skip to Main Content

আলাপন I অন্ধকার সমাজে আলো পৌঁছে দেবে নতুন প্রজন্ম – রোকেয়া কবীর

বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের সম্মুখ সারির ব্যক্তিত্ব। আশির দশকে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন সংগঠন। তার চেয়ে বড় পরিচয় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বানে উদ্দীপ্ত হয়ে অনেকেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গান গেয়ে, কবিতা পড়ে, সাহস জুগিয়ে অথবা অস্থায়ী চিকিৎসালয়ে আহতদের সেবা দিয়ে প্রাণিত করেছেন অনেক নারী। তাদেরই একজন রোকেয়া কবীর। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। দায়িত্ব পালন করছেন ‘নারী প্রগতি সংঘ’র নির্বাহী পরিচালকের। ক্যানভাসের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইসুল রাণা

ক্যানভাস: বৈষম্যমূলক সমাজের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কতটা গুরুত্ব পেয়েছিল? পেয়ে থাকলে আজকের প্রেক্ষাপটে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
রোকেয়া কবীর: প্রথমে বলে নিই, আমি নারী মুক্তিযোদ্ধা নই। আগে মুক্তিযোদ্ধা, পরে নারী। আমাদের মিডিয়ায় ভাষার ব্যবহার সঠিক করতে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটা এখনো সম্ভব হয়নি। সুতরাং সমাজ পরিবর্তনের কাজটা সম্পূর্ণ করতে এখনো অনেক দেরি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল বিষয় ছিল একটি বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ার। সেখানে মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপটি বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। বাংলাদেশিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা পেত না এবং চাকরি-বাকরিতেও তারা বৈষম্যের শিকার হতো। ফলে একসময় তারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। তখন নারীমুক্তির বিষয়টি সেভাবে সামনে আসেনি, তবে আমাদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির যে ভাবধারা, সেখান থেকে যদি আমরা মুক্ত হতে পারি, তাহলে নারীদের সমান অধিকারের বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
ক্যানভাস: একটি স্বাধীন দেশে নারীমুক্তির বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
রোকেয়া কবীর: নারীমুক্তির প্রসঙ্গটি মূলত বৈষম্য দূরীকরণের। জাতীয় আন্দোলন বা সমাজের এনলাইটেনমেন্ট যেটা ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের সময় হয়েছিল গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বাংলাদেশ, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া বা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় নারীমুক্তির আন্দোলন হচ্ছে গণতন্ত্র ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মৌলিক কাজ। কারণ, নারী ও পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটা সমাজের ৫০ শতাংশ মানুষের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। নারীর বিরুদ্ধে যে বৈষম্য চলছে, এটা সমাজের অনেকে অনুভব করে না। কারণ, তাদের চিন্তাচেতনা, আচার-আচরণ, কথাবার্তা পুরুষতন্ত্রের বিভীষিকায় আচ্ছন্ন। একটা গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে হলে পুরুষতান্ত্রিক আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হতে হবে। সে জন্যই নারী আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যানভাস: নারী স্বাধীনতার কোন সূচকে পৌঁছাতে পারলে আমরা ধরে নিতে পারি, নারীমুক্তি ঘটেছে?
রোকেয়া কবীর: আমাদের সমাজে নারী স্বাধীনতা বললেই পুরুষেরা যেভাবে যথেচ্ছচার করে, সমাজ সেটাই সূচক হিসেবে ধরে নেয়। আসলে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টাই স¦াধীনতার মাপকাঠি হওয়া উচিত। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আমাদের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদের মুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই যে আমরা আমাদের দেশটা স্বাধীন করলাম, এই ভূখন্ডটা সব মানুষের দেশ হয়ে ওঠেনি বলেই কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ে এখনো আন্দোলন করছে। এখন তেমনিভাবে দেশের ৫০ শতাংশ নারী দেশটাকে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন শুরু করেছে। সুতরাং এই আন্দোলন আমাদের সমাজকে আরও গণতান্ত্রিক করবে। আমরা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছি- নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র। আমরা আমেরিকার উদাহরণ দিতে পারি। আমেরিকায় নির্বাচনের মাধ্যমে ট্রাম্পের মতো কিট ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। এটা মূলত গণতন্ত্রের কুফল। আসলে শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, এইখানে সব মানুষের মধ্যে কে কতটুকু অধিকার পেল না পেল, এইটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। এটাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সেটা প্রতিষ্ঠিত হলে ট্রাম্পের মতো লোক কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে নারীবাদের চর্চা সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।
রোকেয়া কবীর: আসলে নারী আন্দোলনের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শুনে আসছি, ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই যে ইজ্জতের বিনিময়ে- এই কথাটা প্রটেস্ট করতে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ এখনো জনযুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ ছিল, এটা যে শুধু দুই দেশের আর্মিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেখানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল, বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে- সব জায়গায় নারী অংশগ্রহণ করেছে এবং সেই বিবরণ ব্যাপকভাবে বইপত্রে ও লোকমুখে প্রচারিত আছে। নারীদের এসব কর্মকান্ড মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে দেখা হয় না। এটা মূলত আমাদের জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির মূল দুর্বলতা।
মুক্তিযুদ্ধে ভোকাবুলারি ব্যবহার করা হয় যে, নারীদের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। আসলে নারীরা তো স্বেচ্ছায় তাদের ইজ্জত বিলিয়ে দেয়নি, তাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছিল। তারা নির্যাতনের শিকার। তারা মূলত যুদ্ধাহত- এই কথাটা বলা উচিত। এটা আমরা নব্বই দশকের পর থেকেই বলে আসছি।
বিয়ে, চাকরি, সম্পত্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের আইনগুলোর সংস্কার হওয়া উচিত। বলা যায়, নারীসহ সমাজের সব অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে আমরা কাজ করছি।
ক্যানভাস: ‘নারী প্রগতি সংঘ’-এর পেছনের গল্পটি জানতে চাই। এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে কী কী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন? অনুপ্রেরণাই-বা পেয়েছেন কোথা থেকে?
রোকেয়া কবীর: আমার যেদিন মাস্টার ডিগ্রি শেষ হলো, ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট। আমি তখন রোকেয়া হলের ভিপি ছিলাম। এ সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। আমরা যেহেতু ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, তখন ছাত্রলীগের যারা, তারা বঙ্গবন্ধুকে রোকেয়া হলে আসতে দেবে না। তখনকার সময়ে আমাদের প্রভোস্ট ছিলেন ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিম। তার মাধ্যমে চেষ্টা চরিতার্থ করে বঙ্গবন্ধুকে রোকেয়া হলে আনার একটা ব্যবস্থা করলাম।
এই ঘটনার ঠিক এক দিন পরে ভোরবেলা নীলিমা আপা আমাকে ডেকে বললেন, রোকেয়া, তোমার হলে থাকা ঠিক হবে না। তো আমার বড় ভাই থাকতেন কলাবাগানে, সেখানে গেলাম। এমন করে ভাইবোনদের বাসায় থাকা শুরু করলাম। তখনই আমি ওয়ার্ল্ড ফার্টিলিটি সার্ভেতে সুপারভাইজার হিসেবে যোগদান করি। পরবর্তী সময়ে বিআইডিএসএর একটি প্রজেক্টে কাজ করেছি। ওয়ার্ল্ড ফার্টিলিটি সার্ভেতে আমার কাজ করার উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার বাইরে চলে যাওয়া। তখন সেই সময়কার সরকার কমিউনিস্ট নেতাদের ধরপাকড়ও শুরু করছে। আমারও গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাই নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ঢাকার বাইরে চলে গেলাম। ইতিমধ্যে এক রাজনৈতিক দল থেকে আমাকে বলা হলো নারী ইউনিট নিয়ে কাজ করার। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল নারীর কল্যাণে আলাদা একটি সংগঠন তৈরি করা। সেইভাবে ১৯৮৫, ৮৬ দুই বছর সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তুতি শুরু করি। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোদমে ‘বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ’র যাত্রা শুরু হয়।
ক্যানভাস: বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা জানতে চাই, যা আপনাকে আজও আলোড়িত করে।
রোকেয়া কবীর: আমি ১৯৭১ সালের মে মাসের ৫/৬ তারিখে আখাউড়া বর্ডার পার হয়ে আগরতলায় পৌঁছাই। একসময় এক উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে দেশের দিকে ফিরে তাকালাম। তখন আমার অনুভূতি হয়েছিল আবার দেশে ফিরতে পারব কি না, মা বাবা, ছোট ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনকে দেখতে পাব কি না, শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, নীলক্ষেতের রাস্তায় হাঁটতে পারব কি না, তার কিছুই জানি না। সবকিছু অনিশ্চিত। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় যারা নিজেদের পৈতৃক ভিটা ফেলে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাদের দেশ হারানোর বেদনা উপলব্ধি হচ্ছিল।
ক্যানভাস: পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে কী সম্ভাবনা দেখতে পান? আপনার প্রত্যাশাই-বা কী?
রোকেয়া কবীর: আমাদের প্রজন্ম দেশকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করেছে। পরবর্তী প্রজন্ম সামরিক শাসককে উৎখাত করেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের লক্ষ্যে পরবর্তী প্রজন্ম অগ্রসর হবে বলে আশা রাখি এবং যে বৈষম্যগুলো আমরা রুখে দিতে পারিনি, তারা সেটা করবে। সমাজের আনাচে-কানাচে যে অন্ধকার লুকিয়ে আছে, সেখানে আলোকবর্তিকা পৌঁছানোর দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের হাতে।

ছবি: মোঃ রাকিবুল হাসান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top