেন্ট। ‘মাকে তখনই বলে দিয়েছিলাম, বড় হয়ে আমিও ওই দলে যোগ দেব,’ বলেন তিনি। ভিক্টোরিয়ার কুয়ার্ক অরণ্যের গহিনে একটি সিটিজেন সায়েন্স ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার পর তার জানা হয়ে গিয়েছিল, তাকে অবশ্যই ইস্ট জিপসল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা শুরু করতে হবে। একজন স্বঘোষিত ‘উদ্ভিদ-উন্মাদ’ হিসেবে বড় বড় গাছের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া, বৃক্ষগুলোর অতুল সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলা এবং অস্তিত্বের হুমকিতে পড়া প্রজাতিগুলোর অনুসন্ধান চালানো মধ্যবয়সী এই নারীর ভীষণ প্রিয় কাজ। ‘অরণ্যটি সত্যি কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে,’ বলেন তিনি। ‘বয়স্ক গাছগুলোর টিকে থাকার সক্ষমতা ৩০ বছর আগে গজানো বৃক্ষের চেয়ে ঢের বেশি; নবীন বৃক্ষগুলো এখনো ভীষণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। বারবার দাবানল আর নিধনে পড়ায় অল্প বয়সী গাছগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন।’ তার আশা, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও মালভূমিটি বেঁচে যাবে। বলেন, ‘যদি কোনো বৃক্ষই আর এখানে না থাকে, তাহলে এই মালভূমির কাছে আসতে আমি একদমই চাইব না। উপনিবেশের আগে এখানকার পরিবেশ কেমন ছিল, তার প্রতিনিধিত্ব করে এই অরণ্য। অথচ এখন আমরা এটির শেষ বড় গাছগুলোর দেখা পাচ্ছি, যা বেশ বেদনার।’
লাইফস্টাইল ডেস্ক
