skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I ক্যালরি ব্যালেন্স

সুস্থ জীবনের জন্য ক্যালরির প্রয়োজনীয়তা অসীম। অধিক কিংবা কম—উভয় মাত্রাই ডেকে আনতে পারে বিপদ। ভারসাম্য এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। পরামর্শ দিচ্ছেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মূল ভিত্তি প্রতিদিনের ক্যালরি গ্রহণ ও ব্যয়ের সঠিক ভারসাম্য। আমরা যা খাই, প্রতিটি খাবারই দেহে কোনো না কোনো পরিমাণে ক্যালরি সরবরাহ করে। এই ক্যালরিই আমাদের শরীরে এনার্জি দেয়; অ্যাকটিভ থাকতে সাহায্য করে। মেটাবলিক প্রক্রিয়াকে সচল রাখতেও পর্যাপ্ত ক্যালরির প্রয়োজন। কিন্তু ক্যালরি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি হয়, তাহলে শরীরে দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা; যেমন ওজন বৃদ্ধি বা ওবেসিটি, অপুষ্টি, হরমোনজনিত ইমব্যালেন্স, এমনকি ক্রনিক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি ইত্যাদি। তাই শুধু খাবার গ্রহণই যথেষ্ট নয়; সারা দিনে কে কতটুকু খাবার খাচ্ছেন, তার কোয়ানটিটি ও কোয়ালিটি মেজার করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
হিসাব-নিকাষ
সুস্থ শরীরের জন্য ক্যালরি ব্যালেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শরীর প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ব্যয় করে থাকে। এই শক্তি ব্যয়ের উৎস রয়েছে কয়েকটি।
বেসাল মেটাবলিক রেট (বিএমআর)
শরীর যখন পুরোপুরি বিশ্রামে থাকে, তখনো যে ক্যালরি খরচ হয়, সেটিই বিএমআর। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হরমোন উৎপাদন—সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে এটি সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে বিএমআর কমে গেলে ওজন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
লেভেল অব অ্যাকটিভিটি
চলাফেরা, রান্নাবান্না, কাজ করা, অফিসে হাঁটা, বাজারে যাওয়া—এসব স্বাভাবিক নড়াচড়া থেকে দিনে ক্যালরি খরচ হয়। একে বলে নন এক্সারসাইজ অ্যাকভিটি থার্মো জেনেসিস বা সংক্ষেপে এনইএটি। সে ক্ষেত্রে আমরা কী করি, আমাদের প্রফেশন কী ইত্যাদির ওপর মান নির্ধারণ করা হয়; অর্থাৎ কেউ সেকেন্ডারি লাইফ স্টাইল, কেউ হেভি অ্যাকটিভ অথবা কেউ মডারেট অ্যাকটিভ কি না, তা পরিমাপ করা হয়, যার ভিত্তিতে সারা দিন কত পরিমাণ ক্যালরি খরচ হয়, তা পরিমাপ করা যায়।
শারীরিক ব্যায়াম
জগিং, ওয়াকিং, জিম, ইয়োগা, সাঁতার—সব কটিই গুড এক্সারসাইজ। এগুলো অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরাতে সাহায্য করে। যাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, তাদের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম ক্যালরি ব্যালেন্স তৈরি করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
হরমোন ও এনজাইম কার্যক্রম
হরমোনের ভারসাম্য ঠিক থাকলে দেহ সঠিকভাবে ক্যালরি বার্ন করতে সক্ষম হয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক:
 থাইরয়েড হরমোন আমাদের দেহে মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে;
 গ্লুকোজের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিন নামক হরমোন কাজ করে;
 কর্টিসল হরমোনের জন্য স্ট্রেস বাড়লে বাড়ে ফ্যাট স্টোরেজ;
 লেপটিন ও গ্রেলিন নামক হরমোন ক্ষুধা-তৃপ্তি নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রকৃত অর্থে, হরমোনের কোনো বিঘ্ন হলে ক্যালরি খরচ কমে যায়, ক্ষুধা বাড়ে, ফ্যাট জমে; ফলে ক্যালরি ব্যালেন্স নষ্ট হয়।
এসব মিলিয়ে মোট যে ক্যালরি প্রয়োজন হয়, সেটিই টোটাল ডেইলি এনার্জি এক্সপেন্ডিচার (টিডিইই)। খাদ্য থেকে যে ক্যালরি আসে, তা যদি টিডিইইর চেয়ে বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে দেখা দেয় ওবেসিটি। আর খাদ্য গ্রহণের পর ক্যালরি টিডিইইর চেয়ে কম হলে ওজন কমে যায়; ফলে দেখা দেয় দুর্বলতা ও পুষ্টিহীনতা।
সত্যি বলতে, ক্যালরির ভারসাম্য মানে শুধু কম খাওয়া নয়; বরং পরিমাণ ঠিক রেখে, ব্যালেন্স করে খাবার গ্রহণ করা। এর পুরোটাই নির্ভর করে একজন ব্যক্তির বয়স, রোগ, কাজ, শরীরের গঠন ও হরমোনগত অবস্থার ওপর।
ভারসাম্যহীনতার বিপদ ও পরিত্রাণের উপায়
হঠাৎ খুব কম ক্যালরি গ্রহণ করলে নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে; যেমন শারীরিক দুর্বলতা, ব্যাপকভাবে চুল পড়ে যাওয়া, বিপাক শক্তি হ্রাস, পেশি ক্ষয়, নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ঋতুস্রাব ইত্যাদি। বিভিন্ন রোগভেদে ক্যালরি বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করতে হয় বলে তা ব্যালেন্সেও থাকে ভিন্নতা।
স্থূলতাব্যাধি
অনিয়ন্ত্রিত ক্যালরি গ্রহণ; নিষ্ক্রিয় বা অলস জীবনযাপন; উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি, মিষ্টি, ফাস্ট ফুড গ্রহণ আজকাল আমাদের দেশের খাদ্যতালিকায় বেশ সম্পৃক্ত। সে ক্ষেত্রে ক্যালরি কন্ট্রোল খুব কঠিন হয়ে পড়ে; আর বেড়ে যাচ্ছে ওবেসিটির হার। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি বেশ শঙ্কাজনক। এ ছাড়া মানসিক চাপের কারণেও অনেকের ইটিং ডিজঅর্ডার তৈরি হয়। খেয়াল রাখা চাই, স্থূলতা এক দিনে তৈরি হয় না। অল্প অল্প করেই বাড়তি ক্যালরিগুলো জমে একসময় তৈরি হয় স্থূলকায় দেহ। তাই ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন থাকা চাই ৩০০ থেকে ৫০০ ক্যালরির স্মার্ট ডেফিসিট। এতে পেশি ক্ষয় কিংবা মেটাবলিজম স্লো হয় না এবং ওজন ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে কমে। এ ক্ষেত্রে ক্যালরি ব্যালেন্সের সহজ কিছু কৌশল জানা থাকলে উপকার মিলতে পারে:
 বাড়তি ক্যালরি গ্রহণ করতে না চাইলে খাদ্যতালিকা থেকে রিফাইন সুগার বাদ দেওয়া চাই।
 প্রসেসড ফুড যেমন ফ্যাট, তেমনি ক্যালরি বহন করে; তাই এ ধরনের খাবার পরিহার করাই মঙ্গল।
 ক্যালরি কমাতে একটু বেশি ফাইবার রাখা চাই প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়।
 প্রোটিনের ক্ষেত্রে রাখা চাই লীন প্রোটিন; অর্থাৎ কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার।
 ফ্যাট থেকে ক্যালরি আসে সবচেয়ে বেশি, তাই ফ্যাট রাখা চাই যথাসম্ভব কম; আর যতটুকুই রাখা হোক না কেন, তা হওয়া চাই স্বাস্থ্যকর ফ্যাট।
 এক বেলায় অনেক পরিমাণ খাবার না গ্রহণ করে, দিনে ৪ থেকে ৫ বার ভাগ করে খাবার গ্রহণ করা উত্তম।
ডায়াবেটিস
বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা অনেক। এতে আক্রান্তদের ক্যালরি ক্যালকুলেশন হতে হয় সঠিক। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের ফলে রক্তে গ্লুকোজের আধিক্য, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, এমনকি ওজন বৃদ্ধির সমস্যা দেখা দেয়। আবার খুব কম ক্যালরি গ্রহণের ঝুঁকিও কম নয়। সে ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে হাইপোগ্লাইসেমিয়া, মাথা ঘোরা, শক্তির ঘাটতি, ইনসুলিন বা ওষুধের অস্বাভাবিক শোষণ ইত্যাদি। এমন রোগীরা ক্যালরি ব্যালেন্সে কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে উপকার পাবেন:
 রক্তে সুগার ব্যালেন্সের জন্য লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ কার্বোহাইড্রেট রাখা চাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায়। সে ক্ষেত্রে খেতে পারেন ব্রাউন রাইস, গম ভাঙানো আটার রুটি বা ব্রাউন ব্রেড।
 পর্যাপ্ত ফাইবার রাখা চাই খাদ্যতালিকায়। ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি থাকলে গ্রহণ করতে হবে একটু ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার। সে ক্ষেত্রে পরিমিত শাকসবজি ও ফল খাওয়া শ্রেয়।
 অত্যধিক চর্বিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ না করে ডায়েটে রাখা চাই লীন প্রোটিন আর স্বাস্থ্যকর ফ্যাট।
 খাবার গ্রহণ করতে হবে ছোট ছোট ভাগে। প্রয়োজনে ৫ থেকে ৬টি ছোট মিল রাখুন সারা দিনের খাদ্যতালিকায়। সে ক্ষেত্রে রাতের খাবার হতে পারে হালকা, যাতে রক্তে গ্লুকোজ স্থিতিশীল থাকে; হঠাৎ বেড়ে না যায়।
ফ্যাটি লিভার
রক্তে বাড়তি কোলেস্টেরল জমতে শুরু করলে একসময় তা লিভারে জমে, যাকে বলে ফ্যাটি লিভার। সহজ কথায়, লিভারের কোষে ফ্যাট জমে যাওয়া জনিত ব্যাধি। ওজন যত কমতে থাকে বা স্বাভাবিক হয়ে আসে, ততই ফ্যাটি লিভারের কারেকশন হতে শুরু করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা থেকে কমাতে হয় ক্যালরি। সে ক্ষেত্রে ৩০০ থেকে ৫০০ ক্যালরি কম গ্রহণে খুব দ্রুত ওজন কমে এবং সুস্থতা নিশ্চিত হয়। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীদের ক্যালরি কমাতে কিছু খাবার বাদ দেওয়া চাই—
 অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার;
 ভাজা খাবার;
 স্যাচুরেটেড ফ্যাট;
 ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাবার।
শুধু ক্যালরি গ্রহণের বিধিনিষেধ অনুসরণই নয়; বরং গ্রহণ করা কিছু ক্যালরি বার্ন করাও জরুরি। সে ক্ষেত্রে হাঁটা, জিম, স্ট্রেন্থ ট্রেনিং করা প্রয়োজন। তবে অনেকে না বুঝে খুব দ্রুত ক্যালরি ঝরানোর চেষ্টা করেন; তাতে অবশ্য ভালোর বদলে ক্ষতিই হয়। যেমন লিভার স্ট্রেস বারে, অতিরিক্ত পেশি ক্ষয় হয়, অকারণে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে ইত্যাদি। তাই সঠিক ক্যালরি পরিকল্পনা সব সময় একজন দক্ষ পুষ্টিবিদের পরামর্শে গ্রহণ করা উচিত।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top