হেরিটেজ I গৌড়-লক্ষ্মণাবতী
হারিয়ে যাওয়া নগরী। রাজনৈতিক সীমানা যাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। সেই নিদর্শনগুলোর কিছু রয়ে গেছে আজও। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
কিংবদন্তি বলে, এককালে এখানে প্রচুর আখের চাষ হতো। তা থেকে তৈরি হতো উৎকৃষ্ট মানের গুড়। সেখান থেকেই গৌড় নামের উৎপত্তি। তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর বাৎসায়নের লেখনীতে এই নগরের কথা রয়েছে। পুরাণেও পূর্বদেশ হিসেবে আছে গৌড়ের উল্লেখ। ষষ্ঠ শতাব্দীতে লেখা বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতাতেও রয়েছে এর বিবরণ। বাংলার বিখ্যাত নরপতি শশাঙ্কের সময় থেকে গৌড় নগরী উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে বলে জানা যায়। শহর হিসেবে সপ্তম থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এর গুরুত্ব ছিল। তবে গৌড়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের বিভিন্ন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং ভারতের মালদা জেলায় দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এই পুরোনো রাজধানী শহর। পুরাকীর্তিগুলো একসময় এমন জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল যে ১৯৫৭ সালেও ডক্টর সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বাঘের গর্জন শুনেছিলেন। প্রথম পর্বে থাকছে ভারতীয় অংশের কিছু স্থাপনার বয়ান।
মালদার ইংলিশ বাজার থেকে ২০-২৫ মিনিটের বাসযাত্রা পিয়াসবাড়িতে। সেখান থেকে হাঁটতে থাকলে প্রথমেই রামকেলি। এখানে শ্রীচৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্মমতের প্রচার করেছিলেন, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়ে। এখন সেখানে তমালতলায় চৈতন্যদেবের একটি ভাস্কর্য আর তালাবদ্ধ ঘরে রাখা হয়েছে তার পদচিহ্ন। সেখান থেকে আরও খানিকটা হাঁটতেই বারোদুয়ারি মসজিদ। তবে সেটা বেশি পরিচিত বড় সোনামসজিদ নামে। গৌড়ের পুরোনো মসজিদগুলোর ভেতরে এটি সবচেয়ে বড়। ১৫২৬ সালে সুলতান নসরত শাহের এই মসজিদের দুটি অংশ ছিল- বারান্দা ও সালাতকোঠা। এর পূর্ব দেয়ালে ১১টি আর উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে চারটি করে দরজা। মোট ৪৪টি গম্বুজ ছিল এই মসজিদে। পশ্চিম দেয়ালে ১১টি মিহরাব ছাড়াও উত্তর কোণে ছিল নারীদের নামাজ পড়ার স্থান। ৩৩টি বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত হয়েছিল সালাত কোঠাটি- ১১টি বে (পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা সারি) ও তিনটি আইল (উত্তর-দক্ষিণে লম্বা সারি) দিয়ে। মসজিদের সামনে খোলা চত্বর, যার পশ্চিম ছাড়া সব দিকেই একটি করে খিলান-দরজা ছিল। সেগুলো একসময় ফুলের নকশা করা গ্লেজড টাইলসে মোড়া ছিল।
বড় সোনামসজিদের একটু পরেই ৮৪ ফুট লম্বা ফিরোজ মিনার। এককালে অবশ্যই দেখার মতো ছিল। পাঁচ ধাপের এই মিনার একটু একটু করে সরু হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। অনেকে বলেন, একদম ওপরের তলায় ছাদবিহীন ঘরটি একসময় গম্বুজে ঢাকা ছিল। প্রতিটি ধাপ স্পষ্ট গোলাকার ব্যান্ড দিয়ে আলাদা করা। ইটের তৈরি এই মিনারের ভিত নির্মিত হয়েছে মর্মর পাথরে আর দরজার বাজুবন্ধে নীল পাথর। স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুযায়ী এর নামের পিছে দুটো গল্প আছে, প্রথমটি এর দেয়াল ফিরোজা রঙের পাথরে ঢাকা ছিল একসময়। দ্বিতীয়টি, এটা সুলতান ফিরোজ শাহের তৈরি। গোয়ামালতির নীলকুঠিতে পাওয়া শিলালিপিকে যদি ফিরোজ মিনারের লিপি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সাইফ-উদ-দিন হামযা শাহ (১৪১১-১৩) বা সাইফ-উদ-দিন ফিরোজ শাহ (১৪৮৮-৯১) এই মিনারের নির্মাতা। এরপর বেশ খানিকটা হেঁটে পাওয়া গেল দাখিল দরজা।
গৌড়ের দুর্গ এলাকার একেবারে উত্তরে এই দরজাটি তৈরি হয়েছিল প্রাসাদে প্রবেশের জন্য। এর প্রতি কোনায় ছিল ১২টি কোণযুক্ত বুরুজ। মূল স্থাপনার মাঝখানে প্রায় ১৪ ফুট চওড়া ও ১১৩ ফুট লম্বা দরজা ছিল। দুপাশের দেয়ালে সহায়ক খিলান। বাকি অংশে নকিব ও প্রহরীদের থাকার জায়গা, ওপরে ওঠার সিঁড়ি ইত্যাদি। ধারণা করা হয়, এর ওপর একটি অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজও ছিল।
এরপর খানিক হাঁটলেই কদমরসুল। বর্গাকৃতির ঘরের সঙ্গে পশ্চিম ছাড়া বাকি তিন দিকে দরজা রয়েছে। বাইরের প্রতি কোণেই আট কোনাকৃতির বুরুজ আছে। সামনের দুটো বুরুজের মাথায় বারো কোনাকৃতির ফুলদানির মতো অনুগম্বুজ। মূল ঘরের ওপরে অর্ধগোলাকৃতির গম্বুজ। বাইরে থেকে ঢোকার জন্য বারান্দায় পূর্ব দিকে তিনটি আর উত্তর-দক্ষিণে একটি করে খিলান-দরজা রয়েছে। পূর্ব দিকের খিলানগুলো মোটা ও নকশা করা পাথরের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। এর দেয়ালে ফুলের কারুকাজ। উত্তর আর দক্ষিণের দেয়ালে বাইরের দিকে খোপ-নকশা। ১৫৩১ সালে সুলতান নসরত শাহের তৈরি এ ইমারতের ঠিক মাঝখানে পাথরের মঞ্চে রাখা হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর পদচিহ্ন। কদমরসুল ইমারতের ঠিক উল্টো দিকে শাহ সুজার মুসাফিরখানা। কদমরসুল প্রাঙ্গণে আরও বেশ কিছু কবরের চিহ্ন দেখা গেলেও সেগুলো কাদের, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে একটি কুঁড়েঘরাকৃতির স্থাপনায় শায়িত আছেন ফতেহ খান। প্রচলিত মত অনুযায়ী তিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সেনাপতি দিলির খানের ছেলে। পাশেই দুটো দরজা। একটির নাম লুকোচুরি, অন্যটি গুমতি। লুকোচুরি তোরণ ছিল প্রায় তিন তলা উঁচু। এর দুপাশে প্রহরীদের ঘর আর ঢোল বাজানোর স্থান। বলা হয়, এই দরজাটি শাহ সুজার তৈরি। এক গম্বুজের আরেকটি চমৎকার দরজা রয়েছে এর ঠিক পাশেই- গুমতি ফটক। এর চারকোনায় বুরুজ। পুরো ফটকটি এনামেল করা রঙিন গ্লেজড টাইলসে মোড়া ছিল। এখন এই ফটকের ভেতর প্রত্নবস্তু প্রদর্শিত হয়। পাশেই চিকা ইমারত। ঠিক কী কাজে এই ভবন ব্যবহৃত হতো, সেটা জানা যায় না। এটিতে না আছে মিহরাব, না আছে কবর আচ্ছাদন। গ্লেজড টাইলসের দেখাও মেলে এর গায়ে। এলাকার লোকেরা মসজিদ বললেও পাশের বিশাল আরেকটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ধারণা করা হয়, পাশাপাশি দুটো স্থাপনা একই উদ্দেশে ব্যবহৃত হতো, সম্ভবত প্রশাসনিক কাজেই।
বাইশগজি দেয়াল আর জাহাজঘাটা দেখতে একটু পিছিয়ে যেতে হয়। বাইশগজি দেয়াল ছিল মূল প্রাসাদ ঘিরে। সমসাময়িক বৈষ্ণব কবির বর্ণনা ঠিক হলে এই দেয়ালে দাঁড়িয়ে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ দুর্গের পশ্চিম দিকে গঙ্গার ওপারে শ্রীচৈতন্যদেবের মিছিল দেখেছিলেন। দেয়ালের ভেতরের দিকেই রয়েছে বল্লালবাটি নামে পরিচিত প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সেটা ছাড়িয়ে আমবাগানের ভেতর দিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলে জাহাজঘাটা। এখানে মধ্যযুগের শিকল ও নোঙর পাওয়া গেছে।
এরপরের পথ পায়ে হেঁটে চলার জন্য একটু কষ্টকর। বাংলাদেশ সীমান্তের পথেই চামকাটি, তাঁতিপাড়া, লটন, গুণমন্ত মসজিদ। একেবারে সীমান্তে রয়েছে কোতোয়ালি দরজা। ইজিবাইকে গেলে সেগুলো দেখা যায় বেশ সহজেই। শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের শাসনামলে ১৪৭৫ সালে তৈরি হয়েছিল চামকাটি মসজিদ। বর্গাকার নামাজ ঘরের পূর্ব দিকে একটি বারান্দাও রয়েছে। সেখানে আছে দুটি আর নামাজঘরে তিনটি খিলান দরজা। পশ্চিম দিকে একটি মিহরাব। ইটের তৈরি হলেও মসজিদের ভেতরের দিকে দেয়ালের নিচে পাথরের আস্তরণ দেওয়া। মসজিদের গায়ে নানা রঙের টাইলস ছিল, যেগুলোর দু-একটি এখনো দেখা যায়। এরপর তাঁতিপাড়া মসজিদ। এটাও শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলে তৈরি। টেরাকোটার অসাধারণ কাজ দেখা যায় এর অলংকরণে। দুই সারিতে পাঁচটি করে আধাগম্বুজে ঢাকা ছিল মসজিদটি। মিহরাবও ছিল পাঁচটি। লটন মসজিদও প্রধান সড়কের সঙ্গেই লাগোয়া। বর্গাকৃতির নামাজঘরের সঙ্গে পূর্ব দিকে একটা বর্ধিত অংশ রয়েছে বারান্দা হিসেবে। এই মসজিদের দেয়ালে নানা রঙের টাইলসের ব্যবহার হয়েছিল। মেঝেতেও চমৎকার টাইলসের নকশা দেখা যায়। ধারণা করা হয়, এটাও সুলতান ইউসুফ শাহের আমলেরই কীর্তি। সুলতান ফতেহ শাহর আমলে (১৪৮৪-৮৫) তৈরি গুণমন্ত মসজিদ দেখতে একটু ভেতরের দিকে যেতে হয়। এর নকশায় পাথর ব্যবহারে পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। পাশেই একটি পাঁচ খিলানের সেতুও রয়েছে সুলতানি আমলের, যেটাকে এখন পাগলা সাঁকো বলেই স্থানীয়রা ডাকে। সেতুটি সুলতান মাহমুদ শাহ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করিয়েছিলেন।
কোতওয়ালি দরজা এখন বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানা হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ দরজা খুব সম্ভবত তৈরি হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই, যখন বাংলায় দিল্লির প্রভাব ছিল।
(চলবে)
ছবি: লেখক ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ