skip to Main Content

আলাপন I আমরা এখনো বিবাহিত ব্যাচেলর

কর্মজীবনে দুজন ভিন্ন জগতের মানুষ। তবে সাহিত্যচর্চায় মিল আছে উভয়ের। সরকার আমিন ও শাহ্‌নাজ মুন্নী। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে সুপরিচিত দুটি মুখ; নব্বইয়ের দশকের দুই জনপ্রিয় কবি। শাহ্‌নাজ মুন্নী কথাসাহিত্যিক এবং সাংবাদিকও। দুই মেয়ে যৌথ ও যুক্তকে নিয়ে প্রশান্তিময় গৃহ। ৩০ বছরের যৌথজীবনের কিছু অভিজ্ঞতার গল্প তারা শুনিয়েছেন ক্যানভাসকে। সাক্ষাৎকার গ্রহণে হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ঢালু পথটি গিয়ে যেখানে থিতু হয়েছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। সিঁড়ি পেরিয়ে পথ শেষ ‘বসন্তবাউরি’র দুয়ারে। আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন কবি সরকার আমিন। পরনে জিনস। জিনস শার্টের বুক খোলা। ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কালো টি-শার্ট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। বোঝা যায় বয়সের কাছে হার মেনেছে তারুণ্য। স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ভেতরে এসো।’
অভ্যর্থনা জানাল সুসজ্জিত বসার ঘর। চারপাশের দেয়ালে ঝুলে আছে জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি। দুয়ারে ঢুকতেই নজর কাড়ল প্লাস্টারবিহীন লাল ইটের দেয়াল। সেখানে টাঙানো যুগলজীবনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। পেছনে অনন্ত নীল আকাশ। ‘আমাদের খুব প্রিয় একটা ছবি।’ ঘোর ভাঙল নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় কবি সরকার আমিনের কথায়। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছবি তোলায় চে গুয়েভারার রেকর্ড মনে হয় ভেঙে ফেলেছি।’
এর মধ্যেই ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন একজন। তার পরনে লাল পেড়ে ঘিয়ে শাড়ি। চোখে লাল ফ্রেমের চশমা। কপালে খয়েরি টিপ। ‘আমি তৈরি। আগে কথা বলবে নাকি ছবি নেবে?’ বলছিলেন জনপ্রিয় কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক শাহ্‌নাজ মুন্নী।
ঠিক হলো, ছবিই তোলা হবে আগে। দুজন পাশে দাঁড়ালেন। সরকার আমিন বললেন, মুন্নী এদিকে তাকাও না! জবাবে শাহ্‌নাজ মুন্নী হাসিমুখে তাকালেন। বললেন, তোমার দিকে তাকিয়ে থেকেই তো জীবন কেটে গেল আমিন!
ফ্রেমবন্দি হওয়ার পর আলাপের পালা। যৌথযাপনের গল্পটা শুনতে চাইলাম। শুরুটা করলেন শাহ্‌নাজ মুন্নী। বললেন, আমাদের প্রথম দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই ব্যাচের ছিলাম। ডিপার্টমেন্টও ভিন্ন। আমিন বাংলায়, আমি সমাজবিজ্ঞানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে আমাদের দেখা হয়নি। একই ক্যাম্পাসে পড়ছি কিন্তু পারস্পরিক পরিচয় ছিল না। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর আমাদের দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। ওরা বন্ধুরা মিলে গল্প করছিল। বাংলা বিভাগ তখন একটা দেয়াল পত্রিকা বের করত। ‘নতুন প্রজন্ম’ নামে। আমি কবিতা পড়তাম, লিখতাম। আসলে আমি খুঁজছিলাম কোথায় গেলে সমমনা লোকজন পাব। বাংলা বিভাগে পড়ত আমার এক বান্ধবী। সে বলল, আমরা তো এ রকম একটা দেয়াল পত্রিকা করছি। ওর কথা শুনেই ওদের ওখানে গিয়েছিলাম। ওই সূত্র ধরে আমিনের সঙ্গে পরিচয়।
একটু থেমে আবার বললেন, একটা গ্রুপ ছিল ‘মঙ্গলসন্ধ্যা’ নামে। সেখানে গিয়ে ওদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তারপর আমাদের বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়। এভাবেই গভীরতর বন্ধুত্বের সূচনা। চেনাজানার মাস ছয়েক পরে আসলে আমরা একটু কমিটমেন্টের দিকে গেলাম।
পাশে বসে মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনছিলেন সরকার আমিন। বললেন, ট্রেন যখন এক লাইন থেকে আরেক লাইনে চলে যায়, যাত্রীরা টের পায় না। আমরাও কিছু টের পাইনি। মুন্নীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা ছিল গভীর। অনেকটা কাজকেন্দ্রিক। যেমন পত্রিকা বের করছি। কবিতা লিখছি। একসঙ্গে বৃষ্টির ভেতর হাঁটছি। কুয়াশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। ফুলার রোডে, উপাচার্যের বাসার সামনে দিয়ে ঘন কুয়াশার ভেতর হাঁটার স্মৃতি ভোলার নয়। ওই সময় থেকেই একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হয়ে গেছে। মুন্নী সকালবেলা আসবে; শীতের দিন গায়ে একটা চাদর। উপাচার্যের বাড়ি অর্ধেকটা কুয়াশায় আচ্ছন্ন। দেখা যায় আবার যায় না। আহা, সেই দিনগুলো! ও আসত সকাল সাতটায়। একেবারে প্রথম বাসে।
মুন্নী বললেন, আমিন হলে থাকত। আমি বাসায়। শাহজাদপুরে আমাদের বাসা ছিল।
আমিন এবার বললেন, ওই হাঁটার মধ্যে বেশ মজা হতো। সকালের নির্জন পথ। আমরা দুজন। মাঝে মাঝে মুন্নীকেও অস্পষ্ট মনে হতো। এত কুয়াশা থাকত! ওই সময় হাঁটার অভ্যাসটাও হয়ে গেল। তখনো কিন্তু আমরা বন্ধু। তারপর একদিন আমি মুন্নীকে বললাম, জরুরি কথা আছে। ও বলল, বলো। আমি বললাম, না, তুমি কাল এসো। কাল বলব। মুন্নী এলো। একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেলাম লালবাগ কেল্লায়। রিকশায় তখনো আমি মুন্নীকে কিছু বলিনি। ও খুব চিন্তিত। কী বলব তা নিয়ে। কেল্লায় পৌঁছালে আমি বললাম, জরুরি কথা হচ্ছে, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে জীবন কাটাতে রাজি আছ?’ মুন্নী বলল, হ্যাঁ। তারপর আমরা কেল্লা থেকে বেরিয়ে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলাম। বন্ধু থেকে প্রেমিক-প্রেমিকায় পরিণত হয়ে গেলাম।
ক্যানভাস : সময়টা কখন ছিল?
১৯৮৯ থেকে ৯১, ৯২ সাল। আমাদের অনার্স শেষ হয় ১৯৯৩ সালে। বললেন মুন্নী, আমি প্রথম বাসে আসতাম। আর ফিরে যেতাম শেষ বাসে। পাঁচটা বা সাড়ে পাঁচটার দিকে। আমি চলে যাওয়ার পর আমিনের নিঃসঙ্গতা বাড়ত। ও তখন খুব গান শুনত। আমিনের খুব ছোট একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। পড়াশোনা করত না ঠিকমতো।
‘ক্লাসের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম’- আমিন যোগ করলেন।
মুন্নী বললেন, ওর মাথায় তখন কবিতা আর বিষণ্নতা চেপে বসেছিল। ভাবতাম, আমি বাসায় চলে যাওয়ার পর ও কী করবে? ওই সময়টাতে আমিন শিল্পী রাজিব রায়, কবি শাহেদ কায়েস, মুজিব ইরম, কবির হুমায়ুনদের সঙ্গে সময় কাটাত। আড্ডা দিত। ঘুরে বেড়াত।
ক্যানভাস : আপনারা দুজনই তো কবিতা লিখতেন। দুজনকে উৎসর্গ করে লেখা হতো?
আমিন আমাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছে। বললেন মুন্নী।
পাশে বসা আমিন মৃদু হেসে বললেন, এই কথাটা আমার কাছেই শোনো। আমার কবিতায় অন্য কোনো নারীকে পাওয়া যাবে না। কোনো রাখঢাক না করে আমি সব প্রকাশ করে দিই। আর মুন্নী অন্তর্মুখী। খুব কম কথা বলে। কিন্তু আমি বরাবরই ওর মৌনতার ভাষা বুঝি।
ক্যানভাস : আপনাদের প্রণয়-সম্পর্ক কি মেনে নিয়েছিল দুই পরিবার?
সরকার আমিন বলতে লাগলেন, ‘আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। আমার মা তেমন পড়াশোনা জানতেন না। কিন্তু মাকে মনে হতো একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারীর থেকেও জ্ঞানী মানুষ। বাবা ছিলেন খুব উদার প্রকৃতির। বাবা যখন মুন্নীর কথা জানতে পারলেন, আমাকে একটি চিঠি লিখলেন। ‘শুনিলাম তোমার একজন বান্ধবী হইয়াছে। তাহাকে নিয়া একদিন চলিয়া আসো। আমাদেরকে সে দেখুক। তাহাকেও আমরা দেখি।’ পরে একদিন ওকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। আমার বাড়ির সবাই মুন্নীকে বেশ সাদরে গ্রহণ করেছিল। মুন্নীর কথাটা ও-ই বলুক।
এবার শাহ্‌নাজ মুন্নী বললেন, আমার জন্ম ঢাকায়। পরিবারও এখানে থাকত। বাবা ব্যাংকে চাকরি করতেন। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বড় মেয়ে। স্বাভাবিকভাবে বাবা-মায়ের একটা ধারণা থাকে যে, সমবয়সী ছেলেকে কেন বিয়ে করবে? ব্যাচমেট আমিন তো তখনো প্রতিষ্ঠিত কেউ নয়। একসঙ্গে পড়ছি। আমিন একটা খন্ডকালীন কাজ করে। আর পড়াশোনা করে। আমিও পড়াশোনা করি। এর মধ্যে জানাজানি হলো। বিষয়টা এমন হলো যে আমার বাবা-মা চাইতেন অনার্সের পর আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। আত্মীয়স্বজন বিয়ের সম্বন্ধ আনতে লাগলেন। একটা বিয়ের কথা যখন এগোচ্ছে, তখন আমার ছোট মামাকে বললাম, আমি বিয়ে করব না। তিনি জানতে চাইলেন, কেন? আমিনের কথা বললাম। আমার পরিবারের লোকজন আমিনকে আগে থেকেই চিনত। এখানে একটা মজার ঘটনা বলি। তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি। একদিন সকালে ক্লাস করতে এসেছি। হঠাৎ পেটে এমন ব্যথা শুরু হলো যে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। বমি হচ্ছিল। আমিনকে বললাম, আমি বাসায় চলে যাচ্ছি। ও বলল, বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। চলো, হাসপাতালে যাই। ও ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেল। তারপর আমার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। আমিন আমাদের বাসায় ফোন করে খবর দিল। বাসার সবাই শুনে তো কান্নাকাটি করতে করতে হাসপাতালে ছুটে এলো। তারা দেখল, ভালো মেয়ে সকালে ক্লাসে গেল। কী এমন হলো যে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে! আমাকে তখন অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। পরে আমার বাবা-মাসহ সবাই এলেন। বাবা এসে আমিনকে দেখে বললেন, ‘আমার মেয়েটাকে বাঁচান।’
এবার হাসতে হাসতে সরকার আমিন বললেন, আমি তো মনে মনে বলি, ওকে তো আমার জন্যই বাঁচাব।
মুন্নী বললেন, আমি কিন্তু এসবের কিছুই জানি না। পরে অবশ্য শুনেছি। যখন আমিনকে বিয়ের কথা বললাম, তখন আসলে বাবা রাজি হচ্ছিল না। তবে আম্মা ও আমার ভাইবোনেরা আমিনকে খুব পছন্দ করত। পরে আমাদের বিয়ের জন্য দূত হয়ে এলেন অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ স্যার। তিনি তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি একদিন আমাদের বাসায় এলেন। বাবাকে বললেন, আমিন আমার ছেলে। এখন আমার ছেলের কাছে আপনার মেয়ে দেবেন কি না?
সরকার আমিন প্রসঙ্গ টেনে নিলেন। বললেন, বাংলা একাডেমির ডিজি তখন খুবই পরিচিত মুখ। বিটিভিতে তাকে নিয়মিত দেখা যায়। তাকে দেখে আমার শ্বশুরমশাইসহ সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কাউকে কিছু না জানিয়ে নাটকীয়ভাবে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন হারুন স্যার। তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর আর শ্বশুরমশাই অমত করেননি। তারপর হারুন স্যারই আমাকে বাংলা একাডেমিতে চাকরি দিলেন। তিনি সত্যিই আমাকে পুত্রের মতো ভালোবাসেন। আমার ও মুন্নীর জীবনে তার অবদান অসীম।
ক্যানভাস: আপনাদের বিয়ে হলো কত সালে?
জবাবটা মুন্নী দিলেন। ১৯৯৩ সালে। আকদ হলো। পরের বছর ১৯৯৪ সালে আমাদের মাস্টার্স শেষ হলো। আমি তখন চাকরি নিলাম। আজিমপুরে ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলাম।
সরকার আমিন বলতে শুরু করলেন, ঘরটা এতই ছোট যে একটা বিছানা ফেলার পর মাত্র চার হাত জায়গা ছিল। মাঝারি আকারের একটা রান্নাঘরের মতো ছিল দেখতে।
মুন্নী বললেন, ভাড়া ছিল এক হাজার কি বারো শ টাকা। কিন্তু ওটাই ছিল আমাদের স্বর্গ। ওই বাসার দেয়াল আর ছাদ- সব নীল রঙের ছিল।
আমিন বললেন, আমার কাছে মনে হতো, সমুদ্রের মাঝে আছি।
ক্যানভাস: আপনাদের ঘর আলো করে প্রথম কন্যা এলো কবে?
আমাদের বড় মেয়ে যৌথ এলো ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে। পরে ২০০০ সালে ছোট মেয়ে যুক্তর জন্ম হলো। নিরানব্বইয়ে আমি ঢুকলাম একুশে টেলিভিশনে। তখন ‘যুক্ত’ আমার গর্ভে। ওখানে দুই মাস ট্রেনিং করলাম। গাজীপুরে। সে অনেক গল্প।
ক্যানভাস: আপনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা ব্যাংকার। সেই পরিবার থেকে এত ছোট্ট একটা ঘরে সংসার, একবারও মনে হয়নি কোথায় এলাম?
মুন্নী অকপটেই বললেন, আমার মনে কখনোই এমন কিছু আসেনি। মনেই হয়নি এর চেয়ে ভালো থাকতে পারতাম। মনে হতো এর চেয়ে ভালো আর কীভাবে থাকা যায়! ওটাই ছিল সবচেয়ে ভালো থাকা। কারণ, আমার বাসার সবাই কঠিন নিয়মকানুন মেনে চলত। সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত নিয়মের ছকে ছিল জীবন বাঁধা। কিন্তু বিয়ের পর মনে হলো স্বাধীন হলাম। আমাদের ছকে বাঁধা সংসার ছিল না। আমরা অনেকটা ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’।
ক্যানভাস : এটা কীভাবে সম্ভব?
আমিন বললেন, আমরা দুজন বিয়ে করার আগে একটা মৌখিক চুক্তিতে পৌঁছেছিলাম। বিয়ে করে আমরা বিয়েটা ভুলে যাব। চাইছিলাম, সারা জীবন প্রেমিক-প্রেমিকার মতো থাকব। মুন্নী একমত হয়েছিল। যে কারণে, বিশ্বাস করো আমাদের বিবাহবার্ষিকী কবে ভুলে গেছি। কোনো দিন ম্যারেজ ডে উদ্‌যাপন করিনি। যদিও আমি মুন্নীকে ঠাট্টা করে বলি, আমাদের আসল বিয়ে হবে হাশরের মাঠে।
দুজনেই হেসে উঠলেন।
মুন্নী বললেন, আসলেই আমিন স্বামী, আমি স্ত্রী এমনটা কখনো মনে হয়নি। সেই সকালে একসঙ্গে হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো দিনগুলোতে যে বন্ধুত্ব ছিল, তা-ই রয়ে গেছে। কিন্তু আমরা পরিবার-বিচ্ছিন্ন কেউ নই।
ক্যানভাস : সুন্দর বোঝাপড়ার মন্ত্রটা কী তাহলে?
আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা বেশ নিবিড়। বন্ধুর মতো। একে-অন্যকে সব শেয়ার করি। আমি তো এমনিতে কোনো কিছু গোপন করতে পারি না। সব বলে দিই। মুন্নী অন্তর্মুখী স্বভাবের। তারপরও ওর যতটুকু আমার জানা দরকার, জানায়। যে কারণে কোনো সাংসারিক কলহ-অশান্তি আমাদের স্পর্শ করতে পারেনি। বলছিলেন সরকার আমিন।
মুন্নীও একই সুরে বললেন, আমিন আমার স্বাধীনতায় কখনো বাদ সাধেনি। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এমন কথা কখনোই বলেনি; বরং সংসারের অনেক দায়িত্ব ও নিজে থেকেই কাঁধে নিয়েছে। বাচ্চারা অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, তাদের সেবাশুশ্রূষা করার দায়িত্বও আমার চেয়ে ও বেশি পালন করেছে মনে হয়। অনেক সময় এমন হয়েছে, আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত, মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া দরকার বা ঢাকার বাইরে অ্যাসাইনমেন্টে যেতে হচ্ছে, ওকে ফোন করে বললেই হতো। কখনো এ নিয়ে জবাবদিহি করতে হয়নি।
আমিন বললেন, বিয়ের পর আমরা আরেকটি কাজ করেছিলাম। দুজনের পরিবারকে বদল করে নিয়েছিলাম। আমার পরিবারকে আপন করে নিয়েছে মুন্নী। আর মুন্নীর পরিবারকে আমি। দেখা গেল, মুন্নীর বাসার কোনো বিষয়ে সমস্যা বা কথা বলার প্রয়োজন হলে আমাকে আগে ফোন করা হয়। একইভাবে মুন্নীকেও আমার ভাইবোনেরা খুব পছন্দ করে।
ক্যানভাস : কাজ থেকে অবসরে গিয়ে কী করবেন? দুজনের কাছেই ছিল একই প্রশ্ন।
আমিন বললেন, অবসরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আমাদের বাড়িটায় একটা হিলিং সেন্টার করতে চাই। মনোবেদনায় যারা ভুগছেন, তাদের জীবনে কাউন্সেলিং, মেডিটেশনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করার ইচ্ছে আছে। জীবনের একটা সময় খুব ডিপ্রেশনে ভুগেছি। কেউ বাইরে থেকে দেখে বুঝত না। মুন্নী বুঝত। ও দেখেছে, কতটা কষ্ট পেয়েছি। সেই জায়গা থেকেই বেদনাহত মানুষের দুঃখটা বুঝতে পারি। কিছু করার ইচ্ছে আছে। মুন্নীও এ বিষয়ে একমত।
মুন্নী পাশেই ছিলেন। কথায় সায় দিলেন। বললেন, মানুষের জন্য কিছু করতে পারায় যে অপার আনন্দ, তার বিকল্প হয় না।

ছবি: মো. রাকিবুল হাসান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top