অর্গানিক I ত্বকের আয়ুর্বেদ
ত্বকের ভিন্নতা কীভাবে নির্ণীত হয় আয়ুর্বেদে? কেমন এর পরিচর্যা?
ত্বকচর্চায় সমকালীন পদ্ধতির অভাব নেই। সৌন্দর্যসচেতন নারীর জন্য নিত্যনতুন উপকরণ আর নিয়মকানুন উদ্ঘাটন হয়েই চলেছে। তাই বলে প্রাচীন পদ্ধতিগুলোর কদর কমেনি; বরং অতীতের নিয়মগুলোই আপডেট হয়ে রূপচর্চার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তা ছাড়া এখনকার ত্বকচর্চায় রাসায়নিক পণ্যের ব্যবহার বেশি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে বলে তা এড়াতে চান প্রায় সবাই। তারা আয়ুর্বেদিক উপকরণ ব্যবহারে আগ্রহী। আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতেও ত্বকের ধরন বুঝে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ত্বকের জন্য বিশেষ পণ্যের প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতি ত্বকের সুস্থতা নিশ্চিত করে, উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
আয়ুর্বেদে তিন ধরনের ত্বকের কথা বলা হয়েছে- ভ্যাটা, পিট্টা ও কাপহা। এগুলোর ভারসাম্য ঠিক রাখার ওপর নির্ভর করে ত্বকের ভালো থাকা। কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সহজেই বোঝা যাবে কার ত্বক কোন ধরনের। এ ছাড়া সর্বজনীন ত্বকের যত্নে উদ্ভিদের বিশুদ্ধ নির্যাসের পাশাপাশি তেল ও ভেষজ গুণসমৃদ্ধ উপকরণগুলো ব্যবহার করা যায়।
ভ্যাটা: এ ধরনের ত্বক সাধারণত রুক্ষ প্রকৃতির হয়। কিছুটা পাতলা। রং গাঢ় বা অনুজ্জ্বল হয়। লোমকূপ ছোট হওয়ার কারণে ঘাম নিঃসরণ হয় কম। স্পর্শ করলে ঠান্ডা অনুভূত হয়। এই ত্বকের ফেটে যাওয়ার প্রবণতা প্রবল। সূর্যের তাপ সইতে পারে এই ত্বক। ঠান্ডা আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না। রিংকেল বা বলিরেখা পড়ে সহজেই। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় সুস্থ দেখায়। এই ত্বকের কিছু সুবিধাও রয়েছে। গঠন পাতলা হলেও বলিরেখা ও ফাইনলাইন প্রতিরোধ করতে এটি সক্ষম। এই ত্বকের আরেকটি আশীর্বাদ হলো, এতে কম ব্রণ হয়। মসৃণতাও থাকে।
ভ্যাটা স্কিনের যত্নে হাইড্রেশন জরুরি। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ত্বক প্রশান্ত করে ও সুরক্ষা দেয় এমন ক্রিম ও তেল বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। ত্বক সাবধানে পরিষ্কার করতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে, যাতে আরও শুষ্ক বা এক্সফোলিয়েশন বেশি না হয়ে যায়। চাল বা বাদাম গুঁড়া গোলাপজল কিংবা দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নিন। এটি কেমিক্যাল বেজ এক্সফোলিয়েটের একটি ভালো বিকল্প। জিরানিয়াম এসেনশিয়াল অয়েল শুষ্কতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে। ব্যবহার করা যেতে পারে ধূপধুনো। এটি ত্বকের মৃতকোষ পরিষ্কার করে তোলে কোমলভাবে, যাতে ফাইনলাইন ও বলিরেখা না পড়ে। ত্বকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং গাঢ় দাগের বিরুদ্ধে কাজ করে সাইট্রাস অ্যাসিড সমৃদ্ধ এসেনশিয়াল অয়েল। অন্যান্য ত্বকের চেয়ে ভ্যাটা কিছুটা নাজুক, তাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। এ ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার অয়েল ভালো কাজ দেয়। ব্যবহার করতে পারেন ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার অয়েল। পাশাপাশি কার্যকর পিউনিসিম অ্যাসিড, যা কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে, স্বাস্থ্যবান ত্বকের জন্য এটা জরুরি। ভ্যাটা স্কিন খুব দ্রুত শুষ্ক ও মৃতকোষের স্তরে পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে নানা ধরনের রোগ, এমনকি সোরিয়াসিস পর্যন্ত এই ত্বকে হতে পারে। এমন অবস্থা থেকে মুক্তি দেয় হেলিক্রিওসাম ও ক্যামোমাইলের এসেনশিয়াল অয়েল। এগুলো ত্বক পুনর্গঠনেও সহায়তা করে। অ্যাভোকাডোর মতো গাঢ় ক্যারিয়ার অয়েল আক্রান্ত ত্বকে ব্যবহার করা যেতে পারে সুরক্ষা প্রলেপ হিসেবে।
পিটা: তৈলাক্ত নয়, শুষ্কও নয়- পিটা স্কিন এমনই। এটি সাধারণত কোমল দেখায়। এই ত্বকের পুরুত্ব মাঝারি ও কমনীয়। দ্যুতিময়তার সঙ্গে এর লালচে আভা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লোমকূপ মাঝারি বা গড়পড়তা আকারের হয়। এতে ব্রণ, র্যাশ ও দাগ বা তিল পড়ার প্রবণতা বেশি। পিটা স্কিন সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারে না। তাই গরম আবহাওয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এর ফটো সেনসিটিভিটি রয়েছে। যার কারণে ত্বক পুড়ে যাওয়ার এবং গাঢ় হয়ে যাওয়ার প্রবণতা এতে বেশি থাকে। খুব ঘাম হয়। পিটা স্কিন চায় শীতলতা। শীতে এই ত্বক বেশ সুস্থ দেখায়। তবে এ ধরনের ত্বকের যথেষ্ট যত্নের প্রয়োজন। বেশ সংবেদনশীল বলে এমন উপকরণ ব্যবহার করা উচিত, যা লালচে ভাব ও প্রদাহ প্রতিরোধে সাহায্য করবে।
ভালো কাজ দেবে অ্যালোভেরা জেল। এটি সরাসরি ত্বকে লাগিয়ে পাঁচ মিনিট রেখে দিন। এরপর ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুদিন এটি করে নিতে পারেন। চন্দন ও গোলাপের এসেনশিয়াল অয়েল এই ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। চন্দন পিটা স্কিনের ভারসাম্য বজায় রাখে, দেখায় নিটোল ও নিখুঁত। ল্যাভেন্ডার এসেনশিয়াল অয়েল পিটা স্কিনের জন্য বেশ উপযোগী। যখন লালচে হয়ে থাকবে এই ত্বক, তখন মর্নিং ফেসওয়াশের বদলে বেছে নিন মধু। ত্বকে লাগিয়ে নিন। পাঁচ মিনিট পর হালকা গরম পানিতে কটন বল ভিজিয়ে আলতো করে ত্বক মুছে নিন। এ ছাড়া ক্যামোমাইল কম্প্রেস পিটা স্কিনের জন্য ভালো। ত্বকের লালচে ভাব কমাতে চমৎকার প্রাকৃতিক চিকিৎসা এটি। কিছু ঠান্ডা শসার টুকরো প্রয়োগ করলে জ্বলুনি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ দেবে।
কাফা: এ ধরনের ত্বক কোমল হয়ে থাকে। বেশ তৈলাক্ত বা ময়শ্চারাইজিং দেখায়। ত্বকের গঠন নরম ও কিছুটা পুষ্ট দেখায়। ঘনত্ব পুরু ও রং হবে দীপ্তিময়, কোমল ও প্রাণবন্ত। লোমকূপ বড়। এটি সূর্যের আলো সইতে পারে। এতে স্বাভাবিক বা মাঝারি ঘাম হতে পারে। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া কাফা স্কিনে মোটেও সহ্য হয় না। এমন আবহাওয়ায় ত্বক আরও সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, বিশেষ করে জ্বলুনি ও চুলকানি হতে পারে। ভালো থাকে শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায়। লোমকূপ বড়, ফলে ব্রণ ও ব্ল্যাকহেডস হওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে কাফা স্কিনের কিছু সুবিধাও রয়েছে। গঠন পুরু হওয়ায় এতে সহজে বলিরেখা পড়ে না। কোমল হয়। এই ত্বকের পানি ধরে রাখার ক্ষমতা রয়েছে এবং ফাংগাল ইনফেকশন রোধে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা জরুরি।
এই ত্বক ভালো দেখাতে আলতোভাবে পরিষ্কার ও এক্সফোলিয়েশন জরুরি। সি সল্ট ও মধুর মিশ্রণ দিয়ে কোমলভাবে স্ক্রাব করে নিন। নিতে পারেন হারবাল স্টিম থেরাপি। স্টিমে পুদিনা ব্যবহার করতে হবে। এটি লোমকূপ পরিষ্কার রাখে ও তেলের ভারসাম্য ঠিক রাখে। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এটি করে নেওয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ কমাতে পারে হলুদের এসেনশিয়াল অয়েল। যা ত্বকের ন্যাচারাল সিবামের ব্যালান্স ঠিক রাখতে ও জ্বলুনি কমাতে চমৎকার কাজ করে। লাইটওয়েটের কারণে গ্র্যাপসিড ক্যারিয়ার অয়েল এই ত্বকে ভালো কাজ দেয়। এই তেলে বিদ্যমান ওমেগা-৬, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও লিনোলিক অ্যাসিডের শক্তিশালী মাত্রা ব্রণ ও জ্বলুনির বিপরীতে লড়াই করে। ভারসাম্যহীনতায় এই ত্বক ক্ষতির সম্মুখীন হয় বেশি। টি ট্রি ও লবঙ্গের এসেনশিয়াল অয়েল এর লাল ভাব ও জ্বলুনি কমাতে দারুণ কার্যকর। এটি ত্বকের তেল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে ও অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্য করে।
তাসমিন আহমেদ
মডেল: মাইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন