ছুটিরঘণ্টা I বালি রাজার দেশে
নীল জলরাশিঘেরা ভূখন্ডে পাহাড়, মেঘ আর প্রার্থনাগৃহের হাতছানি। জীবন সেখানে সাম্যের ঐশ্বর্যে ভরা। লিখেছেন শুক্লা পঞ্চমী
[পূর্ব প্রকাশের পর] ভাসমান মন্দির দেখতে গেলাম। বালির বিখ্যাত এই দুটি স্থাপনার একটি পাহাড়ের ওপর অন্যটি সমুদ্রে। গতকালের মতো বৃষ্টিভেজা সকাল নেই। নীল আকাশে ভাসছে সাদা মেঘের ভেলা। আবারও সেই ভাড়া গাড়ি সারা দিনের জন্য। যথারীতি সকালে ভরপেট খেয়ে চললাম মন্দির দর্শনে। গাড়ি ছুটছে। চারপাশে দেখতে পাচ্ছি বাঁশ-বেতের কারুকাজখচিত বড় বড় শিল্পকর্ম। আধভাঙা ইংরেজিতে ড্রাইভার জানাল তাদের উৎসবের কথা। এই শিল্পকর্মের নাম ‘পেন্জর’। এটা পর্বতের রূপক। বালিনিজরা অত্যন্ত ধর্মপ্রিয়। তাদের সাদাসিধে জীবনে প্রাত্যহিক ধর্মীয় কাজ গুরুত্বপূর্ণ। সুখ-সমৃদ্ধি আর প্রবৃদ্ধির জন্য সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে গালুঙ্গান পূজা করে। পেন্জর বানানো এবং বাড়ির সামনে প্রতিস্থাপন তারই অংশবিশেষ। গালুঙ্গান বালিনিজদের ধর্মীয় দিবস, অধর্মের ওপর ধর্মের বিজয় উদযাপনের দিন। এ উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী এই বিশালাকার হস্তশিল্প তৈরি করা হয়। এর চূড়ার বেঁকে যাওয়া নারকেল পাতার সঙ্গে সংযুক্ত একটি পাত্রে শস্য, ধান, নারকেল, শসা এবং এগারোটি মুদ্রা সৃষ্টিকর্তার ভেট হিসেবে নিবেদন করে।ধর্মের প্রতি বালিনিজদের নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত উপভোগ করার মতো। আমরা এগোচ্ছি ওপরের দিকে। যত ওপরে উঠছি, তত শীত বাড়ছে। গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলাম তিনজনে।
১২০০ মিটার উঁচুতে বালিনিজদের পবিত্র পাহাড়। ওপরে সমতল ভূমি। আশ্চর্য হবার মতো শান্ত ব্রাতান হ্রদ। এই জলাধারে ভাসমান দেবী দানুর মন্দির ‘উলুন দানু টেম্পল’। হ্রদটি বালির সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধির উৎস। নিম্নাঞ্চলের কৃষিকাজের জন্যও পানির এই উৎসস্থল অপরিহার্য।
গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে যেতেই দেখা গেল স্নিগ্ধ, শান্ত হ্রদের টলটলে নীলাভ জল। সঙ্গে গাঢ় সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে আছে সাদা সাদা মেঘ। তার ওপর মন্দিরের প্রতিবিম্ব দেখে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল।
স্থানীয় লোকজন বলল, সবার ভাগ্যে নাকি এই লেক দেখার সুযোগ হয় না। মেঘে ঢেকে ফেলে। এমন শক্ত হয়ে চেপে থাকে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও তার মুখদর্শন মেলে না। আমরাও বেশিক্ষণ দেখতে পাইনি। মেঘে ঢেকে গেছে লেক। চলে গেলাম অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে চলছে নানা আয়োজন। আমরাও যুক্ত হলাম সবার সঙ্গে।
দ্বিতীয়বার আর লেকের দেখা পেলাম না। মেঘরানি মুখ ঢেকে ফেলেছেন, সহজে দেখা দেবেন না। যতটুকু পরশ পেয়েছি তাতে তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলাম সমুদ্রের দিকে।
ড্রাইভার বলল, আরেকটা ছোট মাংকি ফরেস্ট আছে, চাইলে দেখে যেতে পারি। আমাদের সময় ছিল। পাহাড় থেকে নেমে গেলাম বানরের রাজত্বে। ড্রাইভার বলল, চশমা যেন হাতে রাখি; কারণ, বানর চশমা নিয়ে উঠে যায় গাছে। জান্নাত আপা বানর ভয় পান। গাড়ি থেকে নামেননি। আমি আর রাখী ঢুকে গেলাম বানরের সা¤্রাজ্যে। চশমা ছাড়া দেখি না। অনুমান করেই হাঁটছিলাম। দেখলাম উনারা সব চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছেন। দেখভালকারী লোকজন জানাল, নাট খাওয়ালে কিছু করবে না। আমরা কিছু নাট কিনে নিলাম। হাত থেকে তুলে নিচ্ছে। কেউ কেউ ঘাড়েও চেপে বসল, কিন্তু উল্টাপাল্টা কিছু করল না। আমরা বালির ট্র্যাডিশনাল পোশাকে সেজে ছবি তুললাম।
তানালট মন্দির
আমাদের যাত্রা সমুদ্রের দিকে। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেক আশ্চর্য। ব্রাতান হ্রদ তখনো চোখে লেগে আছে কাচের মতো। দুপুর পেরিয়ে সূর্য কিছুটা হেলান দিয়েছে। আমরা টিকিট কেটে ভেতরে গেলাম। মন্দির পথে বিশাল উঁচু গেট। লোহা দিয়ে তৈরি অথচ নিখুঁত কারুকাজ। দেখতে পাচ্ছিলাম বিশাল বড় কালো পাথরের প্রাচীন মন্দির। পাথরের বিশাল আকৃতির প্রস্তরখন্ডকে মন্দিরে রূপ দেওয়া হয়েছে। চারদিকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে কালো পাথরের ওপর। বালির কল্যাণসাধনের জন্য হিন্দু-মুসলিম সবাই এই মন্দিরে যায়। এখানে সমুদ্রের লোনা জল ঝর্নার মাধ্যমে মিষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। এই জল মুখে নিয়ে প্রার্থনা করলে যা চাওয়া হবে, তাই নাকি পাওয়া যায়। বিচ থেকে অল্প দূরত্বেই। কিন্তু বিশাল আকৃতির ঢেউয়ের জন্য যাওয়া মুশকিল। এদিকে জোয়ারের সময় হয়ে এসেছে, এখন দেখতে না গেলে আর সম্ভব হবে না। গাইডের সাহায্য নিয়ে অনেকেই যাচ্ছে। দুই সহযাত্রী আমাকে রেখেই হাত ধরল গাইডের। এরই মধ্যে জোয়ারের উত্তালতা শুরু হয়ে গেছে। পানি খুব বেশি নয়, কিন্তু আমার সহযাত্রীরা ভিজে একসা। মাথার উপর দিয়ে ঢেউ নামছে। হঠাৎ মন ঘুরিয়ে ফেললাম- যা হয় হবে দেখে আসব। হাত ধরলাম গাইডের। জোয়ারের বেগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। গাইড বলল কোনোভাবেই যেন তার হাত না ছাড়ি। শোঁ শোঁ শব্দ। কান রাখা দায়।
তানালট টেম্পল
ঢেউয়ের মাপ বুঝে গাইড নিয়ে গেল। আমিও ভিজে একসা। মন্দিরের নিয়ম সবার জন্য এক। যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র জল দিয়ে মুখ ধুতে হবে। তারপর কপালে চন্দনের ফোঁটা আর কানে কাঁঠালচাঁপা ফুল গুঁজে দিতে হয়। মন্দিরের নিয়ম পালন করে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি বিশাল সাগর উন্মাদের মতো তান্ডব করছে। ভয়ে তাকানো যায় না। গলা শুকিয়ে আসে। নিচ থেকে গাইড তাগাদা দিচ্ছিল, আর থাকা যাবে না। আমরা তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। আসার সময় বুঝতে পারছিলাম, জোয়ারের জোর কত। গাইড না থাকলে ভেসে যেতাম।
তানালটের সৌন্দর্য একদিনে উপভোগ করার নয়। এক সপ্তাহ হলে কিছুটা মন ভরবে। চারদিকে এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, মনে হয় বসে থাকি। বালি এতটা শান্ত আর নিরাপদ জায়গা যে না এলে বোঝা যেত না। মানুষের বাড়িঘর দেখে অনুমান করা যায় না কে গরিব, কে ধনী। আলাদা কোনো বড়লোকি কারও নেই। সমুদ্রের ধারে রীতিমতো বিকিনি পরে ফরেনাররা হাঁটছে। আমাদের তখনো অনেক কিছু দেখার বাকি।
তৃতীয় দিন ভ্রমণে কিছুটা ক্লান্ত হয়েছি, কিন্তু কোনো রকম ছাড় দিতে রাজি নই। ভালো কিছু খাব। যারা আগে বালি ভ্রমণ করেছে, তাদের কাছে জেনেছি জিম্বারানা বিচে সি ফুডের কথা। যদিও দাম একটু বেশি। তবু ভ্রমণের এটাও একটা অংশ। গাড়ি নিয়ে প্রথমেই গেলাম ড্রিমল্যান্ড বিচে। দুটো সিট ভাড়া নিয়ে একত্র করে শুয়ে থাকলাম একজনের গায়ের উপর আরেকজন। পাশে বিশাল উঁচু রকের পাহাড়। ধেয়ে আসছে উত্তাল ঢেউ, আমরা তাকিয়ে আছি আছড়ে পড়া দেখতে। আমি উঠে গেলাম পাহাড়ের দিকে। দেখি ভেতর থেকে লোক বেরিয়ে আসছে। একজন ফিলিপিনের সঙ্গে কথা হলো, বলল এখানে গুহা আছে। উৎসুক হয়ে দেখতে গেলাম। ভেতর থেকে বেরোচ্ছে মানুষ। বেশ গভীর আর সরু। সারা দিন কাটিয়ে বিকেলের দিকে রওনা দিলাম জিম্বারানা বিচের দিকে। সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে। ঠিক সমুদ্রের পাড়ে বিশাল জায়গাজুড়ে ক্যান্ডেল লাইট জ্বালানো হয়েছে। যে যার ইচ্ছেমতো টেবিল নিয়ে বসে যাচ্ছে। আমরাও তীরঘেঁষে টেবিল নিয়ে বসলাম। এগুলো সবই ভিন্ন ভিন্ন ফুডশপের। অ্যাকুরিয়ামের মাছ পছন্দ করে ফ্রাই করতে বললাম। সঙ্গে লবস্টার আর স্থানীয় ভেজিটেবল এবং রাইস। অসংখ্য কাপল এসেছে হানিমুনে। হাতে গিটার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল শিল্পী। তারা টেবিলে টেবিলে যাচ্ছে। যারা বলছে তাদের সামনে গিয়েই গান গাচ্ছে। সেই পুরোনো গান, যেগুলোর কথা শুরুতেই বলেছি।
চতুর্থ দিন ঠিক হলো- আইল্যান্ড যাব। কাছাকাছি নুসা পেনিদা, নুসা ল্যাম্বোগন- দুটোই সুন্দর। নুসা ল্যাম্বোগনে একটা ম্যানগ্রোভ আছে সমুদ্রের মধ্যে, সেটা দেখার মতো। তা ছাড়া আছে বিভিন্ন রাইড। পরদিন গেলাম ফেরিঘাটে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য রয়েছে সারি সারি বোট। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওরা বিভিন্ন দ্বীপে নিয়ে যায়। টিকিট কেটে চড়ে বসলাম বোটে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম নীল আর নীল। বিশাল বিশাল ঢেউ। বোট কখনো ঢুকে যাচ্ছে ঢেউয়ের ভেতর, কখনো আছড়ে পড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। কারুর মুখে কোনো কথা নেই। যাত্রীদের সবারই এক অবস্থা। অবশ্য কেউ কেউ হাসছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা সমুদ্রের দাপাদাপি সহ্য করে দ্বীপের চিহ্ন দেখতে পেলাম।
কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। রেখায় রেখায় ভেসে উঠল আনন্দের ঝলক। নুসা ল্যাম্বোগন দ্বীপে নেমে আরেকটা বাসে উঠলাম। এসব কিছুই আমাদের প্যাকেজের মধ্যে ছিল, তাই আলাদা করে খরচ হয়নি। সুনসান নীরব দ্বীপ। পাখপাখালির অবাধ কিচিরমিচির মনে করিয়ে দিচ্ছিল দেশের কথা। বাস থেকে নেমে আরেকটা বোটে চড়লাম। বোটের নিচটা মোটা কাচ দিয়ে মোড়ানো। আবার চললাম সমুদ্রের দিকে। কিন্তু এবার অন্য রকম লাগল। আগের মতো ভয় পাচ্ছিলাম না। চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো অসংখ্য দ্বীপ। অনেকটা আমাদের হাওর অঞ্চলের মতো। বোট চলছে। সমুদ্রের দিকে। গাইড বলল নিচে বোটের কাচে তাকাতে। দেখলাম সমুদ্রের তলদেশ দেখা যাচ্ছে। নানা রঙের প্রবাল। বিভিন্ন মাছ আর উঁচু-নিচু পাহাড়। যেতে যেতে সামনে তাকাতেই দেখি ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। নীলের উপর সবুজ। এখানে নাকি বিষধর সাপও আছে।
বোট ছোট একটি দ্বীপে থামল, ডাঙা থেকে বেশ দূরে। হেঁটে যেতে হবে প্রায় এক কিলোমিটার। কী মুশকিল! জুতা পায়ে হাঁটা যাবে না গাইড বলছে। উঁচু-নিচু জায়গা, পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার খালি পায়েও যাওয়া যাবে না, পা কেটে যাবে। পা দিয়ে বুঝলাম, এই প্রবালদ্বীপ ভীষণ পিচ্ছিল। এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। অনেক কষ্টে তীরে উঠলাম। বাংলাদেশের মতো কুঁড়েঘর। এখানে খাওয়া-দাওয়া হবে। হোটেলের অবস্থা ভালো না, বেশ নোংরা। করার কিছু নেই, নাকমুখ বন্ধ করে খেয়ে নিলাম।
সাগরে তখন ভাটা চলছে। আবারও হেঁটে গিয়ে বোটে চড়তে হবে। আমি তীরে কিছু প্রবাল কুড়ালাম। জীবন্ত কড়ি, শামুক, শঙ্খ কুড়িয়ে নিলাম। আমাদের ঘোরাঘুরি তখনো শেষ হয়নি। বোট আমাদের নিয়ে গেল রাইডে চড়াতে। বড় একটা জাহাজের মতো যানে উঠলাম। অনেকেই নেমে গেল সমুদ্রে। কেউ কেউ অক্সিজেন নিয়ে তলদেশে নামল। আমার সঙ্গী দুজন বানানা বোটে চড়বে। কেন জানি আমি রাজি হলাম না যেতে। দেখছি অনেকেই মজা করছে। আমাদের সঙ্গে চীনা দম্পতি ছিল। ছেলে, মেয়ে, স্বামী, শাশুড়িসহ কলাবোটে চড়ে এল। শেষবারের ট্রিপে রাখী আর জান্নাত আপা চড়ল। বললাম, ঘুরে আসো, আমি ছবি তুলি। আসলে শান্ত মনে হলেও ঢেউ প্রচন্ড। কে জানত ভয়ানক কিছু ঘটবে। বানানা বোট ছেড়ে মাত্র হাফ রাউন্ড দিয়েছে, অমনি বোট উল্টে গেল। জান্নাত আপা, রাখী- কেউ সাঁতার জানে না। আমি পাগলের মতো চিৎকার করছি- কখনো ইংরেজি কখনো বাংলায়। মাথায় আসছিল না কিছু। রাইড চালক তাদের টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। পারছে না। এদিকে বোট তখনো উল্টানো। পনেরো মিনিট পর তাদের তুলতে সক্ষম হলো। জীবন ফিরে এলো। এই ভয়ংকর ঘটনার পর আমরা স্তিমিত হয়ে গেলাম। আরও দুই জায়গায় গিয়েছি, কিন্তু মাথা থেকে সেই দৃশ্য যাচ্ছিল না। ফেরার পথে প্রচন্ড ঢেউ রাখীকে খুব ভীত করে তুলল।
রাতে আমরা আশপাশে ঘুরেছি, ছোটখাটো শপিং করেছি। একটা ছোট দুর্ঘটনা, তবু বালির অপার সৌন্দর্য আমাদের মন জুড়ে রয়েছে।
ছবি: লেখক