অর্গানিক I অয়েল পুলিং
নিরাপদ ও কার্যকর একটি পদ্ধতি। সুস্থ মুখগহ্বর ও সুন্দর হাসির জন্য
মুখশ্রী কিংবা গায়ের রং যা-ই হোক না কেন, সুন্দর হাসি সহজেই যে কাউকে আকর্ষণ করে। মনে প্রশান্তি এনে দেয়। আর সেই হাসিই যদি জীবানুমুক্ত, দুর্গন্ধহীন ও ঝকঝকে না হয়, তবে তা প্রশান্তির বদলে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করবে।
তাই এই সুন্দর হাসি নিশ্চিত ও নির্দোষ করে তুলতে হলে চাই মুখগহ্বর ও দাঁতের কার্যকর পরিচর্যা। ভাবছেন, নিয়ম করে তো দাঁত ব্রাশ করছেনই। ডেন্টিস্টের কাছেও যাওয়া হয়, তবে? এতেই কিন্তু যত্ন নেওয়া হয়ে গেল না। দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখতে এসব ছাড়াও আলাদা যত্নের প্রয়োজন। এ ছাড়া কেমিক্যাল জাতীয় উপকরণের একটা বিরূপ প্রভাব তো রয়েছেই। তাই প্রাকৃতিক উপায়ে মুখস্বাস্থ্যের যত্ন নিলে সব দিক দিয়েই তা নিরাপদ।
দাঁতের যত্নের নানান প্রাকৃতিক বা ভেষজ উপকরণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ পুরোনো একটি পদ্ধতি হচ্ছে অয়েল পুলিং। প্রাচীন আয়ুর্বেদে ডেন্টাল হাইজিন ও মাউথ ফ্রেশনার হিসেবে তেলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তবে অনেকে হয়তো এই পদ্ধতির কথা এই প্রথম জেনে থাকবেন। এটি হচ্ছে একটি প্রাচীন প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা, যাতে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে দাঁত ও মাড়ি পরিষ্কার রাখা হয়। দাঁত ঝকঝকে সাদা করে তোলা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় উচ্চ মানসম্পন্ন অর্গানিক তেল, যা শরীর ডিটক্সিফাই করতে এবং দাঁতের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে। অয়েল পুলিং হলো দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখার, মুখের ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত উপাদান দূর করার এমন এক আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি, যাতে মুখে তেল নিয়ে পনেরো থেকে বিশ মিনিট নাড়াচাড়া করে ফেলে দিতে হয়।
এটি নিশ্চিত যে অয়েল পুলিং নিরাপদ। কিন্তু কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। অয়েল পুলিং নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ভালো মানের তেল সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে পদ্ধতিটি বেশ উপকারী এবং এর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। কেননা এ ক্ষেত্রে সেই তেল ব্যবহার করতে হয়, যা খাওয়ার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
এবার আসা যাক কীভাবে অয়েল পুলিং কাজ করে আর কীভাবে কাজটি করে নিতে হবে। সকালবেলা কিছু খাওয়ার বা পান করার আগে এটি করে নিতে হবে। ক্যাভিটিজ প্রতিরোধের পাশাপাশি দাঁত ও মাড়ি মজবুত রাখতে পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। অয়েল পুলিং শরীর ডিটক্সিফাই রাখতে, হরমোন পরিবর্তনে সাহায্য করতে, এমনকি চোয়ালের ব্যাথা ও হ্যাঙওভার নিরাময় করতেও বেশ ভালো কাজ দেয়। দাঁত সাদা তো করেই। ব্রণ, কেরোটোসিস পিলারিস, সিরিয়াসিস বা অন্য কোনো ত্বকের সমস্যা হলে অয়েল পুলিং শরীর থেকে টক্সিন, ব্যাকটেরিয়া দূর করে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেও সাহায্য করে। এতে অর্গানিক তেল ব্যবহৃত হয়। এর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল ফর্মুলা মাড়ি ও দাঁত মজবুত করে এবং ওরাল হেল্থ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
প্রথমে এক থেকে দুই টেবিল চামচ তেল মুখে নিন।
মুখের চারপাশে তেল নাড়াচাড়া করতে থাকুন পনেরো থেকে বিশ মিনিট। এটি বেশ দীর্ঘ সময় মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া ও প্লাক দূর করার জন্য এ-সময়টুকু লাগবেই। অন্যদিকে, কোনো ক্ষতিকর উপাদান যাতে ফিরে না আসতে পারে, সে জন্য সময়ের হিসাব মেনে কাজটি করতে হবে।
এবার তেল ফেলে দিন। ব্যবহৃত তেল কোনোভাবেই গিলে ফেলা যাবে না। কারণ, এর সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া, বিষাক্ত উপকরণ ও প্লাক মিশে থাকে।
মুখের তৈলাক্ত ভাব দূর করতে হালকা গরম পানি দিয়ে কুলকুচা করে নিন। সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে নিলে আরও ভালো।
এরপর ব্রাশ করে নিন। এতে সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হবে।
ভালো মানের অর্গানিক নারকেল তেল বা তিলের তেল এই কাজে বেশি ফলপ্রদ। ঐতিহ্যগতভাবে অয়েল পুলিংয়ে অর্গানিক সিসেমি অয়েল বা তিলের তেল ও সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করা হয়। তিলের তেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। মুখগহ্বর ও ক্ষুদ্রান্ত্র পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি দাঁত ঝকঝকে করে তুলতে তিলের তেল কার্যকর। ভেজিটেবল বেজ তেল, যেমন– নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, ক্যাস্টর ও অ্যাভোকাডো অয়েল ভালো কাজ দেয়। তবে বিভিন্ন কারণে এ কাজে নারকেল তেল ব্যবহার করার পরামর্শই দেওয়া হয়। তেলটি প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল। নারকেল তেল স্টেপ্টোকোককাস মিউট্যান্স ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে বেশ কার্যকর। যা ক্যাভিটিসের প্রধান একটি কারণ। এই তেল বিভিন্ন জীবাণু ধ্বংস করতে ও প্লাক দূর করতে সাহায্য করে। মাউথওয়াশ হিসেবেও নারকেল তেল ভালো কাজ দেয়। দাঁত ঝকঝকে সাদা করে তুলতে চাইলে নারকেল তেল চমৎকার উপায় হতে পারে। এটি ট্রিগ্লিসাইরাইড ও উচ্চ মানের লাউরিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ। তাই অন্যান্য তেলের তুলনায় এটি প্লাক দূর করতে ও দাঁত সাদা করে তুলতে বেশি কার্যকর।
ওমেগা-৬ বা উদ্ভিজ্জ তেল, ক্যানোলা অয়েল, সয়াবিন তেল, কর্ন অয়েলের মতো রাসায়নিকভাবে প্রস্তুতকৃত তেল এড়িয়ে যেতে হবে।
অয়েল পুলিং পদ্ধতিতে প্রাথমিক যে সমস্যায় পড়তে হয় তা হলো, তেলের স্বাদে অভ্যস্ত না হওয়াটা। বিশেষ করে যে সময়টুকু মুখে তেল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। সমস্যাটি থেকে বের হওয়ার উপায়ও রয়েছে। তেলের সঙ্গে মিশিয়ে নিন সামান্য পেপারমিন্ট, এলাচি বা প্রাকৃতিক কোনো সুগন্ধি উপকরণ। এটি দাঁত পরিষ্কারের পাশাপাশি দেবে সতেজ ও সুগন্ধি নিঃশ্বাস। খুব সমস্যা হলে বেছে নিতে পারেন হালকা গন্ধযুক্ত কোনো তেল। যেমন, নারকেল তেল। অন্যান্য তেলের চেয়ে এর স্বাদ বেশ হালকা ও কোমল। এ ছাড়া প্রথম দিকে পাঁচ মিনিট তেল মুখে নিয়ে অয়েল পুলিং শুরু করতে পারেন। যখন এটি মোটামুটি অভ্যাস হয়ে আসবে, তখন সময়ের ব্যাপ্তিও বাড়িয়ে দেবেন। মনে রাখতে হবে, পনেরো থেকে বিশ মিনিট সময়টাই যথেষ্ট।
পদ্ধতিটি ক্ষতিকর নয়। তবু যদি তেল কারও জন্য স্পর্শকাতর হয়ে থাকে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়, তা এড়িয়ে চলাই ভালো। এ সময়েও ওরাল হেলথ ভালো রাখাটা জরুরি, তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে। শিশুদের জন্যও এটি নিরাপদ। তবে সেই শিশুদের জন্য, যারা ব্যবহৃত তেল গিলে ফেলবে না। এ ছাড়া দাঁতে মেটাল ফিলিং, ক্রাউন বা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে অয়েল পুলিং করা যাবে কি না, তা ডেন্টিস্টের কাছ থেকে জেনে নিয়ে করাটাই ভালো।
কেবল মুখগহ্বর ও দাঁতের সুস্থতায় নয়। শরীরের অন্যান্য অংশেরও উপকারে আসে অয়েল পুলিং। তাই একটি ভালো ওরাল হেলথ রুটিন হিসেবে অয়েল পুলিং অবশ্যই দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
তাসমিন আহমেদ
মডেল: আইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন