skip to Main Content

ফিচার I খাদ্য, কিন্তু খেতে নেই!

খাবারের যেমন ভোজনমূল্য, তেমনি প্রথামূল্যও আছে। বিয়েতে এমন কিছু খাদ্য উপাদান ব্যবহৃত হয়, যা খাওয়ার জন্য নয়, রাখা হয় নবদম্পতির মঙ্গলার্থে। জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ

বিয়ের এমন কিছু খাদ্যানুষঙ্গ আছে, যা খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং রীতি পালনের জন্য অনুষ্ঠানে রাখা হয়। ধান দিয়েই কেন আশীর্বাদ? দুধে-আলতায় পা ভিজিয়ে কেন বধূবরণ? উত্তর আছে উর্বরতাসংক্রান্ত অনুকরণমূলক জাদুবিশ্বাসে। মানে, ফার্টিলিটি ম্যাজিকে। যা প্রকৃতির উর্বরতা-গুণ মানুষের শরীরে সঞ্চার করার একটা পদ্ধতি; যেটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা ধর্মীয় স্বীকৃতি নেই। এই দুয়ের মাঝখানেই জাদুবিশ্বাসের ঠাঁই। ইমিটেটিভ ম্যাজিক থেকে উদ্ভূত রীতিগুলো শাস্ত্রীয় নয়, সেগুলো মূলত লৌকিক আচার। যেমন ধান উচ্চফলনশীল। মাত্র একটি বীজ পুঁতলে তা থেকে ছড়ায় ছড়ায় শস্য মেলে। প্রাচীনকালে সন্তান উৎপাদনই ছিল বিয়ের একমাত্র কারণ। বেশি সন্তান উৎপাদন করতে নারীদেহে চাই বেশি উবর্রতা শক্তি। ধানের ফলনক্ষমতা নারীদেহে সঞ্চারের প্রত্যাশাতেই প্রাচীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল অনুকরণমূলক জাদুবিশ্বাসে। তা থেকেই বিয়ের আচারে ধানে-কপালে ছোঁয়াছুঁয়ি। দুধ-আলতার বিষয়টিও তাই। এ দুটি উপাদান হচ্ছে রেতঃ ও রজঃ-এর মিলনের প্রতীকী তরল। বিয়ের অষ্টমঙ্গলা অনুষ্ঠানে অতিথি সধবারা একটি থালায় দুধ ও আলতা নিয়ে তার মধ্যে মঙ্গলসূত্র ও গাঁটছড়া ডোবায়। মূলত তারা রেতঃ ও রজঃ-এরই মিলন ঘটায়; সন্তান উৎপাদনের আশায়। হয়তো তারা তা জানেই না। রীতি মানতে হয়, তাই চোখ বুজে পালন করে যায়।
আমাদের অঞ্চলের বিয়েশাদিতে বৈদিক যুগেও কোনো আচার-অনুষ্ঠান হতো না। বিয়ের ওপর আড়ম্বর চাপে অথর্ববেদ ও গৃহসূত্রসমূহের যুগে। তখনই ধান ও দুধের মতো কিছু উপাদান বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ হয়। রিচ্যুয়াল হিসেবে। একেবারে কনে দেখা থেকে বাসি বিয়ে পর্যন্ত এসবের বিস্তৃতি। বিয়েতে এসব খাবারের উপস্থিতি সর্বজনীন নয়। তবে এ ধর্মে না হোক ও ধর্মে, এই অঞ্চলে না হোক, ওই অঞ্চলের বিয়ের রীতিতে কোনো না কোনো ‘রিচ্যুয়াল ফুড’-এর হদিস মেলেই।
যেমন পানপাতা। বিয়েশাদিতে এর উপস্থিতি একটু বেশিই। আগের দিনের মানুষের কাছে এটি ছিল একটি আশ্চর্য লতাবিশেষ। ফুল ফল ছাড়াই কেমন অবিরাম লতিয়ে ওঠে! পানের এই গুণকে উর্বরতা হিসেবেই দেখেছিল তারা। তাই বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এটিকে জুড়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ওই একটাই- বেশি সন্তান উৎপাদন এবং কনের মধ্যে পানের উর্বরতা-গুণের সঞ্চারণ। কিছু অঞ্চলে দেখা যায়, পানের ভেতর লবঙ্গ ও এলাচি পুরে খিলি বানানো হয়। খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, নৈবেদ্য দিতে। সোনার থালায় সাজিয়ে বিয়ের দিন অর্পিত হয় বিষ্ণুর প্রতি। খিলিতে তেল-সিঁদুর মেখে রাখা হয় তুলসী তলায়। কোথাও কোথাও শুভদৃষ্টিতে পানের ব্যবহার হয়। সে সময় কনের মুখ গহ্বরে একটি সুপারি পুরে রাখার চলও ছিল। কিন্তু কেন? পানে আছে কামোত্তেজক উপাদান, সুপারিতে মাদকতা। এই দুয়ের কারণেই পানের সঙ্গে সুপারির আজন্ম বন্ধন। আবার এই দুই গুণই যৌনতার উদ্রেক ঘটায়। ‘বীরমুঠার কড়ি’ নামে বিয়ের একটি অনুষ্ঠানে একুশটি হলুদ ও সুপারি পাত্রে বেঁধে কনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চল আছে।
কোথাও কোথাও বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে মাছ রাখা হয়। এ প্রাণীর ডিম থেকে অসংখ্য পোনা জন্মায়। মানে, মাছের আছে অধিক সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা। এই গুণের কারণে বিয়ের অনুষ্ঠানে মাছ থাকা চাই। মঙ্গলাচরণের দিন বরপক্ষ নারকেল, দই, খই, পান-সুপারি ও আঁশযুক্ত মাছ নিয়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সেই মাছে সিঁদুরের পাঁচটি ফোঁটা দেয় কনের বাড়ির লোকেরা। সিঁদুরের লাল কি নারীর রজঃ-এর প্রতীক? হতেও পারে। কোনো কোনো আদিবাসী জমি চাষের আগে খেতের কোণে একটি পাথরে লাল রঙ ঘষে রেখে দেয়। সেটি নারী রজঃ-এর প্রতীক হিসেবে থাকে। ভাবা হয় রজঃ-এর উর্বরতা শক্তি জমিতে সঞ্চারিত হবে। ফলে ফলন বেশি হতে পারে। কোথাও কোথাও বধূবরণকালে তার হাতে একটি মাছ ধরিয়ে দেওয়ার রীতি আছে।
বিয়ের একটি অনুষ্ঠানের নাম অধিবাস। সেটিরই একটি উপ-অনুষ্ঠান ‘কঙ্গন’। তাতে তেল ও হলুদে ভেজানো নতুন কার্পাসের তুলা বরের ডান হাতে ও কনের মণিবন্ধে বাঁধা হয়। অধিবাসের রাতে কনের খাটের তলায় মেথি দিয়ে আলপনা এঁকে রাখে সখীরা। মেঝের অন্যান্য জায়গায় চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা হয় লতা-পাতা, মাছ, সূর্য, পদ্ম ও চাঁদ। তবে চালের গুঁড়া ছাড়াও ধান ও ভাত বাঙালির বিয়েশাদির সঙ্গে আরও বিশদভাবে যুক্ত। আগে বিয়েতে ‘চাল খেলা’ নামের একটি অনুষ্ঠান হতো। সেখানে বর-কনে ‘মঙ্গল হাঁড়ি’ নিয়ে খেলত। তা ‘মুঙ্গলী হাঁড়ি’ নামেও পরিচিত ছিল। কথিত আছে, আয়ু বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বর-কনেকে পাত্রটি নিয়ে খেলতে হতো। হাঁড়ির ভেতর অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে হলুদ মাখানো সেদ্ধ চাল থাকত। বর সেগুলো তিনবার করে মাটিতে ফেলে দিত; কনে বারবার তা তুলে হাঁড়িতে রাখত। সবশেষে হবু স্ত্রীর নাম মুখে নিয়ে বর সেই পাত্রের মুখ ঢেকে দিত। বাঙালি বিয়েতে আগে নতুন বউয়ের গলায় যে ‘নবপত্রিকা’ তথা নয়টি পাতার কবজ পরানো হতো, সেগুলোর একটি ছিল ধান। ‘বরভোজনের চাল’ নামেও একটি অনুষ্ঠান হতো। সেদিন পিঁড়ির উপর বরের পরিত্যক্ত কোনো একটি পোশাক রেখে তাতে চাল বেঁধে দেওয়ার প্রথা। কন্যাকে সেটির উপর বসাত বাড়ির লোকেরা। বরযাত্রীর মহাজেও চাল দেওয়ার রীতি ছিল। পাত্রপক্ষ বিয়ের সাত দিন আগে কনের বাড়িতে যেত। এই অনুষ্ঠানের নামই ‘বর মহাজ’। তাদের তুষ্ট করতেই চাল দেওয়ার প্রথা ছিল। একটা সময় বিয়েতে অতিথিদের সামনে যে পানের বাটা দেওয়া হতো, সেখানেও সহপদ হিসেবে চালের উপস্থিতি থাকত। পাকা কথা হয়ে গেলে কনের বাড়িতে ‘পাকা পত্র’ পাঠানোর রীতি ছিল। তাতে ধানের প্রয়োজন হতো। চিঠি পাঠানোর জন্য যে খিলি তৈরি হতো, তার একটি অনুষঙ্গ ছিল ধান। চালের কিছু পদ, যেমন খইয়েরও প্রথাগত ব্যবহার চোখে পড়ে। কোনো অঞ্চলের বিয়েতে জামাই বরণ করা হয় খই ছিটিয়ে। বধূ যখন ঘরে ঢোকে, তখন তাকে উথলে ওঠা ভাত কিংবা দুধের পাত্র দেখানো হয়; যা বরের পারিবারিক সচ্ছলতার প্রতীকী রূপ।
আরও কিছু খাদ্যদ্রব্যের কথা উল্লেখ করা যাক। হরীতকী, আমলা, বহেড়া ও জায়ফল। সুপারির সঙ্গে এই চৌফল গাঁটে বেঁধে সেটির দুই প্রান্ত কনে ও বরের পরিধেয়তে বেঁধে দেওয়া হয়।
বিয়ের দধিমঙ্গল অনুষ্ঠানে খুব ভোরে কনের কপালে দইয়ের ফোঁটা দেওয়া হয়। কল্যাণের উদ্দেশ্যে। তা ছাড়া, দইয়ের সঙ্গে চন্দন মিশিয়ে বর-কনের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়ার চলও আছে। কোথাও কোথাও শাশুড়ি দই দিয়ে বরের হাত ধুইয়ে দেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দুধও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
কন্যাদানের অনুষ্ঠানের যজ্ঞে লাগে ঘি। সাত পাকে লাগে কলা। ঘোরা শেষে কন্যার মামা তার আঁচলে কলা ঢেলে দেন। আবার বর-কনের সাত পাক শেষে মেয়ের কনিষ্ঠ ভাই তাদের হাতে খই ঢেলে দেয়। নব্য দম্পতি তা যজ্ঞে অর্পণ করে। এভাবেই বিয়ে শেষ হয়। তবে শেষ হলেও বিয়ের রেশ কাটে না। বিয়ের পরদিন বাসি বিয়ে নামের একটি অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় কোনো কোনো অঞ্চলে। সেখানে বড় একটি পাতিলে ধান ও বাটিতে দুধ-কলা রেখে দ্বিতীয়বারের মতো সাত পাকে ঘোরে বর-কনে।
দেখা যাচ্ছে, বিয়েতে এমন কিছু খাবারের উপস্থিতি রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে ভোজের সম্পর্ক নেই। আছে রীতির যোগ।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top