ফুড বেনিফিটস I লিচুর এত কিছু!
ছোট্ট এই ফল মানবশরীরের ভেতরে-বাইরে দারুণ কার্যকর। এতে তৈরি প্যাক ত্বক ও চুলের যত্নে অসামান্য
এ ফলের আঁতুড়ঘর চীন। চৈনিক বিজ্ঞানী লাই চি প্রথম এই রসাল ফলের হদিস পান। সেই থেকে অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন, বিজ্ঞানী লাই চির নামানুসারেই এ ফলের নামকরণ হয়েছে লাই চি বা লিচু। অষ্টম শতকে চীনা সম্রাট হুয়ান সাং দক্ষিণ চীন থেকে লিচু নিয়ে উত্তর চীনের সম্রাজ্ঞীকে উপহার দিয়েছিলেন। আর পৃথিবীতে লিচু নিয়ে প্রথম বই লেখা হয়েছিল ১০৫৬ সালে। রাজা-প্রজা-উজির-নাজির সবার মন ভুলিয়ে তবেই লিচুগাছ এসেছে বাংলাদেশে। ছোট এ ফলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতার কথা জানলে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হবে। অন্যদিকে, লিচুগাছের পাতা থেকে শুরু করে বাকল পর্যন্ত– সবই যেন পথ্য।
প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুতে রয়েছে ১.১ গ্রাম প্রোটিন, ০.২ গ্রাম ফ্যাট, ১৩.৬ গ্রাম শ্বেতসার, ০.০২ গ্রাম ভিটামিন বি১, ০.০৬ গ্রাম বি২, ০.৫ গ্রাম খনিজ লবণ, ৩১ মি.গ্রা ভিটামিন সি, ০.৭ মি.গ্রা লৌহ। এ ছাড়া আছে থিয়ামিন, নিয়াসিন ইত্যাদি।
লিচুতে থাকা এসব উপাদান শরীরের অনেক উপকারে আসে। যেমন ত্বক থেকে বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ত্বকে এর ছাপ পড়তে থাকে। লিচু ব্যবহার করে তা দূর করা সম্ভব। এ জন্য চার থেকে পাঁচটি লিচু খোসা ও বিচি ছাড়িয়ে, সেগুলোর সঙ্গে একটি কলার এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ নিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে মসৃণ একটি পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে। এই মিশ্রণ ধীরে ধীরে ও বৃত্তাকারে মুখে আর ঘাড়ে ম্যাসাজ করে ১৫ মিনিট রাখার পর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে ভালো ফল পাওয়া যায়। লিচু অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর। এ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্রি র্যাডিকেলের সঙ্গে মিশে ত্বকের ক্ষতি রোধ করে।
এ তো গেল বয়সের ছাপের কথা। বয়স বাড়ার আগেই যদি ত্বকে কোনো দাগ পড়ে, লিচুর রস সেই দাগ দূর করতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে চার-পাঁচটি লিচুর খোসা ও বিচি ছাড়িয়ে নিয়ে, ভালো করে পিষে রস বের করে নিতে হবে। লিচুর রসে কটন বল ডুবিয়ে, তা দিয়ে মুখে ম্যাসাজ করুন এবং ১৫ মিনিট পর ঠান্ডা পানিতে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে নিয়ে মুখ মুছে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে দাগ দূর হবে এবং ত্বক মসৃণ হবে। মূলত হাইপারপিগমেন্টেশনের জন্যই মানুষের ত্বকে দাগ হতে দেখা যায়। আগেই বলা হয়েছে, ভিটামিন সি-এর চমৎকার উৎস লিচু। লিচু তাই ত্বকের দাগ দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এই রসাল ফল। একটি পাত্রে সাত থেকে আটটি লিচুর রসের সঙ্গে দুই টেবিল চামচ অ্যালোভেরা জেল ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। মিশ্রণ মাথার তালুতে মেখে নিন। এক ঘণ্টা পর হালকা শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। লিচুতে থাকা কপার উদ্দীপিত করে ফলিকলকে, যা চুল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ক্যানসারের মতো জটিল রোগের সমাধানও আছে ওইটুকু ফলে। গবেষণায় দেখা গেছে, লিচুতে শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ছাড়াও ক্যানসারবিরোধী গুণাগুণ আছে। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যানসারের কোষের উপর লিচুর ভালো প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
এটি হৃদ্পি-ের বন্ধু। এ ফলের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হৃদ্স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। লিচুতে অলিগোনল নামের একটি উপাদান থাকে। মানুষের শরীরে এটি নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন ত্বরান্বিত করে। নাইট্রিক অক্সাইড রক্তনালিকে প্রসারিত করে বলে রক্তচলাচল সঠিকভাবে হয়, ফলে রক্ত পাম্প করতে হার্টের বেশি চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। সার্বিক হৃদ্স্বাস্থ্যের জন্যই লিচু উপযোগী।
হজমে সমস্যা? লিচু খান। লিচু মানবদেহের পরিপাকনালি সুস্থ রাখে। প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফাইবার থাকে, তাই এটি পরিপাকে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও এর রয়েছে দারুণ ভূমিকা।
চোখের যত্নেও একে পাবেন। কেননা, এতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-নিউপ্লাজমিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। এ কারণে লিচু খেলে চোখের ছানি প্রতিরোধ হয়।
লিচুতে বেশি ক্যালরি থাকে না এবং খুব কম ফ্যাট থাকে বলে তা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
এখানেই শেষ নয়, ফলের পাশাপাশি লিচুগাছের বাকল, মূল ও পাতারও রয়েছে বিশেষ কিছু গুণ।
লিচু শরীর ঠান্ডা রাখে, তৃষ্ণা মেটায়, শক্তি জোগায়। পরিমিত লিচু খেলে শরীরের বায়ু, কফ ও পিত্ত নাশ করে। ক্লান্তিতে কিংবা দীর্ঘ রোগভোগের পর দুর্বলতা কাটাতে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি লিচু সামান্য লবণ মিশিয়ে খেলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের দুর্বলতা অথবা স্মৃতিবিভ্রমে দিনে আট থেকে দশটি লিচু লবণ মিশিয়ে খেলে সুফল পাওয়া যায়। লিভারের রোগীদের জন্যও লিচু উপকারী। যকৃতের রোগেও কার্যকর। দিনে দুবার লিচুর শরবত খেলে কিংবা দুবেলা নিয়ম করে পাঁচ থেকে সাতটি লিচু খেলে ক্ষুধামান্দ্য কমে যায়।
পোকামাকড় কামড়ানোর যন্ত্রণা উপশমে কাজে আসে লিচুর পাতা। বোলতা কিংবা বিছায় কামড়ালে লিচুপাতার রস ব্যবহার করা হয়। কাশি, পেটব্যথা, টিউমার ও গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি রোধে এটি যথেষ্ট কার্যকর।
ফেলনা যায় না লিচুর বীজও। চর্মরোগজনিত ব্যথায় লিচুর বীজ ব্যবহৃত হয়। গলার ঘা সারাতে পানিতে সেদ্ধ লিচুর শিকড়, বাকল ও ফুল ব্যবহার করা হয়। কচি লিচু শিশুদের বসন্ত রোগে এবং লিচুর বীজ স্নায়বিক যন্ত্রণার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লিচুগাছের বাকল ও শিকড়ের ক্বাথ গরম পানি দিয়ে কুলকুচা করলে গলার কষ্ট উপশম হয়। এ ছাড়া লিচু শরীরের বিপাক ক্ষমতা বাড়ায় এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সংগ্রহ