skip to Main Content

কভারস্টোরি I টিউব জেনারেশন

সাইবার দুনিয়ায় এখন ইউটিউবের জয়জয়কার। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটা প্রজন্ম। ইউটিউব তাদের নেশা ও পেশা। লিখেছেন অতনু সিংহ

‘…রাস্তার নাম পাল্টায় একদিন
ধারা পাল্টায় মাও সে তুংয়ের চীন
প্রেম পাল্টায়, শরীরও পাল্টে যায়
ডাকছে জীবন, আয়, পাল্টাবি আয়’
– কবীর সুমন

প্রজন্মের ভাষা ও যাপনের ভঙ্গিমা পাল্টায়। এ এক অনিবার্য বাস্তবতা। চলতি প্রজন্মের হাত ধরেই তৈরি হয় নতুন নতুন ফ্যাশন, লাইফস্টাইল- বদলে যায় যাপনের আঙ্গিক ও বিষয়-আশয়। জ্ঞাপনের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মাধ্যমগুলোও পাল্টে যায়, মাত্রা বদল হয়, সংযোজন-বিয়োজন ঘটে নানা কিছুর।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের নামও রয়েছে নানা রকম। রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি ও গণমাধ্যমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রজন্মের চরিত্র আর তা থেকেই নির্ণীত হয় তার নাম। যেমন সোশ্যালিস্ট জেনারেশন, জেনারেশন লেফট, বিট জেনারেশন, হাংরি জেনারেশন, পাঙ্ক জেনারেশন, স্যাড জেনারেশন, জেনারেশন এক্স বা এমটিভি জেনারেশন, শূন্য দশক বা জিরো জেনারেশন ইত্যাদি। শহুরে যাপন ও জনসংযোগের নিরিখে আজকের প্রজন্মকে বলা যেতে পারে টিউব জেনারেশন। টিউব অর্থাৎ ইউটিউব জেনারেশন।
এখন সাইবার ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বিশ্ব নতুন প্রজন্মের হাত ধরে ঢুকে পড়েছে এই ভার্চ্যুয়াল টিউবের যুগে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো ইত্যাদি ভার্চ্যুয়াল কমিউনিকেশন মিডিয়ার মাধ্যমে একান্ত অথবা সামাজিক জ্ঞাপনে (তথ্য আদান-প্রদান) অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মেট্রো-নাগরিকের নতুন প্রজন্ম তার দিনযাপনের কেন্দ্রভাগে নিয়ে এসেছে ইউটিউবকে। একে মাধ্যম করে নতুন প্রজন্মের ইউটিউবারদের যে ইনফো-কালচারাল যাপন, তাকে চিহ্নিত করতেই আমরা আজকের নতুন প্রজন্মকে টিউব জেনারেশন বলে চিহ্নিত করছি।
প্রেক্ষাপট
এই ইউটিউব জেনারেশনের আগে ‘জেনারেশন এক্স’ কিংবা ‘এমটিভি জেনারেশন’, এমনকি জিরো জেনারেশন বা শূন্য দশকের মতো শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। বিশ্বায়নমুখী উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির সাংস্কৃতিক প্রভাবে বেড়ে উঠেছিল এই জেনারেশন এক্স কিংবা এমটিভি জেনারেশন। পেজার, মোবাইল, ক্যাবল চ্যানেল, ফ্লপি-ডিস্ক-সিডি-ডিভিডি, ল্যাপটপ আর এম-টিভি, ফ্যাশন টিভির মতো রঙবেরঙের টেলিভিশন চ্যানেলকে সঙ্গে নিয়ে রূপ-রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছিল এই জেনারেশন এক্স! যার সূচনা গত সহস্রাব্দের শেষ শতকের ৮০ দশকের অন্তিমে, আর যার নিয়তির আখ্যান পূর্ণতা পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও বহুজাতিক করপোরেটের লগ্নিপুঁজি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়নব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। আবার এই পণ্যবাদী দুনিয়ার ইনফোটেক যাপনের মধ্য থেকে উঠে আসা জেনারেশন অধুনান্তিক পরিসরের মধ্যেই তৈরি করে নিয়েছিল উত্তরাধুনিক এক অভিমুখ। হেভি মেটাল কিংবা হিপহপ মিউজিকপ্রিয় এই জেনারেশনের যাপনচিত্রে দেখা গেছে আর্ট অ্যান্ড কালচারের নানা রকম ফিউশন। পাশাপাশি শিকড়কে নতুন করে জানার আগ্রহে ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতির প্রতি একধরনের আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল ফোক-ফিউশন। জেনারেশন এক্সের একাংশের এই ধরনের প্রবণতার মধ্যেই শূন্য দশক বা জিরো জেনারেশনের আবির্ভাব। যারা শিল্প-সাহিত্যে মাল্টিটেক্সচুয়াল, মাল্টিলেয়ারড ও ওপেন এন্ডেড সৃজনশীলতার পাশাপাশি বিকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর অনুসন্ধানও চালায়। আর এ কারণেই কেন্দ্রীয় প্রযোজকের দ্বারস্থ না হয়ে মুক্ত ভাবনা ও স্বাধীন উদ্যোগে ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম বা স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা গড়ে উঠেছিল এই সহস্রাব্দের প্রথম দশকে, জিরো জেনারেশনের যাপনের অন্দর থেকে। বিশ্বায়ন-পরবর্তী প্রজন্মগুলোয় যেমন পণ্যবাদ ঢুকেছে, তেমনই জিরো জেনারেশনের অ্যাপ্রোচে আমরা দেখেছি বিশ্বজুড়ে লগ্নিপুঁজি কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে বিকেন্দ্রিক ও স্বনির্ভর নানা ইনফো-কালচারাল উদ্যোগ। এমনকি নানা রাজনৈতিক আন্দোলনও নির্দলীয়ভাবে সামাজিক মাধ্যমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিসর, ইরান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিসসহ বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে। জিরো জেনারেশনের এই স্বনির্ভর, ওপেন এন্ডেড ও বিকেন্দ্রিক চরিত্রের উত্তরমুখে সাইবার জগতে টিউব জেনারেশনের আবির্ভাব। ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি সোশ্যাল ও পার্সোনাল ওয়েব কমিউনিকেশন মিডিয়ামগুলোর পাশাপাশি বৃহৎ পরিসর হিসেবে ইউটিউব ক্রমে ক্রমে নিজের আত্মপ্রকাশ করে। নতুন প্রজন্ম তার লাইফস্টাইলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করেছে ইউটিউবকে। দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যশ্রাব্যের যখন যেমন প্রয়োজন, তা এই ইউটিউবের মাধ্যমে দেখেশুনে নিতে পারছে, তেমনই স্বাধীনভাবে পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারছে নিজের সৃজনশীলতাকে। এমনকি কোনো রকম কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বৃহৎ-মাঝারি পুঁজির বিনিয়োগ ছাড়াই অডিও-ভিজ্যুয়াল মতামতও প্রকাশ করতে পারছে।
বিনিয়ন্ত্রিত অডিও-ভিজ্যুয়াল
বৃহৎ প্রযোজকনির্ভর ফিল্ম ও টেলিভিশন চ্যানেলের অডিও-ভিজ্যুয়াল মাস কমিউনিকেশনের ধরন অবশ্যই সংশ্লিষ্ট টেলিভিশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বা চলচ্চিত্র লগ্নিকারী সংস্থা-প্রযোজক-ডিস্ট্রিবিউটর চেইনের বৃহৎ কিংবা মাঝারি পুঁজি ও তার রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের অডিও-ভিজ্যুয়াল মাস মিডিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত চলচ্চিত্রকার, শিল্পী, সাংবাদিক প্রমুখের পেশা, মতামত ও শিল্পনন্দন পরমুখাপেক্ষী। জেনারেশন এক্স কিংবা জিরো জেনারেশনের স্বাধীন চলচ্চিত্র বৃহৎ বা মাঝারি পুঁজির চক্রে নিয়ন্ত্রিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সমান্তরালে একটি বড়সড় বিকল্প উদ্যোগ হিসেবে হাজির হয়েছিল। কিন্তু এর বড় সমস্যা ডিস্ট্রিবিউশন, মার্কেটিং ও প্রোজেকশনে। চলচ্চিত্র উৎসব বাদে এ ধরনের ছবির স্থায়ী প্রদর্শনীর পরিকাঠামো গোটা বিশ্বে অতি সামান্য জায়গাতেই রয়েছে। ইউটিউব এই সমস্যার সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। ছবি বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করে দিলেই হলো, তা মুহূর্তে ছড়িয়ে যেতে পারে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র । ইউটিউবকে ঘিরে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি বা শর্ট ফিল্মের রমরমা এখন। তবে এখানকার সব ছবিই যে খুব মানসম্মত, তা নয়। ফিল্মকে কেন্দ্র করে এত দিনের কেন্দ্রীয় পরিকাঠামোর বিনির্মাণ সম্ভব হয়েছে ইউটিউবের মাধ্যমে। নিউজ বা ইনফরমেশনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। টেলিভিশন চ্যানেল ও তার কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভরশীল তথ্য-বিনোদনজগতের মনোপলিকে প্রতিহত করে এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা ও তথ্য-বিনোদনে অগুনতি স্বাধীন উদ্যোগ তৈরি হয়েছে। অজস্র ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে টিউব-জার্নালিজমের নতুন যুগ। তবে শুধু ফিল্ম বা শর্ট ফিল্ম ও নিউজ ভিডিও নয়, সংগীত ও চলচ্ছবিসহ অন্য কিছু সাধারণ অডিও-ভিজ্যুয়াল দিয়ে যাত্রা শুরু করে ফ্যাশন, রূপসজ্জা, গৃহসজ্জা, স্থাপত্য, পেইন্টিং, ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল, ফুড, কুকিং, লোকসংস্কৃতি, সাহিত্যমূলক আলাপ, কমেডি, টিভি সিরিজ ইত্যাদির অডিও-ভিজ্যুয়ালসহ আর্ট-কালচার-লাইফস্টাইলের নানা দিকে ছড়িয়েছে। এ ছাড়া তথ্যচিত্র, করপোরেট ভিডিও, ইতিহাসচর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চা, ভাষাশিক্ষা, আলাপ ইত্যাদি বহুমাত্রিক অডিও-ভিজ্যুয়ালে পরিপূর্ণ। ইউটিউবাররা রিয়াল টাইম-স্পেসের দৈনন্দিন গণযাপনে রাখছেন নানা অবদান, হয়ে উঠছেন টিউব সেলিব্রিটি। শুধু তারাই নন, ভিউয়াররাও তাদের ইচ্ছামতো পছন্দের বিষয় ও তার অডিও-ভিডিওগ্রাফি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারছেন।
ইউটিউবের ইতিহাস
২০০৫ সালে ‘পে-পেল’-এর তিন তরুণ তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী চ্যাদ হার্লি, স্টিভ চেন ও জাভেদ করিম ইউটিউব শুরু করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ম্যাটেও শহরে একটি জাপানি রেস্তোরাঁর ছাদে গড়ে ওঠে এর প্রাথমিক হেডকোয়ার্টার। ২০০৬ সালে ১০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ভিডিও আপলোডের ভার্চ্যুয়াল কাঠামো তৈরি করা হয়। এ ছাড়া নানা ফিচার যুক্ত করা হয় ইউটিউবে। জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। ওই বছরই গুগল ১.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এটি কিনে নেয়। ২০০৮-১৩ সালের মধ্যে ইউটিউবের আঙ্গিক ও পরিকাঠামোর উৎকর্ষ হতে থাকে। এতে ৪৮০পি থেকে ৭৮০পি, ক্রমে ১০৮০পি হয়ে ফোরকে ভিডিও ধারণ করার ক্ষমতা ও তার সম্প্রচারের পরিকাঠামো গড়ে ওঠে এই কালপর্বেই। ২০১০ থেকে চালু হয় থামস রেটিং সিস্টেম, যা ভিডিও লাইক ও ডিজলাইক করার অপশন চালু করে। ২০১১ সালে চালু হয় ফিচার ফিল্ম রেন্টাল সিস্টেম। ২০১২ সালে গুগল ভিডিওর সঙ্গে ইউটিউব মিলে যায়। ২০১৪ সাল থেকে এটি ধারণ করতে থাকে সিক্সটি-এফপিএস-এর অডিও-ভিজ্যুয়াল। ২০১৫ সালে ৩৬০ ডিগ্রি অডিও-ভিজ্যুয়াল নিয়ে চালু হয় ইউটিউব রেড। ২০১৬ সাল থেকে চালু হয় ইউটিউবের চ্যানেল সাবস্ক্রিপশন।
ইউটিউবারদের স্বাধীন পেশাজগৎ
চ্যানেল সাবস্ক্রিপশনের পর থেকেই মূলত টিউব জেনারেশনের উত্থান। কারণ, নানা বিষয়ের চ্যানেল তৈরি হয় ইউটিউবে। একদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন তাদের ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করতে থাকে, তেমনই নতুন প্রজন্মের তরুণেরাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইউটিউব চ্যানেলে অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়াম ল্যাঙ্গুয়েজের সৃজনশীলতা ও পেশাদারিত্বের প্রকাশ ঘটান। চ্যানেলগুলোর ভিউয়ার যেহেতু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে, এক নিমেষে যেহেতু কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে প্রতিটি ভিডিও, তাই বিজ্ঞাপন দুনিয়ার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থের লেনদেন শুরু হয় ইউটিউবকে কেন্দ্র করে। ইউটিউবারদের অডিও-ভিজ্যুয়ালে বিজ্ঞাপন জুড়ে দিয়ে তা থেকে বিপুল অর্থ আয় করছে গুগল-ইউটিউব সংস্থা, তাই অডিও-ভিজ্যুয়ালের ভিউয়ার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে ইউটিউব তার আয়ের লভ্যাংশ ভাগ করে নিচ্ছে ইউটিউবারদের সঙ্গে। একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ভিউয়ার সংখ্যার বেশি হলেই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পৌঁছে যায় ইউটিউবারদের কাছে। ভিউয়ারের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অর্থাগমের মাত্রাও বেড়ে যায়। বোঝা যাচ্ছে, স্বাধীনভাবে নিজের সৃজনশীলতার প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউবের মাধ্যমে স্বাধীন পেশাজগৎ তৈরি হয়েছে। ইউটিউবার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে কেবল ভিডিওগ্রাফির উপযুক্ত ডিএসএলআর ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডিং ডিভাইস, এডিটিং সফটওয়্যারসহ ম্যাক ডেস্কটপ থাকলেই হবে। তবে অডিও-ভিজ্যুয়ালের আঙ্গিকগত ল্যাঙ্গুয়েজ ও তার টেকনিক্যাল টুলগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেট, লাইট, কস্টিউম- এগুলোর ব্যাপারে সামান্য বুদ্ধি খরচ করলেই হাতের সামনে থাকা জিনিসপত্র দিয়ে প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলা যায়।
ইউটিউব চ্যানেল ও ইউটিউবার

আয়মান সাদিক

স্মোস, হোলাসোয় জার্মান, রিয়ান হিগার মতো আন্তর্জাতিক কমেডি ইউটিউব চ্যানেল ও ইউটিউবারদের মোট দর্শক ও চ্যানেল সাবস্ক্রাইবার ১ থেকে ২০ বিলিয়ন কিংবা তার বেশি। জেন্না মারব্লেসের মতো বিউটি টিপসের ইউটিউব চ্যানেল কিংবা পিউডায়েপির মতো ভিডিও গেমকেন্দ্রিক ইউটিউব চ্যানেল ও ইউটিউবারদের ভিউয়ার-সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এর থেকেও উপরে। ইউটিউবারদের ব্যাপারে আলোচনা প্রসঙ্গে ইউটিউবের দুজন বিখ্যাত অনলাইন ভিডিও সিরিজের প্রযোজক-নির্দেশকের নামও উল্লেখ করতে হয়। তারা হলেন ব্রুকলিন নেটিভস বেনি ও র‌্যাফি ফাইন। এদের বলা হয় ফাইন ব্রাদার্স। ফাইন ব্রাদার্স সব বয়সের মানুষের জন্য বিভিন্ন কমেডি সিরিজ করে আসছে। উল্লেখ করতে হয় এপিক র‌্যাপ ব্যাটেলস হিস্ট্রি চ্যানেলের কথা। র‌্যাপ, স্যাটায়ার, কমেডি ইত্যাদি সহযোগে ইউটিউবের এপিক র‌্যাপ ব্যাটেলস হিস্ট্রি চ্যানেলের জনপ্রিয়তাও বিশ্বজুড়ে। ইনডিপেনডেন্ট ইউটিউব ফিল্ম চ্যানেলের মধ্যে ফিল্ম ইনডিপেনডেন্ট, ইন্ডিফিল্ম চ্যানেল, আইএফসি ফিল্মস, ইন্ডি ফিল্ম, ইউতো ইউরো আইএফসি, ইন্ডিফিল্ম হোস্টেল প্রভৃতি চ্যানেল বিশেষ জনপ্রিয়। মাই ভিডিও মিডিয়া, পিটার রুস, দ্য লাক্সারি ট্রাভেল এক্সপার্ট, ডকুমেন্টারি প্যানেল, ইন্ডিয়ান ইউটিউবারের মতো ইউটিউব ট্রাভেল চ্যানেলগুলো ভ্রমণ বিষয়ে অডিও-ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

দীপাংশু আচার্য

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক বাংলা ইউটিউব চ্যানেলের সংখ্যাও অজস্র। ঢাকা ও কলকাতার নতুন প্রজন্ম আজ ইউটিউবমুখী। তাদের যাপন এখন টিউবকেন্দ্রিক। তারা আদতেই টিউব জেনারেশন। এই যেমন টুম্পা খানের কথাই ধরা যাক। ‘অপরাধী’ গানটার বিশেষ একটা ভার্সন তৈরি করে গিটার হাতে নিজেই গাইলেন, আর তার ভিডিওগ্রাফি আপলোড করে দিলেন ইউটিউবে। ব্যস, সেই গান হয়ে গেল ভাইরাল। টুম্পা খানের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৬৯৫ জন। আর মোট ভিউয়ারের সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫৪। ইউটিউবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলাব্যান্ড ব্যাকস্টেজ কভার ও ছারপোকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যাকস্টেজ কভারের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৭৮। হাসন রাজাসহ বাংলার বেশ কিছু লোকসাধকশিল্পীর গান ফিউশনের আঙ্গিকে পরিবেশন করছে ‘ব্যাকস্টেজ কভার’। ‘মন আমার দেহঘড়ি’, ‘লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার’, ‘বাউলা কে বানাইলো রে’ ইত্যাদি গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘ছারপোকা’ ব্যান্ডের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ৩ লাখ ৮০ হাজার ৫০২। মোট ভিউয়ার ২ কোটি ৮৭ হাজার ৫২০। ‘বাড়ির পাশে মধুমতি’, ‘আমার কাছে তুমি মানে’, ‘হাতবদল’, ‘চান্দে’ প্রভৃতি গানের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘ছারপোকা’ আজ একটি আইকনিক বাংলাব্যান্ড। রবীন্দ্রসংগীত কিংবা পুরোনো বাংলা রোম্যান্টিক গানের ফিউশনের চমকপ্রদ গায়কী ও নজরকাড়া প্রেজেন্টেশন নিয়ে বাংলা ইউটিউব দুনিয়ায় মাহতিম সাকিব অনন্য এক সংগীতশিল্পী। তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ৩ লাখ ৮ হাজার ৯৫০। শর্ট ফিল্ম, টক শো, ফিল্মি আলাপ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের ‘ভাই ব্রাদার্স’ ইউটিউব চ্যানেলটি ব্যাপক জনপ্রিয়। তাদের চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার প্রায় সাড়ে ৪ কোটি।

সোমতীর্থ নন্দী

অন্যদিকে আয়মান সাদিকের মোটিভেশনাল বা প্রেরণামূলক ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং-সংক্রান্ত ইউটিউব চ্যানেল ‘টেন মিনিট স্কুল’-এর সাবস্ক্রাইবার ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৭৬। ট্রেন্ড টেকনোলজি সংক্রান্ত চ্যানেল ‘ইউটিউব বাংলা’র জনপ্রিয়তা অবশ্য এগুলোর থেকে অনেক বেশি। ৬ লাখ ১২ হাজার ৫৯৭ সাবস্ক্রাইবার তাদের। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ইউটিউব চ্যানেল ও ইউটিউবারদের জনপ্রিয়তাও খুব কম নয়। ‘গান আবহমান’, ‘গান-টান’-এর মতো ইউটিউব চ্যানেলগুলোকে কেন্দ্র করে রুফটপ কনসার্ট দুই বাংলাতেই জনপ্রিয়। এই চ্যানেলগুলোয় ভর করে দেবদীপের মতো শিল্পীদের উত্থান। বাংলা গানের নতুন লিরিক ও নতুন কম্পোজিশনে দেবদীপরা আবার একটা বাঁকবদল ঘটিয়েছেন। পলিটিক্যাল স্যাটায়ার নির্ভর বুদ্ধিদীপ্ত এক্সপেরিমেন্টাল ইউটিউব চ্যানেল ‘লেট-৬৬-এ’র নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। কবি, গীতিকার, আরজে দীপাংশু আচার্য আর ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার অনমিত্র রায়রা এই চ্যানেল চালান। বাংলার লোকগান সংগ্রহের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সোমতীর্থ নন্দীর ইউটিউব চ্যানেলটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে।
পরিশেষে
গণজ্ঞাপন, গণসংযোগ ও স্বাধীন পেশা, শিল্পযাপন- এসবের মেলবন্ধনে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে ইউটিউব ও তার টিউবার জেনারেশন। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখা দরকার, মাধ্যম সহজলভ্য বলে যদি কোনো রকম অনুশীলন ও চর্চা ছাড়া সবাই এই মাধ্যমে ভিড় করেন, তাহলে একে ঘিরে গড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের যাপন একসময় থমকে যাবে। তাই শিক্ষা, রুচি, পরিমিতির ছাপ রেখে সচেতনভাবে ইউটিউব ব্যবহার করা প্রয়োজন।
নতুনের জয় হোক।

মডেল: রাবা খান
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারী: জড়োয়া হাউজ
ওয়্যারড্রোব: সিকোসো
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top