ঘরেবাইরে I থিমনির্ভর
ভাবনা যখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ডিজাইনারের কাজে, তখন এর আবেদন ও অনন্যতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জীবনধারার বৈচিত্র্য আর আকর্ষণীয় দিকগুলো কাজে লাগিয়ে যাপনচিত্র পাল্টে দিতে চান ডিজাইনাররা। নতুন সব ভাবনাকে তাদের মূল হাতিয়ার বানিয়ে নেন। আর সেটাকেই আমরা বলি থিমনির্ভর অন্দরসজ্জা।
বৈশ্বিকভাবে আজকাল এটি ব্যাপক জনপ্রিয়। থিম ‘বস্তু’ বা ‘অবস্তু’ যা-ই হোক না কেন, তার প্রকাশ কিন্তু বস্তুগতই। এই ডিজাইনে থিমই ঠিক করে দেয়, কী হতে চলেছে। অর্থাৎ, ডিজাইনের বিশাল পরিসীমা তাতে সীমিত করে তোলা হয়। সে চেষ্টাই করা হয়, থিমটি যেন যথাযথভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারে। দিতে পারে এমন নির্দেশনা, যা একটি পরিবারের জীবনযাপনে সহজতা আনে। সব বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটে থিমের মাঝেই। অর্থাৎ, দৃশ্যগতভাবে আমরা কী অনুভূতি পেতে পারি, সেখান থেকে আমরা কী ধারণা পাবো, তা থিমই ঠিক করে দেয়। এর বাইরে সেখান থেকে দ্বিতীয় কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই। ডিজাইনের সূত্র এই ‘থিম’ এবং ‘কনসেপ্ট’ কিন্তু এক নয়। থিম হলো অনেকখানি বস্তুকেন্দ্রিক। সেখানে কনসেপ্ট একটি ধারণা। যেহেতু চূড়ান্ত প্রকাশ হলো অন্দরসজ্জা, শেষ রূপটি তাই বস্তুগত। দুটোরই প্রকাশ ঘটছে ডিজাইনারের সৃষ্টিশীলতায় ভর করে। অন্দরসজ্জার মূল তত্ত্ব থেকে কিন্তু একেবারেই সরে যায় না থিমনির্ভর ভাবনা। ডিজাইনারকে আলো, রঙ, টেক্সচার, আসবাব, কাঠামো, জায়গার ব্যবহার, ত্রিমাত্রিক নান্দনিক সজ্জা প্রয়োগ নিয়েই কাজ করতে হয়। সেখানে ভারসাম্য, ছন্দ, সামঞ্জস্য, মার্জিত, প্রাধান্য, আনুপাতিক সামঞ্জস্য নিশ্চিত করাও জরুরি। অন্দরসজ্জা মূলত এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে শৈল্পিকতা ও বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে হয়। কারণ, মানুষের কাজকর্মের জায়গাটি যথাযথ বিচার-বিশেøষণেই সাজিয়ে তোলা হয়।
সম্প্রতি ঢাকায় বেড়েছে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা। সাইকেল এমন এক বাহন, যা সহজলভ্য, যাতে কোনো দূষণ নেই, সকলেই চালাতে পারে এবং শরীরের জন্য বেশ উপকারী। ফাস্ট ফুডের যুগে আমাদের শিশু-কিশোরেরা যখন ব্যাপক মাত্রায় ওবিসিটিতে আক্রান্ত, তখন সাইকেলই পারে তাদের স্বাস্থ্যকর সঙ্গী হতে।
ঢাকার অলিগলিতে এই উঠতি তারুণ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ইদানীং নানা রকমের থিমে কাজ হচ্ছে। কোথাও থিম হচ্ছে মোটরসাইকেল, কোথাওবা ভ্যাম্পায়ার থিম আবার কোনোটা হসপিটাল। সেভাবেই কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়- এই ভেবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে একটি রেস্তোরাঁ। এর মালিকেরাও সাইকেল চালান। ভোজনালয়টির ডিজাইনার স্থপতি সিয়াম সাজিদ নিজেও সাইকেল চালান। কেউই পূর্ব পরিচিত নন, কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে তারা নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। এই রেস্তোরাঁ গোছানো হয়েছে খুব যত্নের সঙ্গে। নাম থেকে শুরু করে লোগো, অন্দরসজ্জা- সবই। মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছে এই রেস্তোরাঁ নাম ‘ট্যুর দে সাইক্লিস্ট…’। নামটি এসেছে ফ্রান্সের ‘ট্যুর দ্য ফ্রঁস’ থেকে। এটা এমন এক উৎসব, যাতে ফ্রান্সের সাইকেলপ্রেমীরা কয়েক দিন ধরে সাইকেলের রেস করে থাকেন দেশজুড়ে। এই বিশেষ দ্বিচক্র যানটির প্রথম খোঁজও মেলে ফরাসি সাহিত্যে। যদিও আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানি এই দাবি করে থাকে। বিশ্বব্যাপী সবার ভালোবাসার এই যান সম্প্রতি পৃথিবীর বুকে তার ১৫০ বছর পূর্ণ করেছে।
মাত্র সাড়ে চার শ বর্গফুটের এই ছোট্ট জায়গাটি রেস্তোরাঁ হিসেবে চালানোর জন্য গৎবাঁধা নিয়মের দিকে এগোলে ডিজাইনারের দরকার পড়ত না। উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ও ডিজাইনারের বিচক্ষণতা কাজটিকে নিয়ে গেল অন্য এক মাত্রায়। প্রথমত থিমের কাছে সমর্পণের ফলে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সাইকেলকে ঘিরে এবং তার নানা অংশ উদ্যাপন করাই তখন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে চমৎকার রঙের প্রয়োগ রেস্তোরাঁর অন্দরে দিল এক আলাদা মাত্রা। বিভিন্ন আঙ্গিকে কিছু আসন খেয়াল করলে সেগুলোর পৃথক সত্তা দ্রষ্টব্য হয়ে যায়। আবার সেই আলাদা সত্তাদের যদি একক রেস্তোরাঁ হিসেবে ভাবা হয়, তাহলে মনে হবে তারা একই ছন্দে বাঁধা। একেই হয়তো বলে বৈচিত্র্যের ঐক্য।
অথচ এই সুন্দর জায়গাটা দেখলে কে বুঝবে, এখানে আগে ফ্রিজ সারাই করা হতো! নষ্ট ফ্রিজগুলো পড়ে থাকত এখানে। ফলে জায়গাটিকে শুরু থেকেই রেস্তোরাঁ হিসেবে গড়ে তোলার সুবিধাটা কিন্তু ডিজাইনার পাননি। কতজন একবারে সেবা পাবে, কতখানি জায়গা নিয়ে রান্না হবে- এসব ভাবনায় কোনো ছাড় না দিয়ে ডিজাইনার নান্দনিক চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি জায়গাটা নিয়ে নানাভাবে খেলা করেছেন। সাইকেলে চড়ে আমরা যা করে থাকি। অচেনা অজপাড়াগাঁয়ে আমরা যেমন দুই চাকার উপর ভর করে ছুটে যাই আর আবিষ্কার করি নতুন সব মানুষ, রাস্তা, জঙ্গল বা ঘাট। দুই চাকার গতির বদৌলতে পাল্টে যেতে থাকে দুই পাশ। সে রকম করেই দেয়ালে আঁকা ছবিতে দেখা যায় সাইকেলের চাকায় আছে দুনিয়ার ম্যাপ। সাইকেলে বিশ্ব ঘুরে বেড়ানো যখন নেশা, তখন সেই ছোঁয়া অতিথিদের মাঝেও আসবেই।
ফ্রেশ খাবারের সঙ্গে ফ্রেশ চাহনি নিশ্চয় অতিথিদের মন ভরিয়ে দেয়। নগরজীবনের রোবটিক কায়দায় চলতে চলতে প্রতিটা মানুষ দিন শেষে খোঁজে একটু তৃপ্তি। সেটা হোক একা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে। সেই জায়গা স্মৃতির সঙ্গে নিজ পরিচিতিকে যদি তুলে ধরে, তাহলে কি আর অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার পড়ে! থিমনির্ভর অন্দরসজ্জার এইটাই হলো চমক। যা নিয়ে যায় কোনো এক বিশেষ আবহে, বাস্তব থেকে মুহূর্তে সরিয়ে নেয়। এ ডিজাইনারের কৃতিত্ব বিচ্ছিন্ন অপ্রাণকে সাজিয়ে-গুছিয়ে তিনি এক পূর্ণাঙ্গ প্রাণ তৈরি করতে পেরেছেন। রেখেছেন শ্রদ্ধামনস্কতার স্বাক্ষরও। সাইকেল আরোহী চিত্রগ্রাহকদের কাছ থেকে অনুমতিসহ ছবি নিয়ে তাদের টাঙিয়ে দিয়েছেন রেস্তোরাঁর দেয়ালে।
সাইকেলকে চিন্তার কেন্দ্রে রেখে আগেও অনেক রেস্তোরাঁ হয়েছে নানা দেশে এবং খুব সম্ভবত বাংলাদেশেও। কিন্তু কিছু সাইকেলপ্রেমী, মালিকপক্ষ এবং ডিজাইনার পক্ষের সীমিত পরিসরে এমন অসামান্য কাজ বোধ হয় আর একটিও নেই। না হলে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে ফুটপাতে দেখা মিলত না বিশাল এর গ্রাফিতির, যেখানে দেখা যায় একজন সাইকেল আরোহী পুরো শহরে স্বপ্ন ছড়িয়ে চলেছে।
লেখক: সুপ্রভা জুঁই
ছবি: আশরাফ উদ্দিন ও স্থপতি সিয়াম সাজিদ