ঋতুপর্ণা সেন। কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ঋ সেন নামে বেশি পরিচিত। ফিল্ম, টিভি সিরিয়াল, টেলি ফিল্ম, বিজ্ঞাপনসহ অডিও ভিজ্যুয়ালের নানা শাখায় কাজ করেছেন। কাজ করছেন। ফিল্মের অনস্ক্রিনে তাঁকে খোলামেলাভাবে নানা সময় দেখা গেছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম ট্যাবুকে তিনি পাত্তা দেন না। ব্যক্তিগত জীবনযাপনেও যথেষ্টমাত্রায় স্বাধীন। তিনি ‘ক্যানভাস’-এর মুখোমুখি। তাঁর জন্য একগুচ্ছ প্রশ্ন পেশ করেছেন অতনু সিংহ। আর সেই সব প্রশ্ন সামনে রেখে তাঁর সঙ্গে ‘ক্যানভাস’ টিমের তরফে কথা বলেছেন সৈকত মল্লিক।
ক্যানভাস: অডিও ভিজ্যুয়ালের নানা শাখায় আপনি কাজ করেছেন, ফিল্ম থেকে শুরু করে সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, টেলিফিল্ম, অডিও ভিজ্যুয়ালের এই সব শাখাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ঋ: না, ইদানীং আমায় সব জায়গায় দেখা যায় না, একনাগাড়ে আমি বেশ কিছুদিন আর্ট ফিল্ম বলতে যা বোঝায়, সেসবে অভিনয় করেছি। একসময়ে টেলিভিশনে কাজ করেছি চুটিয়ে, সিরিয়াল বলুন অথবা নন-ফিকশন কিংবা টিভি সিরিয়াল। মাঝে টেলিভিশনে তেমন একটা কাজ করতাম না। এখন আবার টেলিভিশনে ফেরত আসছি। বিজ্ঞাপনের কাজ আগেও করেছি। আবার নতুন করে কিছু বিজ্ঞাপনে কাজ করছি। সব কটা মাধ্যমে কাজ করতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ক্যামেরার সামনে আমি কোনো কুন্ঠাবোধ করি না। এখন ওয়েব সিরিজের যুগ, তা নিয়েও আমার সমস্যা নেই। তবে থিয়েটারের বড় স্ক্রিনে সবারই নিজেকে দেখতে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু এটাও ঠিক ওয়েবের মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক লোকের কাছে পৌঁছানো যায়।
ক্যানভাস: ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মের সঙ্গে আপনার ভালোমতো একটা কানেকশন আমরা লক্ষ করেছি, অভিনেত্রী হিসেবে কী মনে হয়, এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মই কি সিনেমার ভবিষ্যৎ?
ঋ: মাঝে মাঝে ইন্ডি ফিল্মকে আমার আজকাল ওভার হাইপ মনে হয়। এই যে সারাক্ষণ ইন্ডি ফিল্ম হচ্ছে… ইন্ডি ফিল্ম মানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম, অর্থাৎ যিনি ছবি বানাচ্ছেন তাঁকে মাথার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই, তিনি নিজেই প্রযোজক নেই বা লাইন প্রডিউসার নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা একটা স্ট্রাগলিং প্রসেস। কিন্তু কেউ তো বড় বাজেটেও ছবি করতে চাইতেই পারেন, প্রযোজকের হয়ে ছবি বানাতেই পারেন… মোট কথা আমি সিনেমায় বিশ্বাস করি, ভালো ছবিতে বিশ্বাস করি… সেটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম হতে পারে অথবা ইন্ডাস্ট্রির ছবিও হতে পারে।
ক্যানভাস: পশ্চিমবঙ্গে একধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম হিসেবে তৈরি হওয়া কিউ-এর ‘গাণ্ডু’ কিংবা অমিতাভ চক্রবর্তীর ‘কসমিক সেক্স’ ছবিতে আপনাকে সাহসী অভিনেত্রী হিসেবে দেখা গেছে। ট্যাবুজর্জরিত পিতৃতান্ত্রিক এই উপমহাদেশে কীভাবে সামাজিক চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে নিজেকে উন্মুক্ত করলেন?
ঋ: সাহসী কি সাহসী নয়, এই সব ভাবনা আমার ক্ষেত্রে কখনো কাজ করেনি। আমি জানি, আমায় অভিনয় করেই জীবনযাপন করতে হবে, তাই অভিনয়ের প্রয়োজনে যতটুকু করার আমি করি। তবে আরও একটা কথা বলা দরকার, ব্যাপারটা শুধুই প্যাট্রিয়ার্কির প্রশ্ন নয়, আমরা যারা মুখে অনেক প্রগতিশীল কথাবার্তা বলি, ভিতরে ভিতরে তারাই দেখা যায় প্রাচীনপন্থী… ছবির প্রয়োজনে অনস্ক্রিন ন্যুডিটির প্রসঙ্গ এসেছে, আমি তাতে অভিনয় করতে রাজি হয়েছি। আমার পেশাদারত্বের জায়গা থেকে।
ক্যানভাস : আপনার পরিবারের মানুষেরা, আত্মীয়স্বজন অনস্ক্রিনে আপনার বোল্ড এই অ্যাপ্রোচকে কীভাবে দেখেন?
ঋ : আমার মা আমার ছবি সেভাবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। কারণ উনি সেভাবে ছবিই দেখেন না। আর আমার দাদা নিশ্চই এসব জানেন, কিন্তু এ নিয়ে আমায় কখনো কোনো প্রশ্ন করেননি। এর একটা বড় কারণ হলো, আমি আজ নয়, বহু আগে থেকেই নিজের উপার্জনে নিজেকে চালাই। আমি স্বাবলম্বী। আমি নিজেই আমার বস। আর এটাও তো ঠিক, কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী যদি বাড়ি, পরিবার, বাবা-মা, স্বামী, আত্মীয়স্বজন- এদের কথা মাথায় রেখে কাজ করেন, তাহলে তো তাঁরা অনেক কাজই করতে পারবেন না। আমি তো প্রস্টিটিউশনে কাজ করছি না, যা করছি তার নাম অভিনয়, তার নাম শিল্প। আর আমি যতটা স্মার্ট সেখানে আমার পেশায় আমায় কেউ এক্সপ্লয়েটও করতে পারেনি। যদিও আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তারা প্রত্যেকেই নাইস পিপল।
ক্যানভাস : শ্যামল কর্মকারের ডকুফিকশন ‘মেনি স্টোরিজ অব লাভ এন হেট’-এ আপনার ব্যক্তিগত জীবন কতটা উঠে এসেছে? ওই ছবিতেও আপনার স্বনির্ভর ও স্বাধীন সত্তা ফুটে উঠেছে বলে আমরা দেখেছি।
ঋ : সেসব ঠিক আছে, কিন্তু শ্যামল আমার প্রেম, ছোটবেলা এসবকে যেভাবে দেখিয়েছেন, সেটা দেখে আমায় মনে হচ্ছে ভামি একটা ডার্ক ক্যারেকটার … ব্যাপারটা কিন্তু অমন নয় ঠিক, যদিও ওই সময়টা অবশ্য এই ধরনের কাজগুলোকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি … কিন্তু এখন আর এই ধরনের ছবিগুলোকে ঘাঁটাতে চাই না। এইগুলো আমার খুবই স্পর্শকাতর জায়গা। ছবিটা যেহেতু ডকু-ফিকশন তাই এ কথা বলছি। যেমন ‘গাণ্ডু’ ফিকশন, সেখানে আমি কী করছি আমি জানি, ব্যাপারটা স্ক্রিপ্টেড… কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা… তবে একটা কথা বলব, গাণ্ডু বা এই মেনি স্টোরিজ- এই সব ছবি নিয়ে এখন আর ভাবছি না।
ক্যানভাস : রাইট টু লাভ বা প্রেমের অধিকার- ভারতের বিচারব্যবস্থা এই সব ক্ষেত্রে গত বছর গুরুত্বপুর্ণ রায় দিয়েছে, ব্যাপারটা কীভাবে দেখছেন?
ঋ : দেখুন শুধু আইনকানুন দিয়ে তো সব হয় না। আমাদের অনেকের ভিতরেই সমলিঙ্গের মধ্যে প্রেম বা যৌনতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তাহলে তো আইন দিয়ে কিছু হয় না। তাই আমাদের নিজেদেরই বুঝতে হবে প্রেম, যৌনতা ব্যক্তির পছন্দ ও সিদ্ধান্তনির্ভর। এবং সেই পছন্দ ও সিদ্ধান্তের উল্টো অবস্থানে আমি থাকলেও আমায় অন্যের পছন্দ আর সিদ্ধান্তকে সম্মান করতেই হবে। তবে এই ব্যাপারটা কার্যকর হতে সময় লাগবে। কারণ, প্রেম ও যৌনতার ব্যাপারে আমাদের নানা সংস্কার রয়েছে, ওপর ওপর প্রগতিশীলতায় এটা ঢেকে রাখা যায় ঠিক কথা, কিন্তু সময়মতো এইসব সংস্কার বেরিয়ে পড়ে।
ক্যানভাস: মুম্বাইতে কাজের অফার পান?
ঋ: হ্যাঁ, অনেক অফারই পেয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতা থেকে মুম্বাই গিয়ে কাজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো আগ্রহ পাই না। কলকাতায় কাজ করার ক্ষেত্রে যে তাগিদটা অনুভব করি, বোম্বের ব্যাপারে সেটা আমার ক্ষেত্রে খাটে না।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের অডিও ভিজ্যুয়ালকে কীভাবে দেখেন?
ঋ: আমি বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক দেখি। ভালো লাগে। কয়েকটি নাটকে কাজও করেছি। আর যেটা যেটা ভালো লাগে, তা হলো ওখানকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্যাশন। কলকাতার ইন্ডাস্ট্রি খুব বেশি ছকে বাঁধা। ধরুন, কল টাইম, শুটিং শিডিউল- এসবের কথাই যদি ধরা যায়, দেখবেন কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিতে নির্ধারিত সময়ের বাইরে কিছু হয় না। কিন্তু ঢাকার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ভালোবেসে কাজটা করেন, এমনও হয় তাঁরা সারা দিন, সারা রাত একটানা শুট করছেন। এবং কাজের ব্যাপারে ঢাকার চলচ্চিত্র কর্মীরা খুবই সচেতন। এটা অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বটে। আমি নিজেও তো বাঙাল। আমাদের পারিবারিক শিকড় ময়মনসিংহে।
ক্যানভাস: কোনো ছবিতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন?
ঋ: ছবির বিষয়, স্ক্রিপ্ট এগুলো তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জরুরি বটেই, কিন্তু আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই তাঁকে যিনি ছবিটা বানাচ্ছেন। ছবি যিনি বানাচ্ছেন তাঁর সঙ্গে কাজ করে কমফোর্ট ফিল করছি কি না- এটা আমার কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আমি খুব খারাপ ছবিতেও কাজ করেছি। করেছি তার কারণ, পরিচালক মানুষটা খুব ভালো।
ক্যানভাস: পুরুষের ব্যাপারে আপনার ক্ষেত্রে কী ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করে?
ঋ: স্পোর্টস পারসনদের ব্যাপারে ভীষণ ফ্যান্টাসি কাজ করে। যেমন ধরুন বাংলাদেশের মাশরাফি, উফ সো হট!
ক্যানভাস: চলচ্চিত্র নির্দেশনার কথা কখনো ভেবেছেন?
ঋ: অবশ্যই। ইনফ্যাক্ট আমার মাথার মধ্যে সব সময় সিনেমা ঘোরে। কিন্তু মুশকিলটা হলো, লিখে ওঠা হয় না। তবে ছবি আমাকে বানাতেই হবে। ফিচার না বানাতে পারি, শর্ট ফিল্ম। নিদেনপক্ষে ফোনে শ্যুট করে হলেও ছবি আমি বানাবই। দেখুন, আমরা মহিলা পরিচালক খুব কমই দেখি। কিন্তু কোনো মহিলা পরিচালক যখন অনস্ক্রিনে যৌনতা, ফ্যান্টাসি- এসব নিয়ে কাজ করেন, তখন সেটা ভেরি ইন্টারেস্টিং। যেমন ধরুন সোফিয়া কপোলা।
ক্যানভাস: স্টার জলসা, জি-বাংলা- এসব চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর ব্যাপারে কিছু বলুন।
ঋ: আমি নিজেও হয়তো আবার সিরিয়াল করব। কিন্তু আমার মাঝেমধ্যে একটু হাস্যকর মনে হয়। তবে সিরিয়ালের নিজস্ব যে ‘মশালা’ রয়েছে, তার জন্য অনেকে পাগল। সিরিয়াল বন্ধ হয়ে গেলে অনেকে আত্মহত্যা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কী বলব… এর থেকেও চারপাশে অনেক খারাপ জিনিস আছে। তাই সিরিয়াল নিয়ে কেউ মেতে থাকতে চাইলে থাকুক। সিরিয়ালে কাজ করে কেউ অর্থকরী উপার্জন করলে করুক।
ক্যানভাস: নিজের জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন?
ঋ: আমার মনে হয় প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যে একটা স্পেস দরকার। আমার জীবনেই যে-ই আসুক সে যদি আমার সঙ্গে গোটা জীবন ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকে, সেটা খুব একটা সুখকর হয় না। তার চেয়ে একসঙ্গে ভালো সময় কাটলাম। একে অন্যের সঙ্গে নানা কিছু শেয়ার করলাম, তারপর যে যার মতো করে নিজস্ব কাজকর্ম করলো… কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব তৈরি করা, ডমিনেট করা- এসব আমার মোটেও পছন্দ নয়। আর একসঙ্গে এক বাড়িতে একটা মানুষের সঙ্গে টানা থেক্বে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমি খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। তার চেয়ে একসঙ্গে থামলাম, আবার সে তার মতো করে অন্য কোথাও ঘুরে এলো, আবার একসঙ্গে থাকলাম… এটা ভালো। তবে আমি এ মুহূর্তে কারও ওপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠতে চাই না।
ক্যানভাস: অবসর কাটে কীভাবে?
ঋ: আমি রান্না করতে ভালোবাসি। রান্না করে বন্ধুদের খাওয়াই। তাদের সঙ্গে সময় কাটাই। কলুকাতায় হেঁটে বেড়াই। ছবি তুলি। নেশা করি। ঘুমোই। সিনেমা দেখি। এইসব করে সময় কেটে যায়।
ক্যানভাস: শেষ প্রশ্ন। নতুন করে কারও প্রেমে পড়েছেন?
ঋ: আমি সারাক্ষণ প্রেমে পড়ি। ক্রিয়েটিভ মানুষেরা অবশ্য ঘন ঘন প্রেমে পড়েন। আমিও পড়ি। তবে আগের আমার প্রেমের সম্পর্কটা যেমন ছিল, তা দিয়ে এখনকার প্রেমকে দেখা যাবে না। প্রেমের ধারণা বদলে গেছে। প্রেম বলতেই কারও ওপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকা, তাকে সারাক্ষণ মিস করা, থেকে থেকে লাভ ইউ বলা, এই প্রেম নয়। বরং আমি তো এমন অনেক প্রেমে পড়েছি, যেখানে আমি নিজের মনের মধ্যেই সেই প্রেমকে লালন করেছি, গোপনে। অন্যদিকের মানুষটা জানতেও পারেনি। তবে সারাক্ষণ আমি প্রেমে পড়ি, এটা ঠিক। এমনকি আমার প্রেমটা শুধু কাঙ্ক্ষিত পুরুষের প্রতি প্রেমে পড়া নয়। আমি মেয়েদেরও প্রেমে পড়ি। পশুপাখির প্রেমে পড়ি। রিকশাওয়ালার প্রেমেও পড়েছি। তবে সবার মতোই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি নিজেকেই।