skip to Main Content

ফিচার I রসিক গোপালের খোঁজে

লোকশ্রুতি অনুযায়ী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও তার বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। সংশয় তো আছেই। লিখেছেন মনোজ দেব

গোপাল ভাঁড় মানেই হাসির ফোয়ারা। বাংলার এই রসিকের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক গল্প শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? তিনি কি শুধুই গল্পের চরিত্র? নাকি তার বাস্তব অস্তিত্ব ছিল? এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া না গেলেও নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের [১৭১০-১৭৮৩] সঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের নাম এমনভাবে জড়িয়ে যে একজন ছাড়া অন্যজনের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যায়।
কথিত আছে, হুগলির খানাকুল থেকে গোপাল ভাঁড়কে নিজের রাজসভায় বিদূষক করে এনেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর। অনেক বিষয়েই রাজা এই বিদূষকের পরামর্শ নিতেন। সব সময় তিনি চাইতেন গোপালকে বুদ্ধিতে পরাজিত করতে। সেসব নিয়েই রয়েছে অসংখ্য মজার গল্প। একবার রাজা গোপালকে বললেন, তিনি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছেন, তারা দুজন মৃগয়ায় যেতে যেতে পথের দুধারে দুটি দীঘি দেখলেন- একদিকে বিষ্ঠার, অন্যদিকে ক্ষীরের। গোপাল বিষ্ঠার দীঘিতে পড়ে গেল আর রাজা পড়লেন অপরটায়। বলেই তিনি হাসতে লাগলেন। গোপাল ভাঁড় তৎক্ষণাৎ বললেন, রাজা মশায়, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি, তবে আমার ঘুম আরও একটু পরে ভেঙেছিল। আমি দেখলাম, দীঘি থেকে উঠে আপনি আমার গা চাটতে লাগলেন, আমি আপনার। এভাবেই বারবার রাজা গোপালের বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয়েছেন।
কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন প্রতাপশালী রাজা। তার রাজত্বকাল ১৭২৮-৮৩। তিনি ছিলেন শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী। আঠারো বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। বয়স অল্প হলেও তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পসাহিত্যের অনুরাগী। যদিও ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের সময় ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের দায়ে ইতিহাসে তিনি নিন্দিত চরিত্র। কিন্তু শিল্পসাহিত্যের অনুরাগের কারণে তাকে মানুষ আজও মনে রেখেছে। তার সভাসদ ছিলেন মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধ প্রমুখ। তারই রাজসভার আরেক পন্ডিত ব্যক্তি গোপাল ভাঁড়- এমন বক্তব্য গবেষকদের।
গোপালের বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে আসা না গেলেও তাকে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা বইতে অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গোপাল রসিকচূড়ামণি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন।’ এই বিদূষকের গল্প মুখে মুখে, লোককথায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়লেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন উনিশ শতকের প্রথম দিকে। সে সময় কলকাতার বটতলায় গোপালের প্রথম বই প্রকাশিত হয়। সেসব কাহিনিতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গল্পের ছলে নানা সমস্যার যে সমাধান দিতেন, তারই বিবরণ রয়েছে। এ কারণে তিনি রাজার বিশেষ প্রিয় ছিলেন। তবে এই ইতিহাস নিয়ে সন্দেহ আছে। অনেকে বলেন, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় এই নামের কোনো ব্যক্তির উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার জন্মের ইতিহাসও জানা যায় না। জন্মস্থানের পক্ষেও কোনো নথিপত্র নেই। নগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা ‘নবদ্বীপ কাহিনী’তে বলা হয়েছে, গোপালের বাবার নাম জানা গেলেও তার মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
পঞ্চরত্নসভার রাজকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্ব ও সভাসদদের নিয়ে যে কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন, সেখানেও গোপালের কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহাফেজখানায় তার অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ কোনো দলিলদস্তাবেজ পাওয়া যায়নি। তার নিজের লেখা কোনো বইও পাওয়া যায় না। এই বিদূষকের কোনো ছবিও কেউ দেখেনি। তবে, শুধু এই রাজবাড়িতেই তার ছবি হিসেবে একটি অয়েল পেইন্টিং ঝোলানো রয়েছে। যেখানে রাজার ছবিও আছে।
চরিত্র হিসেবে কত দিনের পুরোনো এই রসিক ব্যক্তিটি? ৩০০ বছরের মতো হবে এর ইতিহাস। নবদ্বীপ কাহিনি বা ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ বইটির লেখক নগেন্দ্রনাথ দাস একটি বংশলতিকা প্রকাশ করেছেন। সেখানে গোপালের পিতামহ, পিতা ও বড় ভাইয়ের নাম পাওয়া যায়। লেখক জানিয়েছেন, তার নাম আসলে গোপালচন্দ্র নাই। কৃষ্ণচন্দ্র তাকে রাজভান্ডারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গোপালচন্দ্র ভান্ডারী হাস্যার্ণব উপাধিতে ভূষিত করেন। এই ভান্ডারীর অপভ্রংশ থেকে ভাঁড় কথাটি এসেছে। অন্যদিকে কুমুদনাথ মল্লিকসহ অনেকেই বলেছেন, তার বংশ-পদবি ‘নাই’, মানে নাপিত। এবং তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের পাশের এলাকা শান্তিপুরের লোক। ভাষাবিদ সুকুমার সেন বলেছেন, ‘গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতূহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে ও উঠছে, তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি। গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দভান্ডারের ভান্ডজাত মনে করে অনেকে গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন। নাপিতের জাতি ব্যবসায় ভাঁড়-ক্ষুর নিয়ে। সুতরাং গোপাল ভাঁড় নাপিত।’ তবে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ গোপালের কোনো অস্তিত্ব ছিল না বলেই জানিয়েছেন।
নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষ-এ উল্লেখ করা হয়েছে, গোপালের আদি নিবাস গুপ্তিপাড়া। আবার সুজিত রায় ‘গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে’ বইতে তার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন নানাভাবে।
তবে গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলো যেমন অসামান্য হাস্যরসের সৃষ্টি করে, তেমনি সেগুলোর মাধ্যমেই কৃষ্ণচন্দ্র অনেকবার নবাবের কাছে ঘোর অপমান থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন বলে প্রচলিত। নানান ঘটনায় রাজাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন, আবার বিপদে তাকে উদ্ধারও করেছেন। প্রতিটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে। যেগুলো পরবর্তীকালে গল্পের আকারে ছড়িয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। তার কথার ঢঙ্গে বোঝা যায়, রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস এমনকি ভগবত ও পুরাণে, রামায়ণ-মহাভারতে পন্ডিত ছিলেন তিনি। অন্যদিকে ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও চরিত্রবান। এসব কারণে মহারাজ এবং রানি তাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন।
ইতিহাসে গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্ব থাক বা না থাক- তার নামে প্রচলিত গল্পের রসে বাঙালিমাত্রই আনন্দে লুটিয়ে পড়ে। এ দেশের লোকসংস্কৃতির গভীর পরিচয় পাওয়া যায় এই চরিত্রের মধ্যে। হাস্যরসের আড়ালে সেসব গল্পে মনের গোপন কথাটিই পরিস্ফুট। সেটি হলো, মানুষের প্রতি মানবিক দৃষ্টি, সুশাসনের ইঙ্গিত। কেবল হালকা হাসির খোরাকই নয়, সমাজসংস্কারের এই কথামালাই এগুলোর প্রাণ।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top