এই শহর এই সময় I গ্যালারি ও কথামালা
সুদূর রাশিয়ায় ফুটবলের প্রীতিময় বিশ্বযুদ্ধ আসলে ফুটবলের বিশ্ব কার্নিভ্যাল। এতে মেতেছে বিশ্বের এমন অনেক দেশ যেগুলোর কোনো টিম কখনো বিশ্বকাপে খেলেনি। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের ফুটবল টিমের কোনো বিশ্বকাপ আসর নেই, কিন্তু সব খেলার সেরা বাঙালির প্রিয় ফুটবল! তাই ফুটবলের বিশ্বকাপ মানেই উৎসবমুখর বাংলাদেশ।
তাই ফুটবলের কার্নিভ্যালকে কেন্দ্র করে এক ফালি রাশিয়া ঢুকে পড়েছে রাজধানী ঢাকায়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকা সন্ধ্যার পর রাশান স্টেডিয়ামের আকার ধারণ করছে। যেমন টিএসসি চত্বর কিংবা রবীন্দ্রসরোবরের নানা জায়গায় সন্ধ্যার পর আছড়ে পড়ছে জনসমুদ্রের ঢেউ। টিএসসির অপরাজেয় ভাস্কর্যের আশপাশেই বেশ কিছু স্ক্রিনে চলছে বিশ্বকাপ। প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় স্ক্রিনে খোলা আকাশের তলায় বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখছেন সব বয়সের মানুষ। একই দৃশ্য রবীন্দ্রসরোবরসহ আরও জায়গায়। পুরান ঢাকা কিংবা সাভারের অলিগলিতেও একটু খুঁজলে এই চিত্র চোখে পড়বে। ওপেন এয়ার এই ফুটবল ম্যাচ স্ক্রিনিং দেখলে মনে হবে, ঢাকা যেন বিশ্বকাপের রুশ শহরগুলোর একটি। রুশ দেশের ফুটবলের রূপকথা মিশে গেছে প্রাচীন ঢাকা শহরের উপকথার সঙ্গে।
কালের নদীতে ডুব দিয়ে সময়ের মুখচ্ছবির চালচিত্র গড়ে তুলে যাঁরা সময়-স্থানের নিগূঢ় ভাষ্য রচনা করেন, তাঁদেরই থাকে তৃতীয় আঁখি। যাকে শিল্পের ভাষায় থার্ড আই বলা হয়। এই তৃতীয় দৃষ্টির অধিকারী হন কবি, চিত্রকরসহ নন্দনস্রষ্টার কেউ কেউ। কালপ্রবাহের খন্ড খন্ড বর্ণনা চিত্রকলায় সৃজনের মধ্য দিয়ে নিজের থার্ড আই খুঁজতে চেষ্টা চালিয়েছেন শিল্পী মঞ্জুর রশিদ। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের আর্ট গ্যালারিতে এই শিল্পীর ‘ন্যারেটিভ অব টাইম’ শিরোনামের চিত্র প্রদর্শনীর দিকে চোখ রাখলে রসিকজনের তেমনটাই মাথায় আসবে।
এই প্রদর্শনীর ক্যানভাসগুলো সময়-নদীর একেকটি বাঁক। একেকটি বাঁকে ফুটে উঠেছে একেকটি মুখচ্ছবি, মুখভঙ্গিমা অথবা একেকটি প্রাণ ও বস্তুর সাময়িক মুড। এসবের মধ্যে রয়েছে সময়ের কথকের ধৈর্য ও প্রাজ্ঞতার চিত্রকলা থেকে শুরু করে নিষ্পাপ কৈশোরের রঙিনকাল, রয়েছে কাজলের মতো কালো ব্ল্যাক-বিউটির নান্দনিক প্রকাশ অথবা সিরিয়ায় মার্কিন আস্ফালনে অভিশপ্ত শৈশব-কৈশোরের মুখচ্ছবি। তবে শুধু মানবিক অভিব্যক্তিই নয়; চাঁদ, ফুল, উচ্ছল ময়ূর ইত্যাদির মাধ্যমে সময়-নদীর যা কিছু সুন্দর, আকর্ষণীয় সেসবকেও মূর্ত করেছেন শিল্পী। স্মরণে রেখেছেন পশ্চিমা আলোকায়নে উজ্জ্বল সেই মুখাবয়ব, সেই ‘মোনালিসা’। মোনালিসার পুনর্নির্মাণের চেষ্টাও চালিয়েছেন তিনি। তবে সময়-নদীর গভীর ও গভীরতর তলে কতটা ডুব দিতে পেরেছেন, সেই প্রশ্নও অসমীচীন নয়।
ঢাকায় ফুটবলের এই কার্নিভ্যালের মাঝেই শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক শহুরেদের নিত্যযাপনও অব্যাহত। সম্প্রতি ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, সাংবাদিক মশিউল আলমের সঙ্গে প্রাণবন্ত এক সান্ধ্য আলাপে অংশ নিয়েছিলেন শহরের উল্লেখযোগ্য লেখক, কবি ও বুদ্ধিজীবীরা। ঢাকার কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ‘রাইটার্স ক্যাম্প’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। শিরোনাম, ‘লেখকের সঙ্গে’। এতে মশিউল আলমের প্রকাশিত বইয়ের পাঠক ও সমালোচকেরা লেখকের সঙ্গে নিজেদের মতামত বিনিময় করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে মশিউল আলম লেখালেখির ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য পাঠক-সমালোচকদের সামনে তুলে ধরেন।
মশিউল আলমের ভাবনা, উপন্যাস কখনোই সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, নৃবিজ্ঞান নয়। সাহিত্যের কাজ পাঠকের মনে ‘করুণা’ সৃষ্টি করা। তবে মশিউল আলমের ভাবনার সমালোচনা করেন কবি ও কথাসাহিত্যিক চঞ্চল আশরাফ। তাঁর বক্তব্য, করুণা সৃষ্টি উনিশ শতকের সাহিত্যের অভিপ্রায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৈতিকতার প্রশ্ন। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নকে বহু আগেই সাহিত্য অতিক্রম করে গেছে। মশিউল আলমের প্রবন্ধ ও তাঁর গল্প উপন্যাসের বিষয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকেরা বহুবিধ প্রশ্ন সামনে আনেন। আলাপ ও তর্ক-বিতর্কে জমে ওঠা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন নূরুল কবির, সাখাওয়াত টিপু, ফারুক ওয়াসিফ, কামরুজ্জামান কামু, সোহেল হাসান গালিব, শোয়েব সর্বনাম, আফসানা বেগম, ফিরোজ আহমেদ, রবিন আহসান, আরকে রনি, আলমগীর নিষাদ, সালাহ উদ্দিন শুভ্রসহ অনেকে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাহবুব মোর্শেদ।
অতনু সিংহ
ছবি: সংগ্রহ