skip to Main Content

ঘরেবাইরে I ম্যাক্সিমালিজমের অভিষেক

মিনিম্যালিজম পেরিয়ে আধিক্যকে সহজ করে সাজিয়ে তোলার ট্রেন্ড শুরু হলো। এই অন্দরসজ্জা জীবনের সব প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়ার জন্য

২০১৮ সালে অন্দরসজ্জার প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশ এবং এর বাইরে কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এগুলোর মধ্যে কোনটা ভালো বা কোনটা মন্দ, সেই বিচারে না গিয়ে সেসব চিনতে পারা বিশেষ জরুরি। অন্দরসজ্জা দিয়েই একটি সময়কে আমরা ধরতে পারি। স্থাপত্যের পরে সব থেকে গভীরভাবে মানুষের রোজকার কাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্দরসজ্জা। তাই এই সময়ের সাপেক্ষে দাঁড়িয়ে জগৎকে কীভাবে দেখছি, সেটিই ফুটে উঠছে আমাদের অন্দরসজ্জায়। মানুষের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে হাসপাতাল, দোকানপাট, শপিং মল, সিনেমা হল- কিসে এর প্রভাব দেখা যায় না! এমনকি সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পুরোনো ভবনের মাঝেও নতুন করে অন্দরসজ্জা হয়, যাতে এর উপযোগ যায় বেড়ে। কেবল বাসাবাড়ি নয়, নতুন নতুন চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে পুরোনো দোকানপাটও নতুন করে সাজানো হচ্ছে এই আশায়, যেন একঝাঁক নতুন ক্রেতা আকৃষ্ট হয়।

দেখা যাক অন্দরসজ্জায় বিশ্বজুড়ে কী কী চমক এলো এ বছরে-
অন্দরে ‘কালো’ রঙের আধিপত্য দেখা যায়। কালো দেয়াল, কালো আসবাব, কালো প্রিন্ট, এমনকি কালো বাথরুম ও টয়লেট ফিক্সারও এ বছর জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রকৃতিকে অন্দরে নিয়ে আসার ট্রেন্ডটাও দেখার মতো। শুধু সবুজ গাছপালা নয়, কাঠের ফার্নিচারকে যতটা সম্ভব কাঠের কাছাকাছি রেখে ব্যবহার করা নিয়ে ভাবা হয়েছে। ‘পরিবেশবান্ধব’ চিন্তাটি এ মুহূর্তে সবখানেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই রেশ ধরে অন্দরসজ্জায় এই চিন্তাগুলো প্রকট হয়েছে। পাথর, নুড়ি পাথর, পানি ইত্যাদির মাধ্যমে অন্দরসজ্জায় প্রাধান্য পাচ্ছে সচেতন মানুষের জীবনাচার। আঁকাবাঁকা বস্তুর প্রয়োগ উঠে গেছে। মানে, যত সহজ হওয়া যায়। উত্তরাধুনিক চিন্তায় আবার ফেরত আসছে ভোঁতা প্রান্ত এবং বাঁকা কিনার। ফার্নিচারে এই বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আলোর সাহায্য না নিয়ে খুব কড়াভাবে রঙ ও টেক্সচার দিয়ে মেঝে আর সিলিংকে চিহ্নিত করাও ছিল এ বছরের আরেকটি ট্রেন্ড।

রঙের প্রাধান্য থাকছেই। সেদিক থেকে প্রকৃতিতে যেসব রঙ প্রকট, ঘরের মাঝেও সেসব নিয়ে আসা হলো। মাটির নানা রঙ, নানা রকমের সবুজের ছায়া ছেয়ে গেছে অন্দরমহল। সবুজ গাছের অন্তর্ভুক্তি দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পুরোনো ট্রেন্ড থেকে ফিরে এসেছে প্রিন্ট করা দেয়ালের কাগজ, যা নিমেষেই একঘেয়েমি দূর করে দিতে পারে। স্থায়ী নয় বলে ইচ্ছেমতো একে বদলানো যায় আর প্রক্রিয়াটাও সহজ। ডিজাইনাররা এ বছরে একজন ব্যবহারকারীর জায়গা থেকে ভেবে কাজ করার চেষ্টা করেছেন বেশি। ফলে কাজগুলো আরও ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে, মৌলিক হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। ‘নিরপেক্ষ’ চিন্তা থেকে অন্দরসজ্জায় কিছু উপাদানের সহাবস্থানের দেখা মিলেছে। মেঝে দেয়াল সব মিলিয়ে এক রঙের সহজ ভাবের উষ্ণতার আভাসও ছিল অনেক কাজেই। বিশুদ্ধ জ্যামিতিক নকশার আসবাবের জনপ্রিয়তা বহুকাল ধরেই অব্যাহত। মেঝে, দেয়াল এবং ঘরের সিলিংয়ের নকশাতেও এর প্রভাব ছিল দেখার মতো। যত দিন যাচ্ছে ততই বোহিমিয়ান অন্দরসজ্জা জনপ্রিয় হচ্ছে। তা একদিক থেকে স্বাভাবিকও বটে। জীবিকার তাগিদে ছোটার মাত্রা তো ক্রমশই বাড়ছে। ফলে বাড়িতে দেখা যায় চকমকে প্রিন্টের চাদর, সাদামাটা ও মজবুত নয় এমন আসবাব। ‘মিনিম্যালিজম’কে ছাপিয়ে ‘ম্যাক্সিমালিজম’-এর সংস্কৃতি ২০১৮কেই বিশেষভাবে নির্দেশ করে। জবরজংকেও ছিমছাম করে সাজিয়ে নিয়েছেন ডিজাইনাররা। বিচিত্র উপাদানে ঠাসা একটি সাধারণ ঘর, কিন্তু কী আকর্ষণীয়! নানা কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে একটিমাত্র ঘর, এই সময়ের জটিল জীবনে ব্যক্তির সহজ হতে চাওয়ার প্রতিফলন যেন।
এ ছাড়া সেলিব্রিটিদের অন্দরসজ্জা নিয়ে ভক্তদের বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হওয়ায় তারাও যত্ন করে কাজ করছেন এবং নানা হোম ডেকর ম্যাগাজিনে নিয়মিত এর চর্চাও হয়ে আসছে। এ বছরে জেনিফার লোপেজ, কোর্টনি ও কিম কার্দেশিয়ান, টেইলর সুইফট, বিয়ন্সের বাড়ির স্থাপত্য ও অন্দরসজ্জা মায় লেডি গাগার বোলিং এলির ইন্টেরিয়র ছিল আলোচনার বিষয়।
ইদানীং বাংলাদেশেও সেলিব্রিটিদের আবাস বা কাজের জায়গা নিয়ে চর্চার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। অভিনয়শিল্পী ববিতার বাসভবনটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাড়িটির নকশা করেছেন সাতত্যের প্রধান স্থপতি রফিক আজম। কাজের শুরুতেই নান্দনিক নাটকীয়তা সৃষ্টির কথাটিই মনে এসেছিল স্থপতির। পুরো বাড়িটিকে দেখলে মনে হবে পানির উপরে ভেসে আছে। প্রবেশের সিঁড়িও ভাসমান। উল্লেখ্য, বাড়ির প্রবেশপথের ল্যান্ডস্কেপের জন্য আলাদা করে স্থপতি ও ডিজাইনাররা এখন কাজ করছেন। বিশুদ্ধ অন্দরসজ্জা বা স্থাপত্যের মাঝে ব্যাপারটি পড়ে না, কিন্তু নিঃসন্দেহে নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে এ বছরের সেরা ট্রেন্ড এটিই।
অন্দরসজ্জায় সহজ হওয়ার চর্চা এই মুহূর্তের বাংলাদেশের ট্রেন্ড। রঙ করা দেয়ালের প্রচলনও নতুন নয়। কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে নতুনভাবে দেখার একটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে এ বছর। গ্রাফিতি বিশ্বের দরবারে মানুষের শিল্প বলে পরিচিত। কোনো এলিটদের জন্য নয়, এই শিল্প নিজে প্রবেশ করেছে মানুষের মাঝে। বড় বড় রাস্তায় কিংবা পাবলিক প্লেসের ভবনগুলোর সুবিশাল দেয়ালে এর দেখা মেলে। অনানুষ্ঠানিক বিষয়াদি এতে ফুটে ওঠে বলে রেস্তোরাঁয় এই শিল্পের প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছেন স্থপতি সিয়াম সাজিদ। সারা দিনের কর্মব্যস্ততায় প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘরোয়া আমেজ তুলে ধরেছে এসব রেস্তোরাঁ। স্থপতি এ বছরেই দুটি রেস্তোরাঁয় এই চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এবং তাতে গ্রাফিতি তার সৃষ্টির রসদ খাদ্যরসিকদের কাছেও পৌঁছাতে পেরেছে। রেস্তোরাঁয় আলো ঝলমলে রঙিন এসব দেয়ালকে ধরে সেলফি তোলার চর্চাটি এখন সাধারণ বিষয়। এই স্থপতির চিন্তার প্রয়োগ ঘটেছে আবাসিক ভবনেও। একঘেয়ে অফ হোয়াইটের ট্রেন্ডকে চ্যালেঞ্জ করে উজ্জ্বল রঙের স্পষ্ট আর বলিষ্ঠ প্রয়োগও দারুণ সাড়া ফেলেছে। মজার ব্যাপার হলো, অতিথিরা এসে বাসাটির এই উজ্জ্বল দেয়ালের জায়গাটিকেই সেলফি কর্নার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এ এক দারুণ ট্রেন্ড হতে চলেছে। দেজা ভ্যু-এর কর্ণধার স্থপতি দিলারা আক্তার নিজের কাজ নিয়ে আমাদের বলেন, ভিনিয়ার বোর্ড ব্যবহারের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। এ বছরে তার করা বেশির ভাগ কাজের মধ্যে বিশেষ করে সিলিংয়ের কাজে ভিনিয়ার বোর্ডের চাহিদা ব্যাপক। কারণ এটি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। তিনি বলেন, জাঁকজমক, লতাপাতা ছাড়িয়ে এখন সবাই সহজ, সুন্দর, বাহুল্যবর্জিত নকশায় আগ্রহী হচ্ছেন। বৈশ্বিক পরিবর্তনের হাওয়া আমাদের মূল ব্যবহারকারীদেরও প্রভাবিত করেছে বলতে হয়। এখন প্রায় সব ক্লায়েন্টই ছোটখাটো গবেষকে পরিণত হয়েছেন।
এ ছাড়া বছরজুড়ে লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে বইয়ের তাকের ব্যবহার। যদিও অনেকের দাবি, এ নেহাতই শো-অফ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু অর্থবিত্তের প্রাচুর্যের চেয়ে বিরাট সুসজ্জিত বইয়ের তাক কিংবা বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ যদি বড়াই করার ব্যাপার হয়, সেটিও খারাপ কী! বসার ঘরের একটি বড় দেয়াল নিয়ে যেমন বইয়ের তাক হচ্ছে, তেমনি নানা ম্যাটেরিয়াল ও আকৃতির শোলা দেখা যাচ্ছে। তবে কাঠের ঐতিহ্য আর গুরুত্ব আগের মতোই অক্ষুণ্ন রয়েছে। ভালো কাঠ, ভালো ফিনিশিং এখনো অভিজাত। আলাদা করে কাঠের ফার্নিচার আর নয় বরং নির্মিত ঘরের মাঝেই নিজেদের ব্যবহারিক সুবিধামতো ডিজাইনার ক্যাবিনেট বানিয়ে নেওয়া হলো এই মুহূর্তের বড় ট্রেন্ড।
সব মিলিয়ে ২০১৮ ছিল সহজ হওয়ার লাইফস্টাইল। এর মধ্যে পরিণত ও পরিমিতি বোধের ছাপ স্পষ্ট। মিনিম্যালিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়িয়ে আধিক্যকে সাজিয়ে সহজ করার ট্রেন্ড শুরুর বছর এটি। ২০১৯-এর দিকে তাকালে আন্দাজ করা যায় সবুজ সচেতন পরিবেশবান্ধব অন্দরমহলের ডিজাইন বাংলাদেশে ব্যাপক হয়ে উঠবে।

 স্থপতি সুপ্রভা জুঁই
Shuprava.jui.arch@gmail.com
তথ্যসূত্র: ডেকর এইড, ফোর্বস, এল ডেকর
ছবি: সুপ্রভা জুঁই, সিয়াম সাজিদ, দিলারা আক্তার, রাইসা জিশা, ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top