মনোযতন I হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটি
বাইরের চোখে সফল আর নিখুঁত মনে হলেও ভেতরে তীব্র উৎকণ্ঠা ও চাপ লুকিয়ে রাখার এক মারাত্মক হানিকর মানসিক অবস্থা। তা চিহ্নিত করার এবং সমাধান খোঁজার প্রয়াস চালানো জরুরি
ভিড়ভাট্টার এই শহরে প্রতিদিন দেখা যায় স্মার্ট পোশাক, নির্ভুল ভাষা, আত্মবিশ্বাসী হাঁটা আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রাণবন্ত হাসির কিছু মানুষ। কিন্তু গল্পটা এখানে শেষ নয়। কারণ, এই সযত্নে আঁকা ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অদৃশ্য টানাপোড়েন, যা চোখে পড়ে না, শোনা যায় না, তবু প্রতিনিয়ত তাদের ভেতরটা ক্ষয়ে দেয়। এ এমন এক দ্বৈততা, যেখানে বাইরে থেকে সবকিছু নিখুঁত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে চলে তীব্র এক সংগ্রাম। এই দ্বৈততায় সবচেয়ে বেশি আটকে আছে আজকের তরুণ প্রজন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের চাপ, সামাজিক প্রতিযোগিতা, অনলাইন উপস্থিতি ধরে রাখার দায়—সব মিলিয়ে তারা নিজেদের পরিপূর্ণতার খোলসে আটকে রাখেন। চারপাশে কেউ হয়তো ভাবে, এই ছেলে বা মেয়েটি জীবনযুদ্ধে জয়ী মানুষ; অথচ তিনি হয়তো রাতভর ঘুমাতে পারেন না, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় অকারণে কিংবা মনের ভেতরে অদৃশ্য আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়। এ এক অদৃশ্য যন্ত্রণা, যা দেখা যায় না; কিন্তু টের পাওয়া যায় ভেতরের নিঃশব্দ আর্তনাদে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এটিই হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটি। এমন এক ধরনের উদ্বেগ, যেখানে ভেতরে তীব্র অস্থিরতা কাজ করলেও ব্যক্তিকে বাইরে থেকে অতি-কার্যক্ষম, নিয়ন্ত্রিত ও সফল দেখায়। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিকেশনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অবস্থায় ভুক্তভোগীরা সচরাচর সাহায্য চান না; কারণ, নিজেরাই বিশ্বাস করেন, ‘আমি তো ঠিক আছি।’ আর এখানেই তৈরি হয় ভয়ংকর ফাঁদ—অসুস্থ মানসিক অবস্থাকেও স্বাভাবিক ভেবে নেওয়া।
নীরব উদ্বেগ
উদ্বেগ শব্দটি অতি চেনা। পরীক্ষা, চাকরির ইন্টারভিউ কিংবা জীবনের অনিশ্চিত মুহূর্তে উৎকণ্ঠা ধরা দেয় স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটি একটু অন্য রকম। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে ভেতরে ভয়, সংশয় আর অস্থিরতা তীব্রভাবে কাজ করে; অথচ বাইরে থেকে মানুষটিকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
সাধারণ উদ্বেগব্যাধির রোগীরা অনেক সময় কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। পড়াশোনা, চাকরি কিংবা সম্পর্ক—সবকিছুতেই ভাটা পড়ে। কিন্তু হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত তরুণেরা ঠিক উল্টো চিত্র উপস্থাপন করেন। তারা সময়মতো কাজ করেন, লক্ষ্যপূরণে বাড়তি শ্রম দেন, এমনকি অনেকে চারপাশের সবার কাছে আদর্শ হিসেবেও গণ্য হন। অথচ এই বাড়তি পারফরম্যান্সই তাদের অন্তর্গত ভয়ের বহিঃপ্রকাশ—ব্যর্থ হওয়ার আতঙ্ক তাদেরকে সব সময় নিখুঁত হওয়ার দৌড়ে ঠেলে দেয়।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটিতে ভোগেন, তাদের মাঝে পারফেকশনিজম বা পরিপূর্ণতার চাপ বেশি কাজ করে। এই চাপ আবার ঘুমের ব্যাঘাত, হজমের সমস্যা কিংবা অবিরাম ক্লান্তির মতো শারীরিক লক্ষণ তৈরি করে। বাইরে থেকে সবকিছু সামলানো গেলেও ভেতরে তৈরি হয় নীরব ক্লান্তি ও অবসাদ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও জটিল। তরুণেরা সামাজিক ও পারিবারিক প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে নিজেদের অস্থিরতা প্রকাশ করেন না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হয়তো সব ক্লাসে প্রথম সারিতে থাকেন, সামাজিক মাধ্যমে থাকেন সক্রিয়, আবার সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও অংশ নেন। কিন্তু একা হলে তার বুক ধড়ফড় করে কিংবা নিদ্রাহীনতা তাকে কাবু করে রাখে।
নিখুঁতের ফাঁদ
হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো, এটি বাইরে থেকে বোঝা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যিনি এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যান, তার জীবনের প্রতিটি দিন আসলে নিখুঁতের ফাঁদে আটকে থাকার মতো। সবকিছু নিখুঁত করতে চাওয়ার প্রবণতা তাকে অবিরাম চাপে রাখে।
তরুণদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অতি-সতর্কতা। পরীক্ষার পড়া হোক কিংবা অফিসের প্রেজেন্টেশন—তারা শতভাগ প্রস্তুতি না নিয়ে শান্তি পান না। ভুল হওয়ার শঙ্কা যেন তাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। ফলে প্রতিটি কাজ করতে গিয়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করেন নিখুঁতের খোঁজে।
ব্যর্থতার ভয়ও এই অবস্থার একটি বড় চিহ্ন। যারা হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটিতে ভোগেন, তাদের কাছে ব্যর্থতা মানে শুধু একটি সুযোগ হারানো নয়; বরং আত্মসম্মান ভেঙে পড়া। ফলে তারা বাড়তি কাজ করেন, অতিরিক্ত দায়িত্ব নেন, এমনকি নিজের স্বস্তি বিসর্জন দিয়ে হলেও সফলতার ছবি আঁকার চেষ্টা চালান।
শুধু মানসিক নয়, এর রয়েছে শারীরিক লক্ষণও। ভেতরের অস্থিরতায় বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, পেশিতে টান কিংবা অকারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়। রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়; আবার ঘুমালেও অস্থির স্বপ্নে ভরা রাত কাটে। দিনে বাইরে হাসিমুখে চলাফেরা করলেও শরীর ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক তরুণ-তরুণী, যারা সব সময় ভালো ফল করেন, নানা অ্যাকটিভিটিতে সক্রিয় থাকেন, তারা আসলে ভেতরে হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির চাপে জর্জরিত। তাদের চারপাশের মানুষ হয়তো ভাবে, ‘কী দারুণ ব্যালেন্স করে সবকিছু!’ অথচ সত্য হলো, তাদের মস্তিষ্ক যেন অবিরাম সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে।
সাফল্যের মুখোশ
আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের জায়গাটি এখনো গোপন আলোচনার বিষয়। ‘সব ঠিক আছে’ ভাব বজায় রাখাটা যেন সামাজিক শিষ্টাচারের অংশ। বাংলাদেশি তরুণদের জীবনে এই চাপ বহুস্তরীয়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ পর্যন্ত সবাই তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কিছু প্রত্যাশা করে—ভালো রেজাল্ট, সম্মানজনক চাকরি, আর্থিক সচ্ছলতা। অনেক সময় এই প্রত্যাশা ব্যক্তিগত পছন্দ বা মানসিক স্বস্তিকে ছাপিয়ে যায়। ফলে তরুণেরা নিজেদের ভেতরের উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করে বরং আরও নিখুঁত হয়ে ওঠার চেষ্টা চালান।
দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার জায়গা সীমিত। এখানে ব্যর্থতা মানেই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত পিছিয়ে পড়া নয়; বরং সামাজিক মর্যাদা হারানোর মতো ব্যাপার। ফলে তরুণেরা নিজেদের ভেতরের সংগ্রাম লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এই প্রেক্ষাপটে বড় ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিন ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে নিখুঁত জীবনযাপনের ছবি দেখে তরুণেরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে আরও চাপ অনুভব করেন। একদিকে তারা নিজেদের ভেতরে অস্থিরতা লুকিয়ে রাখেন, অন্যদিকে বাইরের দুনিয়ায় নিখুঁতের মুখোশ পরে হাঁটেন।
নীরব অস্বীকার
হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির সবচেয়ে জটিল দিক হলো, এটি সহজে অস্বীকার করা যায়। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে এখনো যে ট্যাবু কাজ করে, সেটাও বড় কারণ। বিষণ্নতা বা উদ্বেগকে আমরা অনেক সময় আলসেমি বা দুর্বলতা হিসেবে দেখি। ফলে তরুণেরা মনে করেন, যদি তারা নিজেদের উদ্বেগের প্রকাশ ঘটান, তবে অন্যরা হয়তো ভুল বিচার করবে। পরিবার, সহপাঠী কিংবা সহকর্মীদের কাছে তারা অক্ষম বিবেচিত হওয়ার ভয়ে চুপ থাকেন।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিংয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌহিদা ফেরদৌসী বলেন, ‘এই চুপ থাকার প্রবণতা আসলে একধরনের সাইলেন্ট ডেনিয়াল; নিজের ভেতরের কণ্ঠকে নিজেই উপেক্ষা করা। অনেক তরুণ মনে করেন, “আমি যেহেতু কাজ করতে পারছি, সফল হচ্ছি, তাহলে সমস্যা কোথায়?” এই ভুল ধারণাই তাদেরকে সাহায্য চাইতে দীর্ঘ সময় ধরে বাধা দেয়।’ এই বিশেষজ্ঞের মতে, যত দেরি করে সাহায্য নেওয়া হয়, সমস্যাটি তত গভীরে শিকড় গেড়ে বসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু সাহায্য চাইতে অনীহা ও সামাজিক কলঙ্কের কারণে অধিকাংশই চুপচাপ লড়াই করে যান। ফলে তাদের গল্প চাপা পড়ে যায় সাফল্যের ঝলমলে আচ্ছাদনের আড়ালে।
ভেতরের মানচিত্র
হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির যে জটিলতা আছে, তা সহজভাবে বোঝা যায় না। তৌহিদা ফেরদৌসীর মতে, এই পরিস্থিতি একেবারেই বহুমাত্রিক—বংশগতি, পরিবেশ, ট্রমা ও কর্মক্ষেত্রের চাপ—সবই একসঙ্গে প্রভাব ফেলে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পারফেকশনিজম, অতিরিক্ত দায়িত্ব নেওয়া এবং সামাজিক প্রত্যাশার চাপ মিলিয়ে তরুণদের মধ্যে হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটি ক্রমবর্ধমান। এই চাপ কখনো কখনো শারীরিকভাবে ধূম্রজালের মতো কাজ করে—হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা, পেশিতে টান অনুভব—সবই ভেতরের মানচিত্রের সংকেত।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, সাহায্য চাইতে অনীহা এই রোগের প্রকট দিক। ফলে আক্রান্তরা হরদমই থেরাপি বা কাউন্সেলিং থেকে দূরে থাকেন। তবে যারা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন, তারা অভ্যন্তরীণ চাপ মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি লাভ করেন। সাইকোথেরাপি, সিবিটিসহ মাইন্ডফুলনেস বা মেডিটেশন প্রমাণিতভাবে উদ্বেগ কমায়।
চিকিৎসা বা কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব কেবল মানসিক স্বস্তির জন্য নয়; বরং দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। দীর্ঘ সময় ধরে হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটিতে ভুগলে হৃৎপিণ্ডের অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ, হজমের সমস্যা বা ক্রনিক ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেন, এই অবস্থাকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়।
ভাঙা তালের ছন্দ
হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির প্রভাব শুধু মানসিক অস্থিরতায় সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি প্রতিদিনের জীবনধারায়ও ছাপ ফেলে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তরুণেরা প্রিয়জনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেন; কারণ, তারা ভেতরের উৎকণ্ঠা প্রকাশে ভয় পান। বন্ধুত্ব, প্রেম কিংবা পরিবারিক জীবন—সব ক্ষেত্রে তারা মুখোশ ধরে রাখেন, যাতে কেউ বোঝে না ভেতরে কী চলছে।
কর্মজীবনেও এই চাপ একই রকম। ভেতরের উদ্বেগের কারণে তারা অতিরিক্ত দায়িত্ব নেন, বাড়তি শ্রম দেন এবং নিজের সীমা অতিক্রম করেন। দীর্ঘ সময় ধরে এই ধারাবাহিক চাপ তৈরি হলে শারীরিক ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা ও বার্নআউটের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্নআউট শুধু ক্লান্তি নয়; এটি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কর্মদক্ষতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রেও হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির প্রভাব দেখা যায়। আক্রান্তজন নিজের কাজকে নিখুঁত করতে গিয়ে নতুন ধারণা বা ঝুঁকি গ্রহণে দ্বিধায় ভোগেন। ফলে সম্ভাব্য উদ্ভাবনী আইডিয়াগুলোও চাপের বোঝায় গুটিয়ে যায়। একদিকে তাকে কার্যক্ষম মনে হয়, অন্যদিকে তার সৃজনশীল আত্মপরিচয় ক্ষুণ্ন হয়।
শান্তির খোঁজ
হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির সঙ্গে লড়াই মানে শুধু সমস্যা চিহ্নিত করা নয়; বরং তা কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা করাও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌহিদা ফেরদৌসীর মতে, থেরাপি যেমন কগনিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি (সিবিটি) বা মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস তরুণদের ভেতরের অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করে। সিবিটি শেখায়, কীভাবে নেতিবাচক চিন্তাকে চিহ্নিত করে তা বদলানো সম্ভব; আর মাইন্ডফুলনেস শেখায় উপস্থিতি ও মনোযোগ ধরে রাখার কৌশল। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত থেরাপিতে অংশ নেন, তারা ভেতরের উৎকণ্ঠাকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন।
তবে থেরাপি ছাড়াও জীবনধারার পরিবর্তন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ঘুম, ব্যায়াম এবং সময় ব্যবস্থাপনা—সব মিলিয়ে ভেতরের চাপ কমাতে সাহায্য করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন আধঘণ্টার ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করলে উদ্বেগের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তরুণদের জন্য এটি বিশেষভাবে কার্যকর; কারণ, তাদের কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাপ অনেক বেশি।
সেলফ-কেয়ার অভ্যাসও হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটি মোকাবিলায় অপরিহার্য। ছোট ছোট রুটিন; যেমন মেডিটেশন, নিজের জন্য সময় বের করা, শখ অনুসরণ ইত্যাদি মনে শান্তি তৈরি করে। তৌহিদা ফেরদৌসী বলেন, ‘সেলফ-কেয়ার মানে কেবল আরাম নয়; বরং নিজেকে বোঝা এবং নিজের সীমা মানার দক্ষতা।’
তরুণেরা যারা এই কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করেন, তারা দেখতে পান, ভেতরের উৎকণ্ঠা নিয়ন্ত্রণে আসে। মুখোশের নিচে থাকা চাপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং বাইরে থেকে দেখা আত্মবিশ্বাস আরও শক্ত হয়।
আলোছায়ার পথে
হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটির সবচেয়ে জটিল দিক হলো, এটি চোখে পড়ে না; কিন্তু প্রতিদিনের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সমাধানের প্রথম ধাপ হলো এই অদৃশ্য লড়াইকে দৃশ্যমান করা। যখন তরুণেরা নিজেদের ভেতরের উদ্বেগ স্বীকার করতে পারেন, তখনই তারা সাহায্য নেওয়ার পথে পা বাড়ানোর সাহস পান। মনোবিজ্ঞানীদের মতো, মানসিক চাপ কমাতে এই স্বীকৃতি সবচেয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ।
সহমর্মিতা ও সচেতনতা তৈরি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী; যারা আক্রান্তজনের চারপাশে থাকেন, তাদের ভূমিকা বড়। বোঝাপড়া, সমর্থন এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা তার ভেতরের চাপ কমাতে সাহায্য করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা পরিবার ও বন্ধুর সহযোগিতা পান, তারা দ্রুত থেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন।
এই আলোছায়ার পথে হাঁটা মানে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করা। ভেতরের অস্থিরতা ও বাইরে সাফল্যের মুখোশ—দুটোকে সমানভাবে বোঝার চেষ্টা করলে আক্রান্তজনেরা ধীরে ধীরে মানসিক স্বস্তি অর্জন করতে পারেন। সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো এবং সহমর্মিতা প্রচার করা এই প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে। ফলে হাই-ফাংশনিং অ্যাংজাইটি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি সামাজিক সচেতনতারও আহ্বান।
সুবর্ণা মেহজাবীন
ছবি: ইন্টারনেট
