টেকট্রেন্ড I নবরূপে আপেল
সম্প্রতি স্টিভ জবস থিয়েটারে নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে অ্যাপল। উন্মোচিত হয়েছে নতুন কিছু সেবা, যা গ্রাহকের খবর পড়া, টিভি দেখা, গেমিং থেকে শুরু করে লেনদেনের অভিজ্ঞতায়ও নতুনত্ব সঞ্চার করবে। লিখেছেন সৌমিত্র দাস
অ্যাপল নিউজ প্লাস
অ্যাপল সম্প্রতি চালু করেছে নতুন সংবাদ সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস ‘অ্যাপল নিউজ প্লাস’, যা আইফোনের পর্দায় এনে দেবে শতাধিক বিশ্বসেরা ম্যাগাজিন ও পত্রিকা।
এর আগে ব্র্যান্ডটির খবর পড়ার অ্যাপ, ‘অ্যাপল নিউজ’ উন্মোচনের পরই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরই একটি বর্ধিত সেবা হিসেবে চালু হলো ‘অ্যাপল নিউজ প্লাস’। মাসে মাত্র ১০ ডলার খরচ করে অনায়াসে পড়তে পারবেন টাইম বা ভোগের মতো যেকোনো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন। অনেকের মনে হতে পারে, কাগজের ম্যাগাজিন পড়ার আবেদন এতে পাওয়া যাবে না বা এটা ফোনে সাধারণ পিডিএফের পাতা সোয়াইপ করার মতো। ম্যাগাজিন পড়ার মজা যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য অ্যাপল নিউজ প্লাসের প্রতিটি ম্যাগাজিন সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। সংযোজন করা হয়েছে ‘লাইভ কাভার’, যাতে এই পত্রিকার কাভারের মডেলটি হয়ে উঠবে জীবন্ত। এ ছাড়া ছবি ও ফিচারের উপস্থাপন এমনভাবে করা হয়েছে, যেন আইফোন বা আইপ্যাডে পড়তে সহজ ও দৃষ্টিনন্দন হয়।
এ ছাড়া থাকবে প্রত্যেক গ্রাহকের পড়ার অভ্যাস ও পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করা প্রবন্ধ ও গল্প। শুধু ম্যাগাজিন পড়ার জন্য মাসে ১০ ডলার খরচ করা বেশি মনে হতে পারে। তবে কেউ যদি অ্যাপল নিউজ প্লাসের সব ম্যাগাজিন দোকান থেকে কিনে পড়তে চান, তাহলে তাকে প্রতি মাসে গুনতে হবে ৬৫০-৭০০ ডলার। সেখানে মাসে মাত্র ১০ ডলারে সব ম্যাগাজিন পড়তে পারা নিতান্তই সস্তা। অ্যাপল নিউজ প্লাসে এখনো বাংলাদেশি কোনো ম্যাগাজিন পাওয়া যাবে না। তবে দিনে দিনে সার্ভিসটির জনপ্রিয়তা বাড়লে দেশীয় ম্যাগাজিনও পেতে পারেন এর মাধ্যমে।
অ্যাপলের এই নতুন সার্ভিসের বদৌলতে লাভবান হবেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকেরাও। মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা এখনো অনেক ক্ষেত্রে সঠিক আর্থিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত। অ্যাপল নিউজ প্লাসের প্রসার এর অবসান ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অ্যাপল টিভি প্লাস
ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে ক্লান্ত? মন চাইছে টিভিতে নতুন কোনো শো দেখতে? অ্যাপল পণ্য ব্যবহারকারীদের জন্য টিভির পর্দায় এলো নতুন চমক, ‘অ্যাপল টিভি প্লাস’। অ্যাপলের নতুন ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস।
এই সেবা নতুন কিছু নয়, নেটফ্লিক্সের ব্যাপক প্রসারের কল্যাণে অনেকেই এখন ক্যাবল টিভির বদলে স্ট্রিমিং সার্ভিসের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশেও নেটফ্লিক্সের গ্রাহক নেহাত কম নয়, বাড়ছে দিন দিন। এর সরাসরি প্রতিযোগী হিসেবে ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিসের বাজারে প্রবেশ করতে চলেছে অ্যাপল।
জনপ্রিয় সিনেমা ও টিভি শো ছাড়াও অ্যাপল টিভি প্লাসে থাকবে প্রতিষ্ঠানটির তৈরি কিছু টিভি শো। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে স্টিভেন স্পিলবার্গ, জেনিফার অ্যানিস্টন, লিগালি ব্লন্ড তারকা রিজ ওয়েদারস্পুন এবং একুয়াম্যানের জ্যাসন মামোয়ার মতো সেলিব্রিটির সঙ্গে। এমনকি অপরাহ উইনফ্রেও আসছেন তার নিজের প্রোগ্রাম নিয়ে। এ ছাড়া কমেডি শো, শিশুতোষ অনুষ্ঠান যেমন সেসামি স্ট্রিটের নতুন পর্বগুলো পাওয়া যাবে অ্যাপল টিভি প্লাসে।
অ্যাপল টিভি প্লাস চালু হবে সেপ্টেম্বর নাগাদ। সাবস্ক্রিপশন ফি সম্পর্কে অ্যাপল এখনই কিছু জানায়নি। তবে সেটা প্রতিযোগী স্ট্রিমিং সার্ভিস নেটফ্লিক্স বা আমাজন প্রাইম ভিডিওর কাছাকাছি দামেই পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যে তাদের বেশ কিছু দর্শকনন্দিত শো এবং সিনেমা এনে স্ট্রিমিং ভিডিও সার্ভিসের বাজারে শক্তপোক্ত একটি জায়গা করে নিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, কীভাবে অ্যাপল নেটফ্লিক্সকে টেক্কা দিতে পারে নতুন শো এবং সিনেমার মাধ্যমে।
অ্যাপল আর্কেড
মোবাইল ফোনে খবর পড়া বা সিনেমা দেখা ছাড়াও আরেকটি কাজ আমরা কমবেশি সবাই করি, সেটা হলো গেমিং। আর আইফোন বা আইপ্যাডে এর মজাটা একদম ভিন্ন। শক্তিশালী প্রসেসরের আইফোন বা আইপ্যাডে কনসোল কোয়ালিটির গেমিংও উপভোগ করা যায় অনায়াসে। এমনকি, মোবাইল গেমিংয়ে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে অ্যাপলের আইওএস। আর এই অভিজ্ঞতাকে আরও নতুন ও সহজ করতে চালু হলো অ্যাপলের গেম সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস অ্যাপল আর্কেড।
গেমপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় প্রায়শই যে গেমগুলো থাকে, সেগুলোর অধিকাংশ কিনে খেলতে হয়। যারা প্রচুর খেলেন, তাদের জন্য প্রতিটি গেম আলাদা করে কেনা বেশ খরচসাপেক্ষ। পেইড গেমিংয়ের এই ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে অ্যাপল আর্কেডের আবির্ভাব। এখানে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট মূল্য দিয়ে সার্ভিসটি কিনে খেলা যাবে শতাধিক পেইড গেম, যত খুশি তত! এতে গেমারদের আলাদা করে সব গেম কেনার খরচ বাঁচবে।
অ্যাপল আর্কেডও আসছে সেপ্টেম্বরে। সার্ভিসের দাম সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।
অ্যাপল কার্ড
এতক্ষণ যত সার্ভিস নিয়ে আলোচনা হলো, সব কটিই কিনে ব্যবহার করতে হবে অ্যাপল পণ্য ব্যবহারকারীদের। এত কিছু কিনতে হবে, আর অ্যাপল গ্রাহকদের জন্য কেনাকাটাকে আরও এক ধাপ সহজ করে দেওয়া হবে না, তা কি হয়? ইতিমধ্যে মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেমের মধ্যে দুনিয়াব্যাপী জনপ্রিয়তায় রাজার মুকুটে আছে অ্যাপল পে। আর এই মুকুটে নতুন রত্ন হিসেবে যোগ হলো এর নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড ‘অ্যাপল কার্ড’।
‘অ্যাপল’ নামটার সঙ্গে ‘ক্রেডিট কার্ড’ শুনে ভাবতে পারেন, অ্যাপল কি ব্যাংক খুলে বসল নাকি! না, তা নয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকিং পার্টনার হিসেবে আছে আমেরিকান বিখ্যাত ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স। গ্রাহকের একাধিক ক্রেডিট কার্ড বহনের ঝক্কি কমাতে অ্যাপলের এই নতুন সেবার আগমন। গ্রাহক অ্যাপস পেতে গেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যাবে অ্যাপল কার্ড। অ্যাপল পে অ্যাপের মধ্যেই এটি থাকবে একটি ভার্চ্যুয়াল কার্ড হিসেবে। আগের মতোই গ্রাহক অ্যাপল পে সমর্থিত স্থানে এটি দিয়ে পেমেন্ট করতে পারবেন। ক্রেডিট কার্ডটিতে টাকা জমা, খরচ ইত্যাদি ব্যাংকিং সুবিধা শুধু অ্যাপ ব্যবহার করেই পাওয়া যাবে। আর গ্রাহক চাইলে টাইটেনিয়াম-নির্মিত সুদৃশ্য ফিজিক্যাল কার্ডও সঙ্গে রাখতে পারেন, যেখানে অ্যাপল পে নেই সেখানে ব্যবহারের জন্য।
অ্যাপল কার্ডের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার, এটি সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে। অর্থাৎ অন্যান্য ক্রেডিটে কার্ডের মতো এতে কোনো ফি নেই। এমনকি মাসের কখন, কত টাকা একবারে জমা করলে গ্রাহককে আলাদা সুদ গুনতে হবে না, সেটাও বলে দেবে অ্যাপ নিজেই। অ্যাপল কার্ড ব্যবহার করে পেমেন্ট করলে প্রতিবার গ্রাহক পাবেন সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক।
এর নিরাপত্তার বিষয়টিও অ্যাপল খুব জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। পেমেন্টের সব তথ্য শুধু গ্রাহকের আইফোনেই জমা থাকবে, ফেস আনলক বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট আনলক ব্যবহার করে গ্রাহক পেমেন্ট করবেন। এমনকি এই তথ্য অ্যাপল নিজেও দেখতে পাবে না। অ্যাপল কার্ড সার্ভিস চালু হচ্ছে চলতি মাসেই।
সাফল্যের পূর্বাভাস
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অ্যাপলের সব কটি গ্রাহক সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম রাতারাতি পণ্যের বাজারের ধরনই বদলে দিয়েছে। যেমন— ২০০১ সালে চালু হওয়া গান ডাউনলোডিং সার্ভিস ‘আইটিউনসের’ নাম। আইটিউনস আসার পরে সমগ্র সংগীতশিল্পেই ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। বর্তমানে ডিজিটাল সংগীত কেনার প্রধান মাধ্যম আইটিউনস। সেই সুনামের ধারাবাহিকতা অ্যাপল কি দেখাতে পারবে এই নতুন সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে? তবে এ মুহূর্তে এত কিছু না ভাবলেও চলবে। আপাতত আইফোনে অ্যাপল নিউজ প্লাস কিনে একটা ঝাঁ-চকচকে ম্যাগাজিন পড়তে বসে যান।