ফিচার I স্কিনিমালিজম
আয়োজন সীমিত, তবে উপকার অসীম। বিলাসবর্জিত। ফলে সাশ্রয়ী। ত্বক আর চুলের যত্নে কার্যকর। অনাড়ম্বর এ রূপচর্চার খুঁটিনাটি জানাচ্ছেন জাহেরা শিরীন
কয়েক বছরে রূপচর্চায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন বেশ পষ্ট। আট, দশ ধাপের বিলাসবহুল পরিচর্যার উত্থান ঘটেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নতুন সৌন্দর্যসামগ্রীর সংখ্যা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইটগুলোতে # শেলফলাইফ নামে আড়াই মিলিয়নের বেশি পোস্ট তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এগুলোতে দেখা গেছে, তাকভর্তি নানা রকম ত্বক আর চুলচর্চার উপকরণ। জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর নির্ধারণ করে দেওয়া মাস্ট হ্যাভ অথবা ইট প্রডাক্টগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিল সৌন্দর্যপ্রেমীদের স্ট্যাটাস সিম্বল। এসবই অতিমারির আগের কথা। পরিস্থিতি বদলে গেছে। সংক্রমণের বিভীষিকা বুঝতে শিখিয়েছে- চাহিদা আর প্রয়োজনীয়তা এক নয়। ফলে সচেতন হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যসামগ্রীর ক্রেতারা। অযথা অতিরিক্ত পণ্য কেনার হার কমে আসছে, বন্ধ হচ্ছে পছন্দের সামগ্রীর অপচয়। প্রাকৃতিক উপাদানে বাড়ছে ভরসা। সহজ-সরল বিউটি রুটিনে আগ্রহী হয়ে উঠছে অনেকেই। সোশ্যাল মিডিয়াতে মিলছে তার স্পষ্ট আভাস। পিনটারেস্ট প্রেডিক্টস ২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় এ বছরে ‘গ্লোয়িং স্কিন ন্যাচারালি’-এর সার্চ বেড়েছে চার গুণ। ‘ন্যাচারাল এভরিডে মেকআপ’-এর অনুসন্ধানও উঠে এসেছে শীর্ষে। বিউটি ব্র্যান্ডগুলোও এখন মনোযোগী মাল্টিপারপাস সিঙ্গেল হিরো প্রডাক্ট তৈরিতে। সচেতনতা বাড়ছে ক্রেতাদের মধ্যেও। অবাস্তব সব বিউটি স্ট্যান্ডার্ড আর ক্যাম্পেইন থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। বরং নিজের ত্বককে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। তা নিখুঁত না হলেও। গড়ে উঠছে আগামীর আড়ম্বরহীন রূপরুটিন। স্কিনিমালিজম।
দোকান থেকে অনলাইন শপিং সাইট- সর্বত্র অজস্র প্রডাক্ট। হাজারো ক্রিম, মাস্ক, সেরামের ছড়াছড়ি। প্রতিটির ভূমিকা আলাদা, একেকটি সামগ্রী একেক ধরনের সমস্যার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ড্রেসিং টেবিলে একের পর এক উপকরণ জমতে শুরু করে সৌন্দর্যসচেতনদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এত প্রডাক্ট প্রতিদিন ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না। তারপর নিয়মমাফিক শেলফ লাইফ ফুরিয়ে এলে, এদের জায়গা হয় ডাস্টবিনে। পয়সার শ্রাদ্ধ, সমস্যারও পোয়াবারো! আশ্চর্যের কথা হলো, প্রায় সবাই এ বিষয়ে সচেতন হলেও বিজ্ঞাপনের চাকচিক্যের কাছে হার মানে। বিশেষ করে যারা চুল আর ত্বক নিয়ে অতিরিক্ত সমস্যায় ভুগছে বা রূপচর্চায় আগ্রহী, তাদের পক্ষে এত প্রলোভন উপেক্ষা করা কঠিন। তবে এ সময়ে যেকোনো সামগ্রী কেনার আগেই সচেতনতা দরকার। অন্যের পরামর্শে নয়, নিজের প্রয়োজন এবং স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী রুটিন সেট করা চাই। আর সেই মতো প্রডাক্টই কেনা দরকার।
ত্বকের জন্য ফেসওয়াশ, টোনার, ময়শ্চারাইজার, সানস্ক্রিন এবং সেরাম যথেষ্ট। দোকানের কেমিক্যালে ভরা কৃত্রিম মাস্কের পরিবর্তে বাড়িতে বানানোটা ব্যবহার করাই ভালো। এক্সফোলিয়েটরও ঘরে তৈরি করে নেওয়া সহজ। চুলের জন্য তেল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার এবং অবশ্যই ভালো সেরাম জরুরি। এর বাইরে বাড়তি যত্নের জন্য ঘরোয়া মাস্ক বানিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। ঠোঁটের যত্নে লিপবাম বা পেট্রোলিয়াম জেলি অপরিহার্য। শরীরের যত্নে বডি অয়েল বা লোশন ছাড়াও হাতের কাছে রাখতে হবে রেজার। নেল ক্লিপার, কটন প্যাড, লুফা ইত্যাদিও জরুরি। এর বাইরে প্রয়োজন হলে যেকোনো ধরনের এসেনশিয়াল অয়েল কিনে রাখা যেতে পারে। মোটামুটি এ কটা সামগ্রী হাতের কাছে থাকলেই যথেষ্ট। চাইলে এই তালিকা থেকেও প্রোডাক্ট বাদ দেওয়া যেতে পারে। অনেক জিনিস ব্যবহার করলেই যে ত্বক আর চুল ভালো হয়ে যাবে, এমন নয়। উপকরণের চেয়েও জরুরি হলো সহজ কিছু নিয়ম।
রূপরুটিন অনায়াস রাখতে সামগ্রী কমল। কিন্তু যা বাদ পড়ল তার অভাব মেটাতে হবে। তালিকা থেকে বাদ পড়া পণ্যগুলোর প্রতিটিরই বিকল্প রয়েছে। শুধু কৌশলগুলো জানতে হবে।
ফিজিক্যাল এক্সফোলিয়েটর ব্যবহার করতে চাইলে ফেসওয়াশে বেকিং সোডা বা কফি মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে
ময়শ্চারাইজার যদিও মাস্ট হ্যাভের তালিকায় রয়েছে, তবু চাইলে টোনার দিয়ে এর চাহিদা মেটানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সেটি হতে হবে ময়শ্চারাইজিং। সেরাম ব্যবহারও মাস্ট
বডি লোশনের দারুণ বিকল্প ময়শ্চারাইজার। অয়েল বেসড ময়শ্চারাইজার দিয়ে মেকআপও তোলা যায়। মাস্কের মতো করেও ব্যবহার করা যেতে পারে
শুধু ঠোঁটের যত্নে নয়, শুষ্ক ত্বক, ফাটা গোড়ালির অব্যর্থ সমাধান হিসেবে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহৃত হয়ে আসছে
রূপচর্চায় তেলের মতো মাল্টিপারপাস উপাদান খুব কমই আছে। প্রাকৃতিক তেল মুখের ত্বক, শরীর, চুল- সবেতেই ব্যবহার করা যায়। আবার মেকআপ রিমুভারের বিকল্প হতে পারে এটি
শাওয়ার জেলের খুব ভালো বিকল্প শ্যাম্পু
বডি হেয়ার শেভ করার আগে এমোলিয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে কন্ডিশনার। শেভিং জেলের বিকল্প রূপে এটি কার্যকর
নিত্যব্যবহার্য সৌন্দর্যসামগ্রীর সংখ্যা আরও কমাতে চাইলে ঘরোয়া যত্ন সেরা। বাজার চলতি বাহারি কসমেটিকসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এগুলো। একটা কিংবা দুটো উপকরণ দিয়ে বানানো এসব ঘরোয়া টোটকার প্রতিটিই অব্যর্থ। উপকারও বেশি।
মুখ পরিষ্কার করতে কাজে লাগতে পারে দুধ। ঠান্ডা দুধে তুলা ডুবিয়ে মুখ মুছে নিলেই চলবে। চাইলে অল্প বেসন মিশিয়ে মুখে ঘষে নেওয়া যায়। নিমেষেই ত্বক উজ্জ্বল দেখাবে
মৃতকোষ দূর করতে কফি, লেবুর খোসা, গুঁড়া দুধ বা মসুর ডাল বাটা কাজে লাগানো যায়। যেকোনো একটি উপকরণের সঙ্গে পরিমাণমতো নারকেল তেল মিশিয়ে ঘন পেস্ট তৈরি করে পুরো মুখে মাখিয়ে মিনিট দশেক রাখতে হবে। আপওয়ার্ড স্ট্রোকে ঘষে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়
এক্সফোলিয়েটর হিসেবে যেকোনো ফলের খোসাই কার্যকর। ফেলে না দিয়ে সেসব রোদে ভালোমতো শুকিয়ে গুঁড়া করে নেওয়া যেতে পারে
মধু আর বেকিং সোডার মিশ্রণ যেকোনো ব্ল্যাকহেড স্ট্রিপ থেকে বেশি কার্যকর। কম বেদনাদায়কও
টোনারের বিকল্পে শসার রস, টমেটোর রস বা ডাবের পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। ময়শ্চারাইজার হিসেবে কাজে আসবে দুধের সর, টক দই বা অলিভ অয়েল। এগুলো ব্যবহার করতে হবে রাতে। মাখিয়ে আধঘণ্টা রেখে ধুয়ে নিতে হয়
পছন্দের সাইট্রাস ফলের ক্বাথ এবং মুলতানি মাটি বা চন্দনগুঁড়া মিশিয়ে বানানো যেতে পারে মাস্ক। ত্বকে জেল্লা আনার পাশাপাশি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করবে
শরীর ময়শ্চারাইজড রাখতে অলিভ বা আমন্ড অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। নারকেল তেল আর পানির মিশ্রণও মন্দ নয়। এ মিশ্রণ ত্বকে জেল্লাও আনবে
মেথি ভেজানো পানিতে চুল ধুলে খুশকির উপদ্রব কমবে। চুলের গোড়া মজবুত করতে কারিপাতা তেলে ফুটিয়ে ছেঁকে, তাতে পেঁয়াজের রস মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। পোড়া রসুনের কোয়া তেলে মিশিয়ে ব্যবহার করলে চুল কালো হবে
কন্ডিশনারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার, চায়ের লিকার কিংবা অ্যালোভেরা জেল। চুল নরম হবে, চকচকও করবে
পাকা কলা, ডিমের মিশ্রণ বহু যুগ ধরে হেয়ার মাস্ক হিসেবে জনপ্রিয়। তবে পাকা কলা অতিরিক্ত চটচটে মনে হলে তার পরিবর্তে মেশানো যেতে পারে যেকোনো ধরনের তেল। নারকেলের দুধ, আমলকীর ক্বাথ, মেথিবাটাও হেয়ার মাস্ক হিসেবে ভালো
চুলের জট ছাড়াতে কাজে লাগানো যায় গ্লিসারিন। হেয়ার সেরামের সাশ্রয়ী বিকল্প
ক্রেতা হিসেবেও হতে হবে সচেতন। এখনকার পরিস্থিতিতে শুধু বিলাসবর্জিত রূপচর্চা বা জীবনধারায় অভ্যস্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়। পারিপার্শ্বিকতা এবং নিজের প্রতিটা সিদ্ধান্তের বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। অল্প হলেও কিছু রূপচর্চার সামগ্রী দোকান থেকে কিনতে হবে। তবে তার আগে সেসব সৌন্দর্য এবং পরিবেশের জন্য কতটা ভালো, তা জানা দরকার। সে ক্ষেত্রে-
একবার ব্যবহার করা যাবে, এমন প্রডাক্ট না কেনাই ভালো। এগুলো পরিবেশে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ায়। তা ছাড়া কোনো জিনিসই একবার ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। তাই মাল্টি ইউজ প্রডাক্টের জন্য পয়সা খরচ করা যেতে পারে
প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের কনটেইনার কেনার চেষ্টা করতে হবে। এখন অনেক ব্র্যান্ডই বায়োডিগ্রেবল প্লাস্টিকের কনটেইনার তৈরি করে। প্রডাক্ট কেনার সময় সেগুলোই প্রাধান্য দেওয়া দরকার
কোনো জিনিস কেনার আগে তার উপকরণ, প্রণালি সম্পর্কে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। প্রডাক্টের লেবেলকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস না করাই ভালো। উপকরণের তালিকা পড়ে দেখতে হবে, যা প্রয়োজন তা আদৌ সেই প্রডাক্টে আছে কি না
হোয়াইটেনিং, ফেয়ারনেস ইত্যাদি তকমা আঁটা প্রডাক্ট থেকে দূরে থাকাই ভালো। কেননা, কোনো ক্রিম বা সাবানেই ফর্সা হওয়া যায় না। সৌন্দর্য অথবা রূপচর্চার অর্থ নিজেকে যত্নে রাখা, সুন্দর থাকা। গায়ের রং দিয়ে সৌন্দর্য বিচার করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কমপ্লেক্সন নিয়ে সোশ্যাল স্টিগমা ভাঙতে চাইলে এই ধরনের জিনিস কেনা বন্ধ রাখা দরকার। এগুলো যত বিকোবে, তত বেশি তৈরি হবে
বিদেশি প্রসাধনীর পরিবর্তে স্থানীয় জিনিস কেনার দিকে আগ্রহ বাড়াতে হবে। দামে কম, কিন্তু উপকারী- এমন প্রডাক্ট বেছে নেওয়া যেতে পারে
মডেল: প্রেইরী
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দিন