ফুড বেনিফিট I তাল তালিমি
এ মৌসুমে তালের সঙ্গে তাল মেলাতে পারলে শরীর থাকবে সতেজ। পুষ্টি, স্বাদ আর পথ্যের গুণে
বছর ঘুরে পাকা তালের মোহময় গন্ধই জানান দেয় এখন ভাদ্র মাস। সব ঋতুতেই বাংলার প্রকৃতি তার বনবাদাড় সাজিয়ে রাখে রসাল ফলের স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য দিয়ে। তাতে ভাদ্রের পরিবেশনা পাকা তাল। কাঁচা তাল শেষ হয়ে যায় শ্রাবণেই।
ভাদ্রে পাকে বলে তালকে ভাদুরে ফলও বলে। লোকমুখে শোনা যায়, এ মাসে পরিবারের সবাই মিলে তাল খেলে সারা বছর তারা এক তালে চলতে পারে। এটা কথার কথা হলেও তাল খাওয়ার অনেক উপকারিতা আছে। সেটা কাঁচা তালের শাঁস হোক, তাল পাতার ডাঁটা হোক, শিকড় হোক কিংবা পাকা তাল।
বাঙালিরা পাকা তাল দিয়ে মুখরোচক খাবার তৈরি করে। তালের বড়া, তালের পিঠা, তালের ক্ষীর বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার। এগুলো সুস্বাদু খাদ্যগুণেও অসামান্য।
তালশাঁস থেকেই শুরু করা যাক। অনেক অঞ্চলে একে তালের চোখও বলে। এশিয়াজুড়ে তালের শাঁস বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। পুষ্টিগুণে এটি নারকেলের প্রতিযোগী। প্রতি ১০০ গ্রাম তালের শাঁসে রয়েছে ৮৭ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৮৭.৬ গ্রাম, আমিষ ০.৮ গ্রাম, ফ্যাট ০.১ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১০.৯ গ্রাম, ফাইবার ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩০ মিলিগ্রাম, লৌহ ১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন ০.০৪ গ্রাম, রিবোফ্লোভিন ০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৫ মিলিগ্রাম। এসব উপাদান নানা ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করে।
তীব্র গরমে তালশাঁস প্রশান্তিকর। এর জলীয় অংশ শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে। এটি শরীরের ক্লান্তি দূর করে। খাওয়ার রুচি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। এর কারণ, তালের শাঁস ভিটামিন সি ও বি কমপ্লেক্সের আধার। তা ছাড়া আছে ভিটামিন এ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি তীক্ষè করে, এটা সবারই জানা। আর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যাদের সব সময় বমি ভাব থাকে, তালের শাঁস তাদের জন্য আশীর্বাদ। লিভারের সমস্যাও এতে দূর হয়। কচি তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূর করে।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কাঁচা তালের শাঁস ও পাকা তালের আঁটির কদর আছে। চর্মরোগে পাকা তালের শাঁসের প্রলেপ দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। শাস্ত্র আরও বলছে, শরীরের দূষিত ক্ষতস্থানে তালের শাঁস ও চালের গুঁড়া মিশিয়ে অল্প গরম করে তৈরি করা ‘পুলিটস’-এর প্রলেপ দিলে ক্ষত সেরে যায়।
তালের ফুলের উপকারের উল্লেখ রয়েছে আয়ুর্বেদে। এর পুষ্পদন্ড পোড়ানো ছাই, গলা ও বুক জ্বালাপোড়া নিবারণে ব্যবহার করা হয়। অনিদ্রাজনিত রোগ দূর করতে ব্যবহার করা হয় কচি তালপাতার ডাঁটা। এ জন্য ডাঁটাকে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে মাঝখানে সামান্য থেঁতলে নিয়ে, আগুনে সেঁকে, ডাঁটার দুই প্রান্ত দুই হাত দিয়ে ধরে মোচড় দিয়ে রস বের করে নিতে হবে। সেই রস দুই থেকে তিন চামচ নিয়ে তাতে দুধ মিশিয়ে খেলে অনিদ্রাজনিত সমস্যা দূর হয়ে যায়।
এ তো গেল তালের শাঁস, ফুল ও ডাঁটার পথ্য। খেজুরগাছের মতো তালগাছ থেকেও রস পাওয়া যায়, বাসি হয়ে গেলে একে ‘তাড়ি’ বলা হয়। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় সেটিরও ব্যবহার আছে। বিশেষ করে ‘বাচালতা’ দূর করতে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাদের কথায় দাঁড়ি-কমার বালাই নেই। একবার শুরু করলে থামতেই চান না। তাতে প্রশমিত করতে পারে টাটকা তালের রস। এক কাপ করে দুবেলা পান করালে বকবকানি দূর হয়ে যাবে। টাটকা রস নারীদের ক্ষয়রোগ নিরসনেও কাজে আসে। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে পান করলেই হলো। অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করতেও তালের রস বিশেষভাবে কার্যকর। তা ছাড়া তালের রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন টাটকা থাকে।
তাড়ি যে কোনো কাজে আসে না, তেমন নয়। গনোরিয়ার পথ্য হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে তাড়ি যখন ফেনাযুক্ত থাকে, সে সময় পান করতে হয়। তবে প্রতিবার সাত থেকে আট চামচের বেশি নয়। নিয়মিত পান করলে গনোরিয়া দূর হয়।
মাথা ধরার চিকিৎসায় আয়ুর্বেদে তালগাছের চারার মাথি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তিন থেকে চার বছর বয়সের তালগাছের চারার মাথির সাত থেকে আট গ্রাম বেটে নিন। এরপর এক কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে পরিষ্কার পাতলা কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে মিশ্রণটি প্রতিদিন সকালে খেতে হবে। এটি পান করলে মাথা ধরার সমস্যা দূর হওয়ার পাশাপাশি কম শ্রমে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ার প্রবণতাও দূর হবে।
অম্ল, অজীর্ণ ও পেটের ব্যথা উপশমে কাঁচা তাল টুকরা করে কেটে, শুকিয়ে হাঁড়িতে ভরে ঢেকে পোড়াতে হবে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় অন্তর্ধুমে পোড়ানো। তালের টুকরাগুলো পুড়ে যখন পাংশু অর্থাৎ সাদাও নয় আবার কালোও নয়, এমন রঙ ধারণ করবে, তখন তা মিহি করে বেটে সকালে ও বিকেলে আধা গ্রাম করে খেতে হবে। এই গুঁড়া সকালে খালি পেটে ও বিকেলে পানিসহ খাওয়ার নিয়ম। এটি খেতে থাকলে অম্ল, অজীর্ণ ও পেটের ব্যথা দূর হবে। কাঁচা তালের এই গুঁড়ার সঙ্গে খানিকটা পুরোনো গুড় মিশিয়ে খেলে উদরী প্লীহা দূর হয় বলে জানিয়েছেন আয়ুর্বেদিকেরা।
যেকোনো কারণে প্রস্রাব আটকে গেলে পথ্য হিসেবে কাজ করবে তালগাছের কচি শিকড়ের রস। সকালে ও বিকেলে দুই থেকে তিন চামচ করে এটি নিয়মিত পান করতে হবে। তবে প্রোস্টেট গ্লান্ডের বৃদ্ধির কারণে মূত্ররোধ হলে এই রস কোনো কাজ করবে না।
কাঁচা তালের মতোই পাকা তাল গুণে ও পুষ্টিতে টইটুম্বুর। পাকা তালের প্রতি ১০০ গ্রামে জলীয় অংশ থাকে ৭৭.৪ গ্রাম, আমিষ ০.৮,শকর্রা ২০.৯, চর্বি ০.৪, খনিজ ০.৭, আঁশ ০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম প্রায় ৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ৫ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ৮৮ কিলোক্যালরি। তাল ভিটামিন ‘বি’র আধার। ভিটামিন ‘বি’র অভাবজনিত যেকোনো রোগ প্রতিকারে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাকা তালের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম। আলঝেইমার কিংবা ডিমেনশিয়ার প্রশমনে এবং হৃদপিন্ডের সুস্থতায় তাল বিশেষ উপকারী। পাকা তাল কৃমি দূর করে। এ ছাড়া লিভারের টনিক হিসেবেও তাল বিশেষ উপকারী। এতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক। অন্ত্রের যেকোনো রোগ দূরীকরণে পাকা তালের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুতরাং, এ ঋতুতে তালের সঙ্গে তাল মেলাতে পারলে জিভের সুখ যেমন মিলবে, তেমনি সুস্থও থাকা যাবে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট