রসনাবিলাস I নস্টালজিক মেনুর উনান
এ যেন খেতে গিয়ে স্মৃতির নেশায় মগ্ন হয়ে যাওয়া। মানে এ রেস্তোরাঁয় এমন কিছু খাবারের আয়োজন রয়েছে, যেগুলো অতিথিকে স্বাদগন্ধময় অতীতের উজ্জ্বলতায় টেনে নিয়ে যায়
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা এখনকার মতো ফি হপ্তায় বার চারেক বাইরে খেতে যেত না। প্রতি মাসের শেষ বা শুরুর এক দিন পরিবারের কর্তা সবাইকে নিয়ে বেরোতেন। এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে, ঘরের বাইরের খাবার মানে ছিল কারও জন্মদিন বা বিয়ের নেমন্তন্ন। তবে খেতে বেরোনোর দিনটি ছিল উৎসবের! ঘরফেরতা শিশুদের হাতে হয়তো বেলুন বা মুখোশ দেখতে পাওয়া যেত। সে সময়ের স্কুলের ছেলেমেয়েরা সপ্তাহজুড়ে টাকা জমাত, বৃহস্পতিবার প্রিয় ফাস্ট ফুডের দোকানে বসত এক গাদা সস দিয়ে রুটির উপর তরকারি মাখানো পিৎজার আশায়। বেহিসেবি মিলেনিয়াল কিডরা হয়তো সেসব দিনের মর্ম বুঝবে না।
তবে জাগতিক নিয়মের একখানা চক্র আছে, ঘুরেফিরে সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। তাই হয়তো এমিল বইরাকের দেজা-ভুর মতো দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয় চোখের সামনে, হয়তো স্বাদেন্দ্রিয়কেও তা নাড়া দিয়ে যায়- অদ্ভুত ভালো লাগায়।
উনান। রুফটপ রেস্টুরেন্ট। লিফট থেকে নেমে তাকালেই সারি সারি চেয়ার-টেবিল দেখা যায়। এসব আসবাব আর ঝুলন্ত বাতির রোশনাই এড়িয়ে কংক্রিটের নগরীও চোখে পড়ে। প্রথম অংশটা ইনডোর। লিফটের ডান দিকে এগোতেই ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে কোভিড-সতর্কতা নির্দেশনা। ডানে ছোট্ট রিসেপশন কাম ক্যাশ কাউন্টার। এরপর র্যাকে সাজানো বই। ইনডোর সজ্জা শেষে সেমি-ইনডোর অংশ। হাতের ডানে ওপেন কিচেন, বামে বসার কোজি-কম্ফি আয়োজন। একটা দোলনাও রয়েছে। পায়ের তলায় নুড়ি-পাথর রেখে ওপেন কিচেনের দিকে তাকালে দেখা মেলে সিলিং থেকে ঝুলন্ত বোতল ও আলোর ইন্টেরিয়র। বামে বসার টেবিলে শোভা পাচ্ছে ফার্ন, কয়েন প্ল্যান্ট। দেয়ালে ঝোলানো মনরো আর কাহলো, তাদের সঙ্গ দিচ্ছে আরও কিছু এলোমেলো চিত্রকর্ম।
গোটা দেয়ালটাই যেন এক ক্যানভাস। মাথার উপর বেত-মুর্তার তৈরি ল্যাম্পশেড। এরপরে সিঁড়ি মাড়িয়ে আরেকটু উপরে উঠতেই আউটডোর অংশ। সিঁড়ির সঙ্গেই একখানা ফিলোডেন্ড্রন পাতা ছড়িয়ে রয়েছে বাঁশঝাড়ের সঙ্গে। শীতের হিমধরা অলস দুপুরে এক কাপ কফি নিয়ে বসতে পারলে মন্দ হতো না। গ্রাউন্ড বিনের কফি এখনো তার জায়গা করে নিতে পারেনি উনানে। দুধ-চা হাতে করে ঢাকার নগরদৃশ্য দেখা যায়। পুরোটা ছাদ সবুজ, মর্নিং গ্লোরি আর বোগেনভিলিয়ার ফুল ফুটে ছাদকে আলোকিত করেছে।
পায়ের কাছে মার্শ পেনিওর্ট (কয়েন প্ল্যান্ট) আর ফার্নের ঝোপ। গাছ শুধু সেমি-ইনডোর বা আউটডোর অংশেই নেই, রয়েছে ইনডোরে, প্রসাধনেও। রেস্টুরেন্টজুড়ে সবুজের ছোঁয়া রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরো ইন্টেরিয়র-এক্সটেরিয়রের পরিকল্পনায় ছিল স্থাপত্যবিষয়ক সংস্থা রিরা পিডি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই রেস্তোরাঁর পরিকল্পনা করতে গিয়ে প্রথমত স্থান সংকুলানের ব্যাপারটা ভাবনায় নেওয়া হয়েছে। তারপর তিনটি ভিন্ন পরিবেশ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ঢাকার আবহাওয়ার বিষয়টা মাথায় রেখে। তবে সব জায়গাতেই রয়েছে সবুজের ছোঁয়া।
দুপুরের খাবারের সময়টা মানুষের কোলাহলে মুখরিত থাকে। ছেলেমেয়ের একটা দল এসেছে, মেনু দেখছে, নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে, বোঝা গেল সবার পকেটের পয়সায় মিলেমিশে ফিস্টি হবে। এই দৃশ্যটাও শেষ কবে চোখে পড়েছে- মনে করা কঠিন। শুরুতে যে ৯০-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার কিছু আভাস এই মিলেনিয়াল কিডদের মধ্যে দেখা গেল। এর মধ্যেই সামনে হাজির হয়েছে স্বচ্ছ তরল, তাতে রয়েছে লেবু-পাতা, লেবু-ঘাস, গালাঙ্গাল (থাই আদা), দেশি আদা। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে মীনখন্ড, নারকেলি (নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপের অধিবাসীরা স্কুইডকে এ নামেই ডাকে) আর চিংড়ি। মূল খাবারের আগে এই স্যুপ ক্ষুধাটাকে একটু জাগিয়ে তোলে। স্বাদ অসাধারণ। গালাঙ্গালের পাশাপাশি দেশীয় আদা অন্য এক মাত্রা দিয়েছে স্যুপটায়। এরপর টেবিলে এলো কিং প্রন আর হট গার্লিক ক্র্যাব। বিশালাকারের দাঁড়াসহ তিনখানা চিংড়ি লাল গ্রেভিতে মাখামাখি হয়ে আছে। যারা সি ফুড পছন্দ করেন, তাদের কাছে এর থেকে মোহনীয় দৃশ্য আর কী হতে পারে! সংগত হিসেবে এলো গার্লিক রাইস। জানা গেল, উনানের কিচেনে ব্যবহৃত হয় বাটার-অয়েল।
রাইসের স্বাদ বুঝতে এক চামচ মুখে দিতেই হালকা মাখন আর রসুনের স্বাদ পাওয়া গেল। গ্রেভিতে রয়েছে গত শতকের শেষ দশকের স্বাদ। এমনই সিম্পল, অথচ স্বাদের জৌলুশ রয়েছে, তেমন খাবারগুলো খাওয়া হতো- ওই সময়ে, মাসে একদিন। সেই পুরোনো ঢঙের রান্নায় দেশীয় চায়নিজের একটা অনবদ্য স্বাদ জড়িয়ে আছে এখানেও। এরপরে পাতে আসা রসুনের সঙ্গে ঝাল ঝাল স্বাদে রান্না কাঁকড়া এলো। একই রকম, নস্টালজিক সেই খাবার। জানা গেল এই রেস্টুরেন্ট আসলে হতে চেয়েছিল ফ্যামিলি ডাইন। করোনার প্রকোপ সেই পথে খানিকটা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিলেও ধীরে ধীরে এর ইন্টেরিয়র, খাবার ওয়াই জেনারেশন তো বটেই, টার্গেট গ্রুপকেও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। আস্তে-ধীরে চিংড়ি আর কাঁকড়া খেতে খেতে কথা হলো রেস্টুরেন্টের আদ্যোপান্ত নিয়েও। জানা গেল, রাতে এই ছাদের আলোয় বসে জমজমাট আড্ডা। চা রয়েছে, আছে ইনস্ট্যান্ট কফি, আড্ডার সঙ্গী হিসেবে।
প্রগতি সরণির মুখে গড়ে তোলা এই রেস্টুরেন্টের মেনু বেশ লম্বা। কেবল মুখ চালু করার খাবারই রয়েছে সতেরো পদের- মানে স্টার্টার। সব মিলিয়ে রয়েছে ৬০টির বেশি আইটেম। তবে ক্র্যাব হট গার্লিক; রেডস্ন্যাপার হট গার্লিক; রুপচাঁদা ভাজি; কিং প্রন হট গার্লিক; বারবিকিউয়ে রয়েছে কিং প্রন, রুপচাঁদা আর রেডস্ন্যাপার; স্টিম রেডস্ন্যাপার- উনানের সি ফুড তালিকা এগুলো দিয়েই সরগরম। রয়েছে ‘ফিশ অ্যান্ড ডিশ’ নামের একটি বিশেষ প্ল্যাটার। এতে সামুদ্রিক মাছসহ সব ধরনের মৎস্যের স্বাদ নেওয়া যায়।
বাচ্চাদের জন্য রয়েছে স্পেশাল মেনু- ললি, আইসক্রিমসহ আরও কিছু। এর বাইরে রয়েছে স্যালাড, স্যুপ, চিকেন, বিফ, ভেজিটেবল, প্রন, রাইসের নানা পদ। আরও রয়েছে তাবল দ্যোৎ অর্থাৎ সেট মেনু, এর ভেতরে আবার উনান স্পেশাল প্ল্যাটারও রয়েছে। আছে নানা পদের ঠান্ডা ও গরম পানীয়।
এখানে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতাই আসলে চমকপ্রদ। পরিবেশ, মেনু আর সঙ্গীসাথি মিলে ঢাকাই খাবারের রেট্রো ট্রেন্ডটা অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ঠিকানা: ৭৮, ফিরোজা ইন, প্রগতি সরণি, কুড়িল চৌরাস্তা, ঢাকা ১২২৯
ফোন: ০১৬২৭ ১৮০ ২৬৯
ফেসবুক: unaanrooftoprestaurant
আল মারুফ রাসেল
ছবি : লেখক ও রিরা পিডি