ফুড বেনিফিট I বাতাবি লেবু
শরীরের সুস্থতা কেবল নয়, রূপচর্চায়ও এর কার্যকারিতা অসামান্য
পৃথিবীতে সাইট্রাস বর্গের প্রায় ৫০ প্রজাতির লেবু আছে। বাতাবি লেবু সেগুলোর একটি। ধারণা করা হয়, এর আদি ভূমি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। অনেকেই বলেন এর উৎপত্তি বাটাভিয়ায়। সে জন্যই সম্ভবত বাংলায় একে ‘বাতাবি লেবু’ বলা হয়ে থাকে। তবে জাম্বুরা নামেও পরিচিত।
এ ফল পাওয়া যায় ভারত, চীন, জাপান, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, এমনকি আমেরিকাতেও। আলাদা জায়গায় আলাদা রকমের রঙ, গন্ধ আর স্বাদ। কোথাও কোথাও এর ভেতরের রসাল কোষগুলো হলুদ হয়। আবার লাল বা গোলাপি হয়। একেকটি লেবুর ওজন গড়ে ১ থেকে ২ কেজি হতে পারে। এটি ভিটামিন সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর। প্রতি ১০০ গ্রাম বাতাবি লেবুতে খাদ্যশক্তি আছে ৩৮ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ০.৫ গ্রাম, স্নেহ ০.৩ গ্রাম, শর্করা ৮.৫ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ১ গ্রাম, থায়ামিন ০.০৩৪ মিলিগ্রাম, খনিজ লবণ ০.২০ গ্রাম, রিবোফ্লাভিন ০.০২৭ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.২২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.০৩৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১০৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ১২০ মাইক্রোগ্রাম, আয়রন ০.২ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৭ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৬ মিলিগ্রাম, ম্যাংগানিজ ০.০১৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২১৬ মিলিগ্রাম ও সোডিয়াম ১ মিলিগ্রাম।
এসব পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ বাতাবি লেবু বিভিন্ন রোগের প্রতিকারে সক্ষম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষেধকও বটে। যেমন ক্যালরি কম থাকায় এটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও স্থূলকায় ব্যক্তিদের জন্য খুবই উপকারী। এতে অদ্রবণীয় আঁশ আছে, যা বিপাক ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে শরীরের ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া বাতাবি লেবুতে কারনিটিন পমিটয়েলট্রানসফারেজ নামের একধরনের উৎসেচক থাকে। এটিও শরীরের ওজন কমাতে সহায়তা করে। তিন মাসের মধ্যে শরীরের ওজন দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত কমাতে চাইলে খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে এক গ্লাস বাতাবি লেবুর রস পান করুন। নিয়মিত এটি করলে শরীরের ওজন কমবে। পাশাপাশি এ লেবু খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং হজমের সমস্যার প্রতিকার হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তথা উন্নত ইমিউন সিস্টেম শরীর সুস্থ রাখে। এ সিস্টেম উন্নত করতে প্রয়োজন ভিটামিন সি। পূর্ণবয়স্ক কোনো ব্যক্তির শরীরে দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন, বাতাবি লেবুতে তার চেয়ে বেশি আছে। অর্ধেক লেবু খেলেই শরীরের মোট ভিটামিন সির চাহিদার ৭৮ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। এ কারণেই ঠান্ডা ও সর্দি-কাশি সমস্যা দূর করতে এই ফল বেশ কাজে আসে। ভিটামিন সি থাকার কারণে এটি মাড়ির রোগও দূর করে। নিয়মিত বাতাবি লেবু খেলে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যা দূর হয়। এ ছাড়া শরীরের ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এটি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপের তারতম্য ঘটে। ফলে অনেকেই রক্তচাপজনিত রোগে ভোগেন। এ ছাড়া হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। বাতাবি লেবু খেলে রক্তনালি প্রসারিত হয়, ফলে রক্তচাপ কমে। হৃদপিন্ড ভালো থাকে। এ লেবুতে থাকা পটাশিয়াম হৃদপিন্ড ভালো রাখার কাজটি করে। তা ছাড়া এতে পেকটিন থাকে বলে এটি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদ্্রোগের কবল থেকে মানবদেহের সুরক্ষা দেয়। এ লেবু রক্তের লোহিত কণিকাকে টক্সিন ও অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে রক্ষা করে বিশুদ্ধ অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে। ডিটক্সিফিকেশনে এর ভূমিকা অসামান্য। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে কাজ করে। এ জন্য প্রতিদিন এক গ্লাস বাতাবি লেবুর জুস পান করাই যথেষ্ট। প্রোস্টেট ক্যানসার কোষের ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএর মেরামতেও সাহায্য করে এটি। তা ছাড়া এ ফলের বায়োফ্ল্যাভোনয়েড ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁঁকি কমায়। এর ফ্ল্যাভোনয়েড ফুসফুস ও মুখগহক্ষরে ক্যানসার হওয়া থেকে রক্ষা করে। পাকস্থলীর ক্যানসার থেকেও সুরক্ষা দেয়।
বাতাবি লেবুতে প্রচুর ভিটামিন এ থাকায় এটি দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করার গুণ রয়েছে। লেবুতে নারিনজেনিন নামে একধরনের যৌগ আছে, যা কিডনিতে সিস্ট হওয়া প্রতিরোধ করে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি কিডনির সিস্ট গঠনে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি কিডনির ফোলা কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যারা অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভুগছেন, বাতাবি লেবু তাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। প্রতি ১০০ গ্রাম জাম্বুরায় বিটা ক্যারোটিন থাকে ১২০ মাইক্রোগ্রাম। ভিটাবিন বি তো আছেই। এসব উপাদান অ্যাসিডিটির বিরুদ্ধে কাজ করে শারীরিক অস্বস্তির হাত থেকে রক্ষা করে। হাড় শক্ত করারও দারুণ দাওয়াই বাতাবি লেবু। আমাদের শরীরে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সোডিয়ামের অভাব হলে অস্টিওপোরোসিসসহ হাড়ের নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়। জাম্বুরা এসব খনিজ উপাদানে ভরপুর। এ ফলের স্যালিসাইলিক অ্যাসিড শরীরের অজৈব ক্যালসিয়াম ভাঙতে সাহায্য করে। ফলে তা কার্টিলেজ ও জয়েন্টে জমাট বাঁধতে পারে না। ফলে আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। প্রতিদিন এক গ্লাস বাতাবি লেবুর রসের সঙ্গে এক চা-চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে পান করলে আর্থ্রাইটিস নিরাময় হয়।
শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিচর্যা ছাড়াও রূপচর্চায় এ লেবুর উপকারিতা অফুরন্ত। যেমন বুড়িয়ে যাওয়া রোধে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বয়স ধরে রেখে বুড়িয়ে যাওয়াকে বিলম্বিত করে। লেবুতে স্পারমেডিন নামের একধরনের বিশেষ উপাদান আছে, যা বার্ধক্য রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া এর ভিটামিন সি ত্বকের বলিরেখা দূর করতে সক্ষম। এ লেবুর রস ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে ময়লা ও মরাকোষ দূর করে। এর ফলে ত্বক নরম ও মসৃণ হয়। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মলিন ত্বকে উজ্জ্বলতা আনে। বিশেষ করে রোদে পোড়া দাগ দূর করতে চাইলে ত্বকে এ লেবুর রস মাখলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড ব্রণ ও মেছতা দূর করে। ত্বকের তেলতেলে ভাব দূর করতেও এর রস উপযোগী। এ ছাড়া বাতাবি লেবুর রস পানিশূন্যতা দূর করে। ত্বক টানটান রাখে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট