কভারস্টোরি I নারীর রাজনীতি
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীও এগিয়ে চলেছে। এই পরিবর্তন তার নিজস্ব অর্জন এবং তা এক দিনে ঘটেনি। তবে, পিতৃতন্ত্রের চাপ আজও তাকে মোকাবিলা করতে হয়। সেই রাজনীতি চলে আসছে ইতিহাসের শুরু থেকেই। লিখেছেন তাহমিনা আখতার
মার্কস, অ্যাঙ্গেলসের বন্ধু ও সহকর্মী জার্মান পন্ডিত অগাস্ট বেবেল ‘উওম্যান ইন দ্য পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার’ গ্রন্থের শুরুতে বলেছেন, ‘মানবজাতির মধ্যে নারীই সর্বপ্রথম দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছে। নারীর দাসত্ব শুরু হয়েছে ইতিহাসে দাসপ্রথারও আগে।’
আদিম সমাজ থেকে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বর্তমান পর্যন্ত নারীর অবস্থান পাল্টালেও মূলগত বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। নারী বৈমানিক হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা পুরুষ যোদ্ধার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছে, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আদিম যুগ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত শুধু সাল-তারিখ পাল্টেছে, পুরুষের ভোগের পণ্য নারী- এই ধারণা বদলায়নি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পেলে নারীর এই ‘দুঃখ’ ঘুচবে না- সমাজতাত্ত্বিকদের এই রায় কার্যকর করেও প্রকৃত অর্থে অধিকাংশ নারী আজও ‘মুক্ত-মানুষ’ হতে পারেনি।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সমাজে নারীর যতটুকু অগ্রগতি, তা তাকে অর্জন করে নিতে হয়েছে নানা কৌশলে। সেটিই নারীর নিজস্ব রাজনীতি। তবে তা এক দিনে অর্জিত হয়নি, ইতিহাসের অনেক উত্থান-পতনের পরই সম্ভব হয়েছে। সেই গল্পও জানা দরকার।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী পিতৃতন্ত্রের বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়ে বা হতে হয়েছে। সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নারীর স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সামাজিক মুক্তি, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ও এই প্রশ্নটি অগ্রাধিকার পেয়েছিল। এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তিকে নিজের পথ নিজেকে সৃষ্টি করে নিতে হবে- এই ভাবনা নারীর মধ্যে জেগে উঠতে থাকে। নারীর জীবনে যে নানা রকম বৈষম্য রয়েছে, এ বিষয়ে নারী সচেতন হতে শুরু করে এবং সেসব বৈষম্য মেনে না নেবার মধ্য দিয়ে ক্রমেই জাগরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু সেই জাগরণ এবং ক্রমশ তা নারী আন্দোলনের একটি বৃহত্তর পরিসর তৈরি করলেও নারী তার কাক্সিক্ষত অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। যদিও নারীর স্বাধীন সত্তা বিকাশের পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু তাদের সত্যিকার মানবাধিকার অর্জন এবং সমতাপূর্ণ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি এখনো।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে নারী-পুরুষ সবাই সমান ছিল। নারীর সম্মান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। এমনকি দীর্ঘকাল ‘মাতৃপ্রধান’ সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তখন নারীর যে স্বীকৃত ভূমিকা ছিল, পরবর্তীকালে কৃষিজীবী সমাজে, বিশেষ করে বিবাহ, সম্পত্তি ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সে ভূমিকা পাল্টে যায়। শ্রমবিভাজন, উৎপাদন ও বণ্টনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীকে করে তোলা হয় পরাধীন, দাস ও বৈষম্যের শিকার।
২
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজকের মানুষের যে বিকাশ, তার মূলে বেঁচে থাকার সংগ্রামই প্রধান। এই সংগ্রাম পরিচালনার কাজে মানুষই অগ্রগামী। কেননা মানুষের আছে কোনো ঘটনা স্মরণ রাখার শক্তি, স্মৃতিকে নতুন করে প্রয়োগ করার মানসিক গঠন এবং সে অনুযায়ী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও হাতিয়ার তৈরির ক্ষমতা। মানবজীবনের আদিতে শ্রমের একমাত্র হাতিয়ার ছিল হাত। বস্তুতপক্ষে শ্রমই হাতের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং নিত্যনতুন ব্যবহারে তা সুগঠিত হয়েছে। বংশপরম্পরায় তা বিস্তৃত হয়েছে এবং নানা রকম ব্যবহার আয়ত্ত করেছে। এভাবে সুগঠিত হাতের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং তার অগ্রগমন শুরু হয়। মনুষ্যত্বের জীব থেকে মানুষে উত্তরণের পর্যায়ে বেঁচে থাকার তাগিদেই মানুষ ছোট ছোট দলভুক্ত হয়ে বসবাস করত। প্রথমে ফলমূল সংগ্রহ, পরে শিকারি জীবন শুরু হয় মানুষের। মানুষ তখন শ্রম দিত মূলত অধিকতর বস্তু অর্জন এবং তা থেকে উপযোগ পাবার জন্য। এই সংগ্রহশীল জীবনব্যবস্থায় নারী-পুরুষ সবাই সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকত। শিকারি জীবনের শুরুর দিকেও একই রকম ছিল মানুষের জীবনযাত্রা। কিন্তু যখন শিকারের প্রয়োজনে দূর-দূরান্তে যেতে হলো এবং সন্তান ধারণের কারণে নারীরা সমানভাবে শ্রম দিতে পারল না, বরং জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হলো, তখনই ঘর-বাহির বিষয়টি মানুষের সামনে আসে। অর্থাৎ পুরুষ বড় বড় শিকারের জন্য দূর-দূরান্তে ঘুরবে আর নারী অস্থায়ী আবাসস্থলের নিকটস্থ ক্ষেত থেকে ফলমূল, শাকসবজি ও ছোট জীবজন্তু সংগ্রহ করবে। এই শ্রম বিভাজনকেই মানবসভ্যতার প্রথম শ্রম বিভাগ বলে অ্যাঙ্গেলস ‘অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’ [পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি] গ্রন্থে অভিহিত করেছেন।
শ্রম বিভাজনের একপর্যায়ে পুরুষ যখন বাইরে, দূর-দূরান্তে শিকারে ব্যস্ত ছিল, নারী তখন খাদ্য সংগ্রহ করা থেকে সহজেই বাগান করা ও কৃষিকাজের সূচনা করে। ‘শিশুরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজ নিজ ভাগের কাজের জন্য লেগে যেত- বালিকা-কিশোরীরা নারীদের কাজের জন্য তৈরি হতো এবং বালক-কিশোরেরা পুরুষদের কাজের জন্য।’ [ইভলিন রিড] নারীরা কৃষিকাজের জন্য যে খনন দন্ড বা খুরপি তৈরি করে, তাকেই মানুষের আদিম হাতিয়ার বলে চিহ্নিত করা হয়। ভারতবর্ষের গ্রামীণ নারীদের দিকে লক্ষ করলে আজও দেখা যায়, খুরপি তাদের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ক্রমে নারীরাই কৃষিবিজ্ঞান আত্মস্থ করে। পাশাপাশি তারা পশুপালন পদ্ধতিও উদ্ভাবন করে। নারীর এই উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক উপকরণ, মৃৎপাত্র, গুহার দেয়ালচিত্রে এবং প্রাগৈতিহাসিক কালের যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে, সেসব নিদর্শনে কর্মরত নারীই দৃশ্যমান। এসব উপকরণ প্রমাণ করে যে, নারীরও রয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার নিজস্ব রাজনীতি।
নারীর শ্রমই মানবসমাজকে আদিম অরণ্যচারী জীবনের পর্যায় থেকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে। আবার প্রাগৈতিহাসিক যুগে, আজ থেকে ৮-১০ হাজার বছর পূর্বে মানবজাতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আগুন। নারীরাই প্রথম আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। অস্থায়ী বাসস্থানে পুরুষ অপেক্ষা নিশ্চিন্ত ও নিশ্চয়তায় থাকার দরুন নারী আগুন-সম্পর্কিত বিষয়াবলি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিল। তারা সেই পরিমাণ অবসরও পেত। এ কারণে তারা আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি ও ব্যবহার আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। পুরুষেরা শিকার ও অন্যান্য শ্রমে অনিশ্চয়তার মধ্যে যাপন করত বলে পর্যবেক্ষণের কোনো সময় তাদের ছিল না বললেই চলে। আগুন আবিষ্কারের ফলে পোড়ানো, সেদ্ধ করা, সেঁকা ইত্যাদি আয়ত্ত করা সম্ভব হলো। নারী যেহেতু গৃহস্থালির এসব কাজের দায়িত্বে ছিল, সে কারণে রান্নার পাশাপাশি খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতিরও উদ্ভাবন করল তারা। ফলে বাসনপত্রও নির্মাণ শুরু হয় নারীদের মাধ্যমে। এভাবে তাদেরই হাতে শুরু হয় শিল্পের যাত্রা। দড়ি তৈরি মানব ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গৃহস্থালিতে পরিত্যক্ত চামড়া থেকে দড়ি প্রস্তুত হয়েছিল নারীর হাতে। ফলে দড়ি থেকে চামড়া পাকা করা, বুনন, ঝুড়ি তৈরি, বস্ত্র বয়ন ইত্যাদিরও সূচনা হয়। পশুপালন শুরু হয় এ সময় থেকে। বলা যায়, পশুপালন পর্যায় থেকে মানবসভ্যতার নতুন পর্বের সূচনা।
ইতিহাসের এই পর্বে, শিকারি পুরুষ যখন দেখল শিকার করার চেয়ে কৃষি অধিক ফলপ্রসূ, শিকারের চেয়ে কম কষ্টকর, তখন তারা কৌশলগুলো নারীর কাছ থেকে শিখতে শুরু করে। এরই ফলে যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে এবং অপেক্ষাকৃত উর্বর অঞ্চলে মানুষের স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু হয়। কাজের সুবিধার জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেওয়া হতো। দলে নারীর প্রাধান্য ছিল, তার কারণ সামাজিক উৎপাদনের ওপর নারীরই কর্তৃত্ব ছিল। কিন্তু কৃষিকাজে প্রবেশের পর পুরুষ সরাসরি কৃষিশ্রম থেকে নারীকে বিচ্যুত করে এবং তাদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তখন পশুপালনের যুগ। এভাবেই ক্রমশ মানুষের চিন্তার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। আর ভাষা ছাড়া যেহেতু চিন্তা করা কঠিন, সেহেতু এ পর্যায়ে ভাষাও ধীরে ধীরে একটা গঠনশীল পরিপূর্ণতা পেতে থাকে। ভাষা কাঠামো তৈরি হলে মানুষের মস্তিষ্কও দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। ফলে জীবনের প্রয়োজনে মানুষ যে ছোট ছোট দল গড়েছিল, সেই দলগুলো ক্রমশ সমাজ সৃষ্টি করে। এভাবেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য স্থাপিত হয়। তখন উৎপাদনের প্রধান যন্ত্র ছিল বর্শা, দড়ির ফাঁস, তীর-ধনুক ইত্যাদি এবং এই যন্ত্রগুলো ব্যবহারে প্রধান ভূমিকা রাখত পুরুষ।
এই সময় নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক ছিল অবাধ। পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের ব্যাপারটি তখন খুব গুরুত্ব বহন করত না। শিশুরা ছিল পরিবারের সম্পদ। আর পরিবার ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। গোষ্ঠীর বয়স্করা সবাই নিজেদের বাবা-মা ভাবত। কোনো শিশুই অবহেলার শিকার হতো না। ব্যবস্থাটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ বংশ নির্ধারিত হতো মায়ের পরিচয়ে। আবার যেহেতু উৎপাদনে কার কেমন ভূমিকা, তা থেকে সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হতো, সেহেতু নারীর অবস্থানও ছিল উঁচুতে বা কেন্দ্রে। কিন্তু তাই বলে পুরুষ নারীর অধীন ছিল না। আবার কোনো প্রকার যৌন দমননীতিও ছিল না। প্রত্যেকে স্বাধীন ছিল। তবে উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বিশেষত্বের দরুন নারী ছিল সমাজজীবনের কেন্দ্রে। সামাজিক শ্রমবিভাগের মধ্য দিয়ে ক্রমশ প্রভেদ সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে প্রভু এবং দাস, শোষক-শোষিত শ্রেণিবিভাজনের সূচনা হয় এ সময়। পশুপালনের যুগে পশুদের মালিকানা গোষ্ঠীর হাত থেকে ব্যক্তির হাতে চলে যায়। পশু, শিকারের যন্ত্রপাতি এবং অনুরূপ সম্পত্তির ওপর ক্রমশ ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এভাবে সমাজের যা কিছু ধনসম্পদ ও প্রয়োজনীয় বস্তুর উৎপাদন, সেগুলো পুরুষের অধিকারে আসে। নারী তার অংশ পেত, কিন্তু সেগুলোর ওপর তার কোনো অধিকার আর রইল না। ক্রমশ পুরুষকেন্দ্রিক পরিবার গড়ে উঠতে থাকে। পুরুষ হয়ে ওঠে সমাজ জীবনের কেন্দ্র। এই স্তরে বন, মাঠ, জলরাশি ইত্যাদি ছিল সবার সম্পত্তি আর চাষের জমি ভাগাভাগি হতো পরিবারের আকার অনুযায়ী পিতা বা পরিবারের প্রধান পুরুষ কর্তাদের মধ্যে। ফলে উৎপাদনের হাতিয়ারের পাশাপাশি সম্পত্তিও পুরুষের কর্তৃত্বে আসে। গৃহশ্রমে আবদ্ধ হয়ে নারীর মানসিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথও বন্ধ হলো। সমাজে নারীর গুরুত্ব কমে এলো এবং মাতৃবিধির স্থলে পিতৃবিধি চালু হলো।
কৃষি উৎপাদনের ফলে উদ্বৃত্ত তৈরি হতে থাকল, যা গোষ্ঠীকর্তাদের হস্তগত হতো। ফলে ব্যক্তিমালিকানা ও বৈষম্য বাড়তে লাগল। যাদের হাতে উদ্বৃত্ত জমল তারা তাদের গচ্ছিত সম্পদ সুবিধাজনক নানা উৎপাদনে খাটাতে শুরু করল। এর ফলে সমাজে ধীরে ধীরে শ্রমবিভাগও প্রকট আকার ধারণ করল। মালিকানা উদ্ভবের এই পর্যায়ে পিতৃবিধি রক্ষা এবং প্রকৃত উত্তরাধিকারের জন্য সতী ও সতীত্ব শব্দ দুটির সূত্রপাত হয়। পাশাপাশি কোনো নারীর বিশেষ গুণে আকৃষ্ট হয়ে তাকে পাবার প্রবল ইচ্ছার বিষয়টি তো ছিলই। সুতরাং একনিষ্ঠ বিবাহের বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছিল এবং তার প্রচলনও শুরু হলো। এ ক্ষেত্রে পুরুষটিই ওই নারীর দায়িত্ব নিত, আদর-যত্নে রাখত, সেই সঙ্গে শিশুদের আপন সন্তান রূপে প্রতিপালন করত। এ রকম সম্পর্ক অধিকতর সুবিধাজনক ও নিরাপদ হওয়ায় নারী গৃহশ্রমের পাশাপাশি এমন সম্পর্কেও অভ্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু সতী, সতীত্ব- এসবের পুরুষবাচক শব্দ তৈরি হলো না। কারণ, পুরুষের একনিষ্ঠতা কাম্য ছিল না। ফলে পতিতাবৃত্তির পথও প্রশস্ত হলো।
উদ্বৃত্ত সম্পদের ফলে সমাজে প্রভাবশালী বর্গ তৈরি হয়। তাদের মধ্য থেকেই গণ বা গোষ্ঠীগুলোর গণপতি তৈরি হতো। পাশাপাশি শ্রমবিভাগ বাড়তে থাকায় অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। গোষ্ঠীর ভেতরে ও বাইরে বৈষম্যের ফলে বিবাদ বাড়তে থাকে। ফলে প্রভাবশালীবর্গ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপর হয়- গড়ে উঠতে থাকে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। এ পর্যায়েই প্রভাবশালীদের স্বার্থে বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্র হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে এবং এই ধারাতেই নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, যাকে সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
দেখা যাচ্ছে, সচেতনভাবে না হলেও সভ্যতা নির্মাণের প্রথম পর্বে নারীর নিজস্ব কৌশলগত বলয় তৈরির প্রমাণ রয়েছে।
৩
ফরাসি বিপ্লবের সময় মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। তখন একদল নারী দাবি করেন- মানবাধিকারের মধ্যে নারীর বিষয়টি পৃথকভাবে উল্লেখ করতে হবে। এভাবে নারী নিজস্ব রাজনীতির ভাবনা সামনে আনে।
যদিও বর্তমানে নারী ঘরের বাইরে এসেছে, অফিস-আদালতে কাজ করছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে, কিন্তু তা আসলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও পিতৃতন্ত্রের স্বার্থে। যে কারণে নারীও অনেক সময় পিতৃতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতি নারীকে কেবল পণ্য হিসেবেই দেখে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা নারীদের জন্য ‘বিশেষ পাতা’ প্রকাশ করে। এসব পাতায় প্রকাশিত ‘মা দিবসে’র দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানে প্রকাশিত প্রতিবেদন বা বক্তব্যে ‘মেয়েরা মায়ের জাত’। নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো ‘মা’, পেশাগত পরিচয়টাতে কিছুই আসে যায় না। পেশাগত পরিচয় যে পুরুষের জন্য বরাদ্দ, সে কথা বলে দিতে হয় না, হয়নি…শাশ্বত ও চিরন্তন হিসেবে মাতৃত্বকে মেয়েদের একমাত্র/প্রধানতম পরিচয় হিসেবে তুলে ধরাই…মা দিবসের লক্ষ্য…। কিন্তু খোদ যে-নারীর জন্য মা-দিবস প্রচলিত হয়েছে ১৯১২ সালে, সেই অ্যানা জারভিস কী বলেন মা-দিবস উপলক্ষে ‘পণ্যের প্রচার, বিজ্ঞাপন বা মার্কেটিং সম্পর্কে?
জারভিস একনিষ্ঠ খ্রিস্টান ছিলেন। তিনি নিজে কিন্তু ‘মা’ ছিলেন না, কুমারী ছিলেন, অবিবাহিত ছিলেন, নিজে কখনো সন্তান ধারণ করেননি। তিনি তাঁর মায়ের স্মৃতিতে একান্ত ব্যক্তিগতভাবে নানান আচার পালন করতেন অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে। মায়ের মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে জারভিসের এই নিষ্ঠাই একসময় মা-দিবসের জন্ম দেয়। সনাতন মাতৃত্বের গুণগান করার জন্য মা দিবস জারি হয়নি। তিনি সব সময় একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিঠি লেখা, মায়ের সঙ্গে দেখা করা প্রভৃতির মাধ্যমে মা-দিবস পালন করার কথা বলতেন।…জারভিসের জন্য মা দিবস ছিল একটি ‘হোলি ডে’ বা পবিত্র দিবস, বাণিজ্যিক ভোগবাদ সেইটাকে পরিণত করে একটা ‘হলি ডে’ বা ছুটির দিনে। কোম্পানিগুলো মা দিবস [আজকের নিউজিল্যান্ড মিল্কের মতোই] উপলক্ষে নানান স্যুভেনির, পোস্টকার্ড, বুকমার্ক বা পুস্তকের কতটা পড়া হলো, সেই চিহ্ন রাখার ‘তিনকা’, বুলেটিন [আজকের ‘নারীমঞ্চে’র মতোই], সেলুলয়েড-বোতাম প্রভৃতি বিতরণ করত- বিশেষত বিদ্যালয়ে।…জারভিস এই ‘বাণিজ্য দস্যু’, ‘লোভী ব্যবসায়ী’দের বিরুদ্ধে চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন। লাগাতারভাবে তিনি পুষ্প ব্যবসায়ী, কার্ড-বিক্রেতা-কোম্পানি ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই বহাল রেখেছিলেন।’ জারভিসের এই লড়াইয়ের পথে এসে জড় হয়েছেন অনেকেই। নিজেদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বাইরে স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে গড়ে তোলার সচেতন প্রয়াসে কথা বলছেন নারীরা। এসবও আসলে নারীর রাজনৈতিক পরিচয়েরই বার্তা।
নারীর গৃহশ্রমকে মূল্য দেওয়া হয় না। ‘নারীর শ্রম এবং লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজনকে মার্কস ব্যাখ্যা করেছেন ‘উৎপাদন’ ও ‘পুনরুৎপাদন’ক্ষম শ্রমের পার্থক্য বিচারে। অর্থনীতির পরিভাষায় ‘বাজারমুখী উৎপাদন, অথবা ‘মজুরি-শ্রম’ ধারণাগুলোর ব্যুৎপত্তি সমাজবদলের ধারাবাহিকতায় তত্ত্বীয় চিন্তার কাঠামোয় যুক্ত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা দেখেছেন এভাবে- ‘ঘরের শ্রম’, ‘ঘরের বাইরের শ্রম’। নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতি বরাবরই জোর দিয়েছে ‘বাইরের চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদন’-এর ওপর। গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়া থেকেই তত্ত্বের বাইরে ব্যবহারিক হিসেবে নারীর শ্রমকে ‘অদৃশ্য’ ধরে নিয়েই তাকে সংখ্যায় প্রকাশ করা শুরু হয়ে যায়।…পৃথিবীর অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশের জাতীয় আয় পরিমাপেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেখানেও পারিবারিক অবৈতনিক কর্মে নিয়োজিতদের অবদান এখনো অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়নি। অর্থাৎ অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখনো পুরোপুরি স্বীকৃতি পায়নি। কারণ, দাসের উৎপাদিত মূল্য তো মালিকেরই প্রাপ্য! দাসের তাতে অধিকার নেই। এই প্রাচীন চিন্তার দাসত্বের কারণে এখনো নারীকে পুরুষতন্ত্রের ‘দাস’ই মনে করা হয়।’
নারীকে পুরুষের চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন বলে অবহেলা বা হেয় করা হয়। কিন্তু মানবসমাজের ইতিহাস আলোচনায় দেখা যায়, আদিতে নারী ও পুরুষের শারীরিক এবং মানসিক শক্তিতে তেমন কোনো তফাত ছিল না। হাজার বছর ধরে পুরুষ বাইরের যেসব কাজে লিপ্ত ছিল, সে অনুযায়ী তার পেশি বিকশিত হয়েছে। নারীর পেশি স্বাভাবিকভাবেই তাদের মতো করে বিকশিত হয়নি। নারীকে যে পরিবেশে থাকতে হয়েছে, সে অনুযায়ী তার পেশি গঠিত হয়েছে। তা ছাড়া গর্ভে সন্তান ধারণ যে বড় রকমের শারীরিক সামর্থ্য, সেটাও অস্বীকার করা হয়।
অন্যদিকে, যৌনতা সামাজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রভাবিত করে। যৌনতা বিষয়টি আমাদের সমাজে প্রচন্ড গোপনীয় ও লজ্জার। বর্তমান বাজারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বিবাহ-পূর্ব প্রজননহীন যৌনতাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবে। এই ব্যবস্থাও এমনটি চায় তার ব্যবসায়িক স্বার্থে।
৪
প্রশ্ন উঠতে পারে, পুরুষই কি নারীর স্বাধীন সত্তা বিকাশের পথে প্রধান শত্রু? বিষয়টি একটু স্পষ্ট করা প্রয়োজন। পুরুষ নিশ্চয়ই পরিকল্পিতভাবে নারীকে বন্দি করেনি। কিন্তু নারী বন্দি হয়েছে। ইতিহাস বিকাশের একটা পর্যায়ে এসে যখন নারী সরাসরি উৎপাদন থেকে বিচ্যুত হলো, তখনই মূল সমস্যা শুরু হয়। কারণ, পৃথিবীতে মানুষকে অস্তিত্বের প্রয়োজনে পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা অর্জন করতে হয়েছে। এই পর্যায়ে নারীর শ্রম সমাজের দৃষ্টিতে কোনো মূল্য তৈরি করত না। ফলে তারা বোঝায় পরিণত হলো। কিন্তু নারীকে বাদ দিয়ে সমাজ হতে পারে না। তাই পুরুষের গলগ্রহ হয়ে তাদেরকে থাকতে হলো। এরপর বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে সমাজ জটিল থেকে জটিলতর অবস্থায় বিকশিত হতে থাকে এবং নারীও নানা জটিলতায় পতিত হয়। ফলে আলোচনায় যেসব বিষয় এসেছে তা দৃশ্যত নারীর শত্রু বা সেসব চলকগুলোই তাদেরকে বন্দি করে রেখেছে। তবে এগুলোই সুসমন্বিত, সুবিন্যস্ত এবং বৈজ্ঞানিক হলে নারীর স্বাধীন সত্তা বিকাশের পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
এত বাধাবিপত্তির পরও নারী তার নিজস্ব কৌশলেই সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। পুরুষ কখনো কখনো তার সহযোগী হয়েছে। কিন্তু সমাজে নারীর অবস্থানগত নিশ্চিয়তার জন্য সমস্ত বাধা দূর করতে প্রতিনিয়ত নিজেকে যোগ্য করে তোলার যে প্রয়াস, সেটিই মূলত নারীর রাজনৈতিক সত্তা। আগুন আবিষ্কার, দড়ি তৈরি, বীজ বোনা, গৃহশ্রম থেকে শুরু করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ, সাংগঠনিক দক্ষতা, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি, পাহাড়চূড়ায় ওঠা, করপোরেট পৃথিবীতে তার সক্রিয় উপস্থিতি, রাজনৈতিক কর্মকান্ড, রাষ্ট্র পরিচালনা- সবখানেই আজ নারী সমান পারদর্শী। নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েই নারী পুরুষের পাশাপাশি স্বতন্ত্র এবং দৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি করেছে। এ তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও কৌশলগত রাজনীতি।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
আগস্ট বেবেল, নারী অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতে, অনুবাদক : কনক
মুখোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, এপ্রিল ১৯৯০
ইভলিন রিড, নারী মুক্তির প্রশ্নে, অনুবাদ : ঊর্মি রহমান, কলকাতা
অ্যাঙ্গেলস, পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রগতি
প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৭
রোমিলা থাপার, ভারতবর্ষের ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৯৩
লুইস হেনরি মর্গান, আদিম সমাজ, অনুবাদ : বুলবন ওসমান, বাংলা
একাডেমি, ঢাকা, জুন ১৯৭৫
‘চন্দ্রাবতী’, সম্পাদক : সুস্মিতা চক্রবর্তী, প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৬
কভার : হুমায়রা খান, জারা জাবীন মাহবুব ও সিগমা মেহেদী
মেকওভার : পারসোনা
ওয়্যারড্রোব : আনোখি
ছবি : জিয়া উদ্দীন
লোকেশন কার্টেসি : সিগমা মেহেদী’স রেসিডেন্স