skip to Main Content

ফিচার I সময় বহিয়া যায়

আগুনের আবিষ্কার যেমন পাল্টে দিয়েছিল মানুষের ইতিহাসের অভিমুখ, ঘড়িও তেমন। দিনযাপনের ক্রমকে ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বর্ষপঞ্জির প্রতিটি একক মুহূর্তের গাণিতিক হিসাবই হলো ঘড়িবিদ্যা। সময়ের মূল্য তৈরি হয়েছে এই যন্ত্রকে সম্বল করেই।
সূর্যের চারপাশে পৃথিবী যে ঘুরছে, এই সত্য আবিষ্কারের অনেক আগেই মানুষ তৈরি করে ফেলেছে সূর্যঘড়ি। এটা সময়যন্ত্রের বিকাশের আদিপর্ব। কবে ঠিক সূর্যঘড়ির প্রচলন, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে মিসরে সবচেয়ে প্রাচীন যে সূর্যঘড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটা হলো খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দের।
মানবসভ্যতার আদিপর্বে ঘড়িবিষয়ক চিন্তার উদ্ভব। আগুন আবিষ্কারের কিছুটা পরেই। সূর্য ওঠার পর থেকে বস্তুরাশির ছায়ার দৈর্ঘ্য বদলাতে থাকে। এই পরিবর্তনকে চিহ্নিত করার জন্য পাথর সাজিয়ে অথবা দাগ কেটে রাখা হতো। প্রক্রিয়াটি সময়গণনা বা ঘড়িবিষয়ক ভাবনার বীজসূত্র। এখান থেকেই মানুষের সময়চেতনার ইতিহাস রচিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে একে নির্দিষ্ট এককে ভাগ করে নেওয়ার ধারণা।
সাড়ে পাঁচ-ছয় শ বছর আগে মিসরে সময় গণনার ক্ষেত্রে প্রতিটা দিনকে ১২ ঘণ্টায় ভাগ করা হতো বলে জানা যায়। প্রাচীন চীন কিংবা গ্রিক সমাজেও ১২ ঘণ্টায় দিনকে ভাগ করার পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় তেরো শতকের মিসরীয় গণিতজ্ঞ আবু হাসান প্রথম সময় গণনার ক্ষেত্রে দিনকে ১২ ঘণ্টা ও রাতকে ১২ ঘণ্টায় ভাগ করেন। এর থেকেই দৈনিক ২৪ ঘণ্টার সময় গণনার হিসাব চালু হয়।
সূর্যঘড়িই প্রথম সময় গণনার যন্ত্র। গঠন খুব সাধারণ। এই ঘড়িতে ডায়ালের ওপর এমনভাবে বসানো থাকত একটি কাঁটা, যার ছায়া সূর্যালোকের বিভিন্ন অবস্থান অনুপাতে ডায়ালের ওপর এসে পড়ত। এর গায়ে আঁকা থাকত বিভিন্ন ঘণ্টা ও সময়ের চিহ্ন। তাতে পতিত ছায়ার মাধ্যমেই সময় গণনা চলত। সৌরঘড়ি ছিল নানা প্রকার। প্যারিসের ‘লুক্সর অ্যাবেলিক্স’ নামের স্তম্ভটি একটি সূর্যঘড়ি। এ ছাড়া প্রাচীন চীন কিংবা ভারতবর্ষের জলঘড়ি ব্যবহারের কথা আমরা জেনেছি। সূর্যঘড়ির ক্ষেত্রে প্রধান যে অসুবিধা তা হলো, প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যাস্তের পরে সূর্যের আলো এবং তা থেকে তৈরি হওয়া ছায়ার আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। জলঘড়ির সেই সমস্যা ছিল না। একটি ছিদ্রযুক্ত পাত্রে পানি রেখে তার তলায় আরেকটি পাত্র রাখা হতো। নিচেরটিতে সময়ের হিসাব ভাগ করা থাকত। তাতে কতটুকু পানি জমা হলো, সেটা দেখেই সময় নির্ণয় করা হতো। সৌরঘড়ি অথবা জলঘড়ির মতো মোমবাতির আগুন ঘড়ির ব্যবহারের নজিরও বহু জাতির ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। প্রজ্বলিত মোমবাতির আধার ও তার পশ্চাৎপট বা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে তার আগে সময়ের হিসাব ভাগ করা থাকত আলোর অনুপাতে। অথবা মোমবাতির গায়েই নানা রকম রঙ দিয়ে সময়ের চিহ্ন এঁকে দেওয়া হতো। একটা মোমবাতি পুড়তে কত সময় লাগে, সেই হিসাবকে কেন্দ্র করেই নানা দেশ ও সমাজে এই ঘড়ির প্রচলন বেশ জনপ্রিয় ছিল।
এ ছাড়া বালিঘড়ির কথা আমরা শুনেছি। একটার উপরে আরেকটা বসানো এ রকম দুটো কাচের ফানেল যুক্ত পাত্রের মধ্যে বালির ঝরে পড়া থেকে সময়নির্ধারণই হচ্ছে এর বৈশিষ্ট্য। এই ঘড়িতে উপরের কাচের পাত্র থেকে নিচের পাত্রে বালি ঝরে পড়তে সময় লাগে এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টা পর নিচের ফানেলকে উল্টে উপরে তুলে দেওয়া হতো। এইভাবে গোটা দিনের সময় নির্ধারিত হতো। মধ্যযুগের ইউরোপে এই সময়যন্ত্রের বহুল প্রচলন ছিল।
ইতিহাস যতই এগিয়েছে, ততই সময়ের ধারণা ব্যাপ্ত, জটিল ও বিমূর্ত আকার নিয়েছে। সময়ের এই ন্যারেটিভের বদলে যাওয়ার ভেতরেই ঘটেছে ঘড়ির বিকাশ ও বিবর্তন।
গ্রিক পদার্থবিদ আর্কিমিডিসকেই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি প্রথম ঘড়ির আবিষ্কারক বলে চিহ্নিত করেন কেউ কেউ। চাকাযুক্ত ঘড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা নানা গুরুত্বপূর্ণ আলাপেরই অংশ। চাকা বা কাঁটার সঙ্গে ভারী কোনো বস্তু নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিলেই মহাকর্ষ শক্তির টানে সেটি ঘুরতে থাকবে; আর এই ঘূর্ণনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলেই তা আস্তে আস্তে ঘুরবে, সময়ের হিসাবমতো। এই ভাবনা থেকেই যান্ত্রিক ঘড়ির উদ্ভব। পরে এই যন্ত্রে যুক্ত হয় ডায়াল। ১২৮৮ সালে লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার হলে এই ঘড়ি স্থাপন করা হয়। ১২৯২ সালে ক্যান্টারবেরি ক্যাথেড্রালে। ঘড়ি প্রস্তুতকারী হেনরি দ্য ডিক ফরাসি রাজা পঞ্চম চার্লসের হয়ে পনেরো বছর ধরে একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। এগুলোর কোনোটাতেই নিখুঁত সময় গণনা হতো না বললেই চলে। এই শূন্যতা পূরণের জন্য শুরু হয় স্প্রিংয়ের ব্যবহার। গ্যালিলিওর দোলকের সূত্র আবিষ্কারের পরে দোলক যুক্ত ঘড়ি তৈরি হতে শুরু করে। সপ্তদশ শতকে ঘড়িতে নানা পরিবর্তন আসে। শুরু হয় উন্নয়নের যুগ। এরপর পকেটে বহনযোগ্য ‘ওয়াচ’-এর যুগ চলে আসে। পরে পকেটঘড়ি রূপান্তরিত হয় হাতঘড়ি বা রিস্টওয়াচে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে হ্যামিল্টন কোম্পানির পালসার নামে একটি ঘড়ির মডেলের হাত ধরে এলইডি যুক্ত ডিজিটাল হাতঘড়ি বাজারে আসে। তারপর এতে আসে বৈচিত্র্য। ডিজিটাল হাতঘড়ির বাজারে ‘ক্যাসিও’ কোম্পানির রিস্টওয়াচ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এরপর অ্যাডভান্স ইন্টারনেট যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১০ সালেই বাজারে আবির্ভূত হয় স্মার্টওয়াচ। এখন ব্লুটুথ বা ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে স্মার্টফোনের সঙ্গে স্মার্টওয়াচকে সংযুক্ত করে কল কিংবা মেসেজ রিসিভ করা যায়। অডিও প্লেয়ার, ক্যামেরা, এফএম-রেডিও- এসব তো রয়েছেই। এগুলোর সঙ্গে রয়েছে হার্টবিট কাউন্ট করা বা স্টেপ কাউন্ট করা, সারা দিনের কাজ এবং ঘুমের হিসাব করার মতো উপায়।
 অতনু সিংহ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top