skip to Main Content

কভারস্টোরি I উদ্যানের নন্দন

মূলত উদ্ভিদ ও অন্যান্য উপাদানের সুশৃঙ্খল বিন্যাসেই সৃষ্টি হয় উদ্যানের সৌন্দর্য। এটি নির্ভর করে যিনি গড়ে তুলেছেন তার রুচি, সাংস্কৃতিক বোধ এবং অভিজ্ঞতার ওপর। লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম

নন্দনতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ Aesthetics, এসেছে গ্রিক থেকে। যার অর্থ প্রত্যক্ষ করা বা দেখা। অর্থাৎ নন্দনতত্ত্ব মানে প্রত্যক্ষণ শাস্ত্র। কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তির মনের আবেগময় অনুভূতি এবং তার ভাষাগত প্রকাশের মাধ্যমে শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সংগীত ও অন্যান্য মানবিক সৃষ্টি সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়াসকে নন্দনতত্ত্ব বলা যেতে পারে। সাধারণত সাহিত্য, মিউজিক, সিনেমা, নাটক, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি শিল্পের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়ে থাকে এর আলোকে। যদিও গবেষকেরা এটাকে দর্শনের আলোচ্য বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু উদ্যানের নন্দন বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা একটু জটিলই বটে। কেননা, বাগান তৈরি, গাছ নির্বাচন, পরিচর্যা, সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও এর নন্দনতত্ত্ব অনালোচিতই থেকে গেছে।
উদ্যানের নন্দন বলতে নির্মাতার সৌন্দর্যবোধ ও রুচির বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে জায়গা নির্বাচন, বাগান নির্মাণ, বৃক্ষ নির্বাচন, নকশা, পরিচর্যার নিবিড় একটি সম্পর্ক রয়েছে। এবং এটি অবশ্যই সময়, আবহাওয়া ও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। উদ্যানের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্মের বৃদ্ধি, ফুল ফোটা, শাখাপ্রশাখা কর্তনের মাধ্যমে নান্দনিক রূপ দেওয়ার বিষয়টি জড়িত, কাজেই এর সৌন্দর্য সৃষ্টি একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া। এ কারণে উদ্যানের সৌন্দর্য একটি সচল বা চলিষ্ণু নির্মিতি। এর রূপ নির্ভর করে উদ্যান নির্মাতার রুচি, স্থানের পরিধি, সৌন্দর্যবোধ ও শিল্প সম্পর্কে ধারণা এবং অভিজ্ঞতার ওপর।
পৃথিবীব্যাপী পারস্য, ইউরোপীয়, চীন, জাপানের উদ্যানচর্চার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সেসব রীতিই মূলত বিভিন্ন দেশে চর্চিত হয়ে আসছে। তবে তা হচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতি, ভূপ্রকৃতির অবস্থান ও ব্যক্তির শিল্পজ্ঞান অনুসারে, পরিবর্তিত রূপে। প্রাচীন গ্রিসেও উদ্যানের চর্চা ছিল। হোমারের মহাকাব্যে নির্জন বাগানে অধ্যয়নের বিবরণ থেকে এ কথা অনুমান করা যায়। ভারতবর্ষে উদ্যানশিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থে। ঋগে¦দে বাগান তৈরি ও সংরক্ষণ পুণ্য কাজ হিসেবে বর্ণিত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও বাৎসায়নের কামসূত্রে উদ্যানের বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। রামায়ণের অশোকবন এবং অন্যান্য সংস্কৃত কাব্যের মালাকার-মালিনীরা সে যুগের উদ্যানচেতনার সাক্ষ্য। যেমন ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলমে’ আছে আশ্রম বালিকা শকুন্তলার বৃক্ষ পরিচর্যা ও জলসেচনের অসাধারণ বর্ণনা। ওই তপোবন-সম্পর্কিত আলংকারিক কাব্যপঙ্ক্তি থেকে ধারণা করা যায়, সেটি ঠিক অরণ্য নয়, সুরোপিত উদ্যানেরই প্রাথমিক রূপ। প্রাচীন বঙ্গে উদ্যান রচনার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এ অঞ্চলের মহাস্থানগড়, ময়নামতি, উয়ারি বটেশ্বর বা পাহাড়পুরের বিহার, মঠ ও মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছিল সুদৃশ্য বাগান।

দুই
প্রাচীন শাস্ত্র ও কাব্যে উদ্যানের উল্লেখ থাকলেও ভারত উপমহাদেশে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয় মোগলদের শাসনামলে। পারস্য থেকে এই শিল্প পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলেও এটির বিকাশ ঘটে। আরেকটি ধারা আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চল অতিক্রম করে স্পেনে পৌঁছায়। সেখানকার ‘মরিয়া লুইস পার্কে’ এখনো টিকে আছে তার ধূসর স্মৃতি। পরবর্তীকালে বাংলা অঞ্চলের উদ্যানশিল্প অনেকটাই মোগল বা পারস্য উদ্যানচর্চার মিশ্রিত প্রভাবের ফল। বিশেষত, মসজিদ ও প্রাসাদকে কেন্দ্র করেই এর চর্চা হতো। যদিও এ দেশে যেসব উদ্যান সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা এখন সঠিক পরিকল্পনা ও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তপ্রায়। উদ্যানের নন্দন আলোচনা করতে গেলে এ বিষয়ে স্মরণ রাখা প্রয়োজন। কেননা, যেসব বাগান এখনো আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে টিকে আছে, তা ওই মোগল আমলের পারস্যরীতিরই প্রতিচ্ছবি বহন করে চলেছে। তবে কোথাও কোথাও, বিশেষত প্যালেস বা সুরম্য ভবনকে কেন্দ্র করে নির্মিত, উদ্যানে ইউরোপীয় রীতির কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
মোগল উদ্যান রীতি মেনে তৈরি। বাগানে জলধারার বিন্যাস, রঙিন ফুল-পাতার মাধ্যমে ছায়া ও রঙের প্রাচুর্য সৃষ্টি, পাথর, ইট, কাঠ, বৃক্ষের মৃত কান্ড ব্যবহার করে বাঁধানো বেদি, মৌসুমি ফুলের সমাহার, গোলাপের ঝাড়, দেয়াল বেয়ে উঠিয়ে দেওয়া লতাগুল্ম, ক্যাকটাস, সাইপ্রেস গাছের বেষ্টনী, জ্যামিতিক আকারে ছককাটা সবুজ ঘাস, মাঝে মাঝে চলাচলের জন্য পাথর বা কংক্রিটের স্ল্যাব বসিয়ে পথ নির্মাণ, সীমানার দিকে ঘন পাতা ও ডালপালা যুক্ত বড় বৃক্ষ- এসবই প্রায় মোগলদের, অর্থাৎ পারস্যরীতির উদ্যানের বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে, সেখানে দেখা যায় পাথর কিংবা ইট বাঁধানো খাল অথবা চৌবাচ্চায় স্তরে স্তরে লাফিয়ে পড়া পানির কলধ্বনি, উচ্ছ্বসিত ঝর্নার মর্মর, ফেনার সাদা উদ্ভাস, ফোয়ারার মধ্যে কালো পাথরের মঞ্চ। ছায়াঘন বৃক্ষরাশি ও জ্যামিতিক ছককাটা গাছ বা ঘাসের সবুজ প্রাঙ্গণ। পুরো উদ্যান বর্গক্ষেত্র বা আয়তাকার। বাগানের ভেতরের অংশও একই রীতিতে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগ আবার সরলরেখায় বিন্যস্ত পথের জ্যামিতিক নকশায় জুড়ে দেওয়া। ফলে উদ্যানে প্রবেশের প্রধান ফটক থেকে এসব রাস্তা ধরে একেবারে শেষ পর্যন্ত যাওয়া যায়। তা ছাড়া চারদিকে সুরম্য প্রাচীর, দুই কিংবা চারটি বিশাল তোরণ, রঙিন মার্বেল, আলো ও জলধারার প্রাচুর্যই প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি ভাগে প্রায় একই ধরনের ফুল বা ফলের গাছ দেখা যায়। মিশ্র রোপণও অনুপস্থিত ছিল না সেসব উদ্যানে। তবে, সেখানে প্রায় প্রতিটি গাছই ছেঁটে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়া হতো। তা কখানো গম্বুজ বা সুউচ্চ মিনারের সৌন্দর্যে রূপময় হয়ে উঠত।
ভারত উপমহাদেশে মোগল উদ্যানের সংখ্যা প্রচুর। যেমন আগ্রায় সম্রাট বাবরের উদ্যান, শাহজাহানের আঙ্গুরী বাগ ও তাজমহল উদ্যান, দারাশিকোর বিজির বাগ, কাশ্মীরে আকবরের সালিমার উদ্যান ও জাহাঙ্গীরের নাসিম বাগ, লাহোরে শাহজাহানের সালিমার বাগ, দিল্লির লালকেল্লার বাগান, হায়াত বকশ ও মেহতা বাগ, মোবারক বাগ এবং এনায়েত বাগ, কাশ্মীরের নিশাত বাগ উল্লেখযোগ্য।
তবে, মোগল উদ্যানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এ দেশে পরবর্তীকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিবর্তিত হয়নি। তা কেবল জাতিগত উদাসীনতা ও অবহেলার কারণেই নয়, এর পেছনে রয়েছে কালের প্রভাব। সি এম ভি স্টুয়ার্ট ‘গার্ডেন্স অব দ্য গ্রেট মোগলস’ বইয়ে দুটি উল্লেখযোগ্য কারণের কথা জানিয়েছেন। তার মতে, মোগল উদ্যানশিল্প গড়ে উঠেছিল গ্রীষ্মের উত্তাপ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরিকল্পনায়, কিন্তু যানবাহনের উন্নতি, ভ্রমণশিল্পের প্রসার ও শৈলাবাসের জনপ্রিয়তার ফলে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বাগান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত উদ্যানের চাইতে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে, নাতিশীতোষ্ণ পর্বতে গীষ্মের অবসর কাটানো বেশি উপভোগ্য। বিত্তশালীদের রুচির এই পরিবর্তনই মোগল উদ্যানের বিপর্যয় ঘটিয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেকোনো শিল্পই স্থান-কালের প্রভাবে রূপান্তরিত হয়। তাই, কাঠামোবদ্ধ শিল্প পরিকল্পনা পাশ্চাত্যে বর্জিত হলে তার রেশ মোগল উদ্যানচর্চাতেও দেখা যায়।
ইউরোপীয় রীতিতে উদ্যানের মধ্যে, বিশেষ কোণে বিভিন্ন আকৃতির ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। আবার বাগানের মধ্যভাগে বড় কোনো ভাস্কর্যকে ঘিরে ফোয়ারা নির্মিত হয়। আমাদের দেশের কোনো কোনো বিলাসবহুল জমিদারবাড়ির উদ্যানে পারস্য ও ইউরোপীয় রীতির সংমিশ্রণে উদ্যানশিল্পচর্চার দেখা মেলে। যেমন পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন, রোজ গার্ডেন, ময়মনসিংহের শশী লজ বা নাটোরের উত্তরা গণভবনের উদ্যান।
চীনের উদ্যানশিল্পের রয়েছে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ শ্রমণ ও পর্যটকদের তীর্থ-পরিক্রমায় ভারত এবং পারস্যের সঙ্গে চৈনিক উদ্যানের আদান-প্রদান ঘটেছিল। সেটি বিকশিত হয়েছিল মূলত জাপানে। তাই, জাপানি উদ্যানচর্চা কিছুটা চীনেরই রূপান্তরিত প্রণালি। এই শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য বিশ^ স্বীকৃত। সেখানে স্থানীয় রীতির ভবনের চারপাশে রোপিত হয় বর্ণময় ফুলের গাছ, লতাগুল্ম। ভবনের দেয়াল বা ছাদের কার্নিশ বেয়ে থাকে ঝুলন্ত সবুজ গুল্মের সমাহার। চীন-জাপানের উদ্যানশিল্পের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে জলাধার। তার ওপর সুদৃশ্য সাঁকো। জলজ উদ্ভিদের প্রাচুর্য। বাগানের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকে কংক্রিটের টুকরো টুকরো স্ল্যাব বা পাথর বিছানো সরু রাস্তা। বনসাইও তাদের উদ্যানশিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার একটি দিক হতে পারে। মিনিয়েচার উদ্যানের চর্চাও তাদের এই শিল্পকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
উদ্যানতত্ত্ববিদ আর্থার কোয়েসলারের মতে, জাপানি শিল্পরীতির মূলে রয়েছে তাদের রোমান্টিক বিষণ্নতা। যা সেখানকার উদ্যানচর্চায় প্রভাব ফেলে। ওদেশের দুর্বল ভূপৃষ্ঠ, ভূমিকম্প এবং অন্যান্য অস্থিরতার বিমূর্ত শিল্পরূপ নাকি বালু-উদ্যান, বিকলাঙ্গ গাছগাছালি ও বনসাই।

তিন
প্রকৃতির লীলানিকেতন বাংলাদেশ। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। কিন্তু এসব প্রকৃতি নানান কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, বিশেষ করে বনাঞ্চলগুলো। কেননা প্রকৃতির প্রতি আমরা তেমন কোনো দৃষ্টি দিইনি। অন্যদিকে শহরাঞ্চলের উদ্যানগুলো ক্রমশ বৃক্ষশূন্য করে তোলা হচ্ছে। যেমন ঢাকা শহরের বাগানগুলো সৃষ্টি করার একটা রাজনৈতিক পটভূমি আছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৮ সালে ঢাকার রমনা উদ্যান তৈরি করা হয়। এর স্থপতি ছিলেন লন্ডনের কিউ উদ্যানের কর্মী আর এল প্রাউডলক। কিন্তু পরবর্তীকালে এর সংরক্ষণ ও পরিচর্যা সঠিকভাবে করা হয়নি। ফলে একটি নন্দনতাত্ত্বিক উদ্যান রচনার সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হয়।
নান্দনিক উদ্যান বা উদ্যানের নন্দন বিচারের ক্ষেত্রে এ জন্য লক্ষ রাখতে হবে সুষ্ঠু বিন্যাসের ওপর। কেননা শিল্পিত ও পরিকল্পিত বিন্যাস ছাড়া কোনো উদ্যানই নান্দনিক হয়ে উঠবে না। এর সঙ্গে মাটির বৈশিষ্ট্য অনুসারে বৃক্ষ নির্বাচনের বিষয়টিও জড়িত। কোন বৃক্ষ কোথায় রোপিত হলে একটি উদ্যান পরিবেশ ও প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, সেটি বোঝাও জরুরি। কেননা, প্রকৃতির আপন বিন্যাসে আজকের নাগরিক মন আর তুষ্ট নয়। কল্পনা ও সৃজনশীল অভিজ্ঞতার মাধুরীতে তাকে নতুন করে সাজানো এ কালের দাবি। শুধু নান্দনিক তাৎপর্যই নয়, অর্থনৈতিক প্রলোভনও এতে কম নেই। তা ছাড়া কেবল সে জন্যও নয়, সুষম মানস গঠন, স্বাস্থ্যকর ও দূষণমুক্ত পরিবেশ, শিক্ষা এবং সৃজনশীলতা বিস্তারেও নিসর্গের শৈল্পিক বিন্যাস অপরিহার্য। এই ভাবনা এখন কল্পনার স্তর পেরিয়ে একটি বিশিষ্ট তত্ত্বের গুরুত্ব পেয়েছে। বায়োঅ্যাসথেটিকস বা জীবনন্দনতত্ত্ব। যেটি মূলত শিল্প ও বিজ্ঞানের মধ্যে বিদ্যমান ফারাকের ওপর নির্মিত সামান্য একটি সেতুবন্ধ। জীববিদ্যা ও নন্দনতত্ত্বের মিশেলে গড়ে ওঠা এই চিন্তা-প্রণালি উদ্যানচর্চায় হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, বাগানের বৃক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জোর দেওয়া প্রয়োজন প্রাণবৈচিত্র্যের আনুকুল পরিবেশ বজায় রাখার উপর।
বৃক্ষ নির্বাচন অবশ্যই বাস্তুসংস্থান অনুযায়ী হওয়া দরকার। একটি উদ্যানে বড়, মাঝারি বৃক্ষ যেমন থাকবে, তেমনি লতাগুল্ম, ঝোপঝাড়জাতীয় গাছও শোভাবর্ধনের জন্য প্রয়োজন। রাখতে হবে ফল, ঔষধি ও ফুলের গাছ। আবার শীতে পাতা ঝরে যাওয়া বৃক্ষের পাশাপাশি যেসবের পাতা অটুট থাকে এমন গাছ নির্বাচন করতে হবে। যেন কোনো ঋতুতেই উদ্যান একেবারে সবুজশূন্য হয়ে না পড়ে। এসব গাছের ঘন পাতার আড়ালে পাখিরা বাসা বাঁধবে, গাছের ফল খাবে। ঝোপঝাড়ে কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি থাকবে। জলাধার উদ্যানের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। এতে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করতে পারে। তা ছাড়া পানির প্রবাহ কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে জলাধারের পানি গাছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যায়। এই ইকোসিস্টেমের মধ্য দিয়েও একটি উদ্যান প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নান্দনিক হয়ে ওঠে। তা ছাড়া বড় গাছের বর্ধিত ডাল যেন ঝড়ে ভেঙে পড়ে ভ্রমণকারীদের আহত না করে বা ছোট গাছকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সে জন্য নিয়মিত ট্রিম করতে হয়।
নিয়মিত গাছের বর্ধিত শাখা-প্রশাখা কেটে সামঞ্জস্য ও শৈল্পিক করে তোলাও নান্দনিক উদ্যানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ জন্য বাগানের কোন অংশে কী ধরনের বৃক্ষ রোপণ এবং কীভাবে তা বিন্যাসিত হবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কোন গাছ কীভাবে ট্রিম করা যায়, তার ওপরেও নির্ভর করে উদ্যানের সৌন্দর্য। কখনো এই ট্রিমিংয়ে গাছের সারি হয়ে উঠতে পারে ঢেউখেলানো। কখনো বিভিন্ন ভবন বা পশুপাখি অথবা কোনো প্রতীকী সৌন্দর্যের কাঠামো অনুসরণে নান্দনিক। কিন্তু মূল লক্ষ্যই থাকে সৌন্দর্যবর্ধন। এ জন্য স্থান বিবেচনায় গাছ নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। বাগানের কোন অংশে কী গাছ- অর্থাৎ ফলদ, বনজ, ঔষধি, পুষ্পবতী, লতাগুল্ম, কাঁটাযুক্ত অথবা মজবুত কান্ডের বড় বৃক্ষ- এসব পরিকল্পনা আগেই করে নেওয়া প্রয়োজন। অতঃপর তা রোপণের উপযুক্ত ক্ষেত্র বেছে নেওয়ার পর্ব। তবে মনে রাখা দরকার, পুরো বাগানে যেন রোদ বাধাগ্রস্ত না হয়। মানে, বড় বৃক্ষের ছায়ায় ছোট গাছ বা লতাগুল্মের সারি যেন ঢেকে না যায়। এ জন্য বৃক্ষরোপণ কৌশলে থাকতে হয় জ্যামিতিক নকশা। কোণাকৃতি, বৃত্তাকার বা সরলরেখার নানান বিন্যাসে বাগান হয়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন। কেবল সৌন্দর্যই নয়, জ্যামিতিক নকশার ফলে জায়গারও উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। যেমন মুজিবনগরের আ¤্রকানন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। এই বাগানের যেকোনো প্রান্তে দাঁড়ালেই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে সরলরেখায় রোপিত সারি সারি আমগাছের অপূর্ব জ্যামিতিক নকশা।
উদ্যানের জায়গা বা স্থান বলতে গ্রাম এবং নগরের পরিবেশের মধ্যে পার্থক্যও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা। গ্রামীণ এলাকার পতিত ও অনুর্বর জমি, নদী বা জলাশয়ের পাশের ভূমিগুলো বাগান তৈরির উপযুক্ত করে পরিকল্পিত হওয়া দরকার। সে জন্য গাছ নির্বাচন এবং নকশারও থাকতে হবে ভিন্নতা। শহরের বিস্তৃত রাজপথের দুপাশে বা পরিকল্পিত উদ্যানে বৃক্ষরোপণ দেশীয় নিসর্গের মূল্যবান সম্ভাবনা। সেখানে পথ বা বাগানের তরুরাজি শিল্পরুচি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য দাবি করে। কেননা, ছায়া ও সৌন্দর্যের সঙ্গে আবর্জনা বৃদ্ধি, ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা এবং মাটির গভীরে প্রবিষ্ট শিকড়ের আক্রমণে ভবনের ভিত, পানি-বিদ্যুতের লাইন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। এসব বিবেচনায় না নিলে শহরের উদ্যানে বৃক্ষরোপণ সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই গাছের আকার, আয়তন, রং এবং পাতা ও ফুলের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকার বৈশিষ্ট্য, শহরবাসীর রুচি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যচেতনাও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা জরুরি।
কেবল দেশি বা স্থানীয় প্রজাতির নয়, বিদেশি বিভিন্ন গাছও রোপণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে, সেসব বৃক্ষ বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। এভাবে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ উদ্যানশিল্পকে নতুন নতুন প্রজাতির বৃক্ষের সমাহারে সমৃদ্ধও করা সম্ভব।
উদ্যানের নন্দনভাবনায় রংবেরঙের পাথর, মৃত গাছের কান্ড, পোড়ামাটির খন্ড ইত্যাদি বাড়তি সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সবুজ ঘাসের চত্বরে বা বড় বৃক্ষের গোড়া বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য এসব উপকরণ ব্যবহার করা যায়। এতে গোড়ার মাটি আলগা হয়ে যাবে না, অন্যদিকে গাছের ছায়ায় বসবার উপযুক্ত স্থানও নির্মিত হবে। তবে উপকরণ নির্বাচনে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গগুলোই প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। তাতে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে। কেননা, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বায়োঅ্যাসথেটিকস বা জীবনন্দনতত্ত্বের বিষয়টি।
এসবই উপকরণের দিক। কিন্তু উদ্যানের নন্দন মূলত দেখার দৃষ্টি ও বস্তুর বিন্যাস এবং পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে। কেননা প্রকৃতিকে পরিকল্পিত ও আধুনিক বিজ্ঞানের নানান ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত করে তোলাও একধরনের নন্দনতত্ত্ব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশকে ইতিবাচক অর্থে কাজে লাগানো প্রয়োজন। প্রকৃতিকে আধুনিক ও মানবকল্যাণমুখী চিন্তার অংশ করে তোলাও দরকার। তা না হলে উদ্যানশিল্প যেমন ব্যর্থ হবে, তেমনি মানুষের বাসযোগ্য প্রকৃতিও হয়ে উঠবে বৈরী। প্রকৃতি আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলার অফুরন্ত ভান্ডার। সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে অজ¯্র উপকরণ। প্রকৃতির এসব উপকরণকে মনের কল্পনা, আবেগ ও আপন ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নানান বিন্যাসে সাজিয়ে তোলাই হলো উদ্যানের নন্দন।

সহায়ক গ্রন্থ
দ্বিজেন শর্মা : শ্যামলী নিসর্গ, ১৯৮০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
Arthur Koestler : The Lotus and the Robot, 1960, Macmillan
C. M. Villiers Stuart : Gardens of the Great Mughals, 1913, London

মডেল: সারা আলম
ওয়্যারড্রোব: কোরাল ক্লসেট বাই রূপো শামস
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন
কৃতজ্ঞতা: রূপো শামস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top