skip to Main Content

ফিচার I সিনেমার ব্যানার

চলচ্চিত্রশিল্পে প্রচারণার অংশ হিসেবেই এর সূচনা। হলিউড থেকে মুম্বাই হয়ে এই অঞ্চলে ফর্মটির বিস্তার ঘটে। ক্রমে শিল্পকলার একটি শাখা হয়ে ওঠে। লিখেছেন বিপ্লব সরকার

‘আমরা যাইনি ম’রে আজও, তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’- জীবনানন্দ দাশ
ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও মফস্বলে যারা বেড়ে উঠেছে জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাংশের মতোই, তাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে বাংলাদেশের হাতে আঁকা চলচ্চিত্র ব্যানারের বিভিন্ন মনকাড়া, রঙিন দৃশ্য। শুধু যে বিশালত্বের কারণেই সেগুলো নজর কাড়ত তা নয়, বরং চিত্তাকর্ষক রঙের ব্যবহার, বিচিত্র কম্পোজিশন এবং প্রধান চরিত্রগুলোর নাটকীয় উপস্থাপন ব্যানারকে চলচ্চিত্রের প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করে। এ যেন সবদিক দিয়েই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। সিনেমার প্রচারণার জন্য নির্মিত হলেও নিজস্ব ধরন ও নির্মাণশৈলীর কারণে বাংলাদেশের চারুশিল্পে স্বতন্ত্র একটা ধারা তৈরি করেছে ব্যানার পেইন্টিং। ষাটের দশকে এ দেশে চারুকলার বিকাশেও এই চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সে সময় ঢাকায় আর্ট গ্যালারি ছিল না। চলচ্চিত্র ব্যানার শিল্পীদের আঁকা বড় বড় ক্যানভাসই পাবলিক আর্ট হিসেবে অনেক শিল্পীকে চিত্রকলায় আকৃষ্ট করেছিল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম জাতীয় দৈনিকে লেখা ‘বাংলাদেশের চারুকলার বিকাশমান ধারা এবং শিল্পীদের ভবিষ্যৎ’ নামে একটি প্রবন্ধে তার এবং সমকালীন শিল্পীদের শিল্পানুপ্রেরণায় ব্যানার চিত্রের অবদানের কথা স্মরণ করেন। সে সময় চারুকলার অনেক ছাত্রই শিল্প-অধ্যয়নের পাশাপাশি খন্ডকালীন চাকরি হিসেবে ব্যানার চিত্র আঁকতেন। এ ক্ষেত্রে নিতুন কুন্ডু, আজিজুর রহমান ও মহিউদ্দীন ফারুকের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। আজ সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই- সিনেমার সুদিনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ধারার হাতে আঁকা এই শিল্প, হারিয়েছে বিশাল ক্যানভাসে অঙ্কিত সেলুলয়েডের রংবেরঙের মুখ।
চলচ্চিত্রের সমবয়সী সিনেমার পোস্টার কিংবা ব্যানারের ইতিহাস। আকার, আকৃতি এবং ধরন অনুযায়ী বড় পোস্টারই আসলে বিলবোর্ড কিংবা হোর্ডিং- বাংলাদেশে যেগুলোকে চলচ্চিত্রের ব্যানার বলা হয়ে থাকে। ব্যানার আঁকিয়েরাও তাই পোস্টার আর্টিস্ট হিসেবেই পরিচিত। চলচ্চিত্রযাত্রার পুরোধা ব্যক্তিত্ব মানিকজোড় দুই ভাই অগাস্ত ল্যুমিয়ের ও লুই ল্যুমিয়ের ১৮৯৫ সালে প্রথম কোনো একক সিনেমার প্রচারণার জন্য পোস্টার তৈরি করেন। তাদের চলচ্চিত্র ‘দ্য ওয়াটারার ওয়াটারড’-এর পোস্টারটির শিল্পী ছিলেন মার্সেলিন আওজোলি। তবে সিনেমার পোস্টারের সম্ভাবনার বীজ প্রোথিত হয় চলচ্চিত্র আবিষ্কারের দুই দশক আগে, ১৮৭০-এর দশকে। এ সময় প্যারিসের শিল্পী ও লিথোগ্রাফার জুল কেরেট কালার লিথোগ্রাফের (ওলিওগ্রাফ) মাধ্যমে আধুনিক পোস্টার যুগের সূচনা করেন। চলচ্চিত্র শোর জন্য নির্মিত প্রথম পোস্টারটিও ছিল জুল কেরেটের করা, ১৮৯০ সালে। যদিও তার পর থেকে সিনেমার বিভিন্ন শোর প্রচারণার জন্য বেশ কিছু পোস্টার তৈরি করা হয়, তবে ১৮৯৫ সালে করা ‘দ্য ওয়াটারার ওয়াটারড’-এর পোস্টারটি ছিল অনন্য- প্রথমবারের মতো একটি নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রের প্রমোশনাল হিসেবে এটি তৈরি করা হয়, অন্যদিকে এটিতেই প্রথম সরাসরি সিনেমার কোনো দৃশ্য দেখা যায়। আয়তন এবং ল্যান্ডস্কেপিক আকৃতির কারণে এটিকে প্রথম চলচ্চিত্র ব্যানার হিসেবেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। এর পরে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে এসে হলিউডের হাত ধরে সিনেমা ব্যানারের ব্যবহার শুরু হয়। এ সময় হলিউডের চলচ্চিত্র বিশ্ব পরিভ্রমণ শুরু করলে ব্যানার শিল্পও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও তাই। এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত পাওয়া ব্যানার চিত্রের প্রাচীন নিদর্শন- ১৯২২ সালে মুম্বাইতে চার্লি চ্যাপলিনের দ্য কিড চলচ্চিত্রের ব্যানারসহ প্রচারণার একটি স্থিরচিত্র এই কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। হলিউড থেকে বিস্তৃত হলেও স্থানীয় শিল্পীদের শৈলী ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের কারণে পোল্যান্ড, ঘানা, ভারত ও বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু দেশে হাতে আঁকা চলচ্চিত্র ব্যানার তার হলিউডি বেশভূষা ছেড়ে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী আরবান পাবলিক আর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের এই শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৪৭-এ ভারত ভাগের পর প্রধানত ঢাকা এবং নীলফামারীর সৈয়দপুরকে কেন্দ্র করেই এখানকার ব্যানার চিত্র বিকশিত হয়েছে। ভারত থেকে আসা অবাঙালি মুসলিম এবং স্থানীয় স্বশিক্ষিত শিল্পীরাই এই ধারা প্রবহমান রাখেন। পরবর্তীকালে এ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই শিল্পের বিস্তৃতি ঘটে। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীরাই মূল ভূমিকা পালন করেন। প্রথম দিকে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী ব্যানার চিত্রাঙ্কনে এগিয়ে এলেও পরবর্তীকালে তারা এই পেশায় স্থায়ী হননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীরা বেশি দিন এই কাজে যুক্ত না থাকায় তাদের অঙ্কনরীতি বা শৈলীরও তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায় না এখানকার ব্যানারে। ধীরে ধীরে এই কাজে শুধু অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীরাই জড়িত থাকেন, যারা গুরুপরম্পরায় এই শিল্প আয়ত্ত করেন। এভাবে এদের হাতেই এখানে ব্যানার চিত্রের একটা স্বতন্ত্র ধারা গড়ে ওঠে।
অবাঙালি আবদুল ওহাব, আবদুল হাফিজ ও এস এম শাহাবুদ্দিনের মতো ব্যানার চিত্রকরেরা দক্ষিণ ভারত থেকে সৈয়দপুরে এসে ঘাঁটি গাড়েন। ঢাকায় এই শিল্পের পথিকৃৎ মোহাম্মদ সেলিমের আদি নিবাস ছিল মুম্বাই। আবার আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যানার শিল্পী এস মঈন আসেন কলকাতা থেকে। স্বাধীনতার পরে এই শিল্পীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যান। তবে তাদের কাছে যারা কাজ শিখেছিলেন, তারাই পরবর্তীকালে শিল্পটি ধরে রাখেন। ষাটের দশক থেকে চিত্রকলার অনেক শিক্ষার্থীও এই কাজে জড়িয়ে পড়েন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এমন দুজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পী হলেন নিতুন কুন্ডু এবং আজিজুর রহমান। দুজনেরই শুরুটা ছিল চলচ্চিত্রের ব্যানার আঁকার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে নিতুন কুন্ডু চিত্রশিল্পী, ভাস্কর এবং অটবির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। অন্যদিকে ছুটির ঘণ্টা খ্যাত আজিজুর রহমান নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। প্রখ্যাত পরিচালক সুভাষ দত্তও ব্যানার আঁকতেন। বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের পোস্টারও তার করা। তিনি ছিলেন অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী। সিনেমার পাবলিসিটি শিখবেন বলে প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুম্বাইতে চলে যান। সেখানে মাকার্ট স্টুডিওতে বেয়ারার কাজ করেও ব্যানার নির্মাণের কলাকৌশল রপ্ত করেন। তিনি পরবর্তীকালে ঢাকায় এসে সেই জ্ঞান কাজে লাগান। সেদিক থেকে ঢাকার সঙ্গে মুম্বাইয়ের ব্যানার চিত্র নির্মাণের একটা যোগসূত্রও সন্ধান করা যেতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, সুভাষ দত্ত, নিতুন কুন্ডু এবং আজিজুর রহমান- এই তিন দিকপালই একসময় এভারগ্রিন পাবলিসিটি ফার্মে সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন।
প্রথাগত পেইন্টিংয়ের সঙ্গে ব্যানার আঁকার কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এ জন্য শিল্পীদের কাছে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যের স্থিরচিত্র দেওয়া হতো, তারা সেখান থেকে চরিত্র বেছে নিয়ে নিজেদের মতো করে কম্পোজিশন করতেন। অনেক সময় পরিবেশক বা হলমালিকেরাও তাদের চাহিদামতো কম্পোজিশন করিয়ে নিতেন। ক্যানভাস হিসেবে সাধারণত মার্কিন ও টেট্রন জাতীয় কাপড় ব্যবহার করা হতো। কখনো কখনো চট ব্যবহারের উদাহরণও পাওয়া যায়। ব্যানারের ক্যানভাসের ওপর বেইজ তৈরি করা হতো এপিকোন, বাইন্ডার, জিঙ্ক অক্সাইড ও পানির মিশ্রণের সাহায্যে কয়েক পরত আস্তরণ দিয়ে। এরপরের কাজ হলো তার ওপর গ্রাফ তৈরি করা। পরবর্তী ধাপে গ্রাফের ওপর পেনসিল দিয়ে ড্রয়িং এবং সব শেষ ধাপে রং করা হতো। মজার ব্যাপার হলো, ব্যানারে অস্থায়িত্বের কারণে জলরং এবং দামের জন্য তেলরং ব্যবহার করা হতো না। পরিবর্তে বাজারে পাওয়া সাধারণ গুঁড়া রঙের সঙ্গে তিসির তেল মিশিয়ে বিশেষ এক ধরনের পেস্ট তৈরি করে সেটা দিয়ে রং করা হতো। সৈয়দপুরের শিল্পীরা শেষ পর্যন্ত সেই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। অবশ্য ঢাকাতে একসময় প্রেস ইঙ্ক এবং ফ্লুরোসেন্ট ব্যবহার করার প্রচলন শুরু হয়। ফ্লুরোসেন্ট ছবির ঔজ্জ্বল্য বাড়াত। ষাটের দশকে কিছু ব্যানারে স্প্রে এবং কোলাজের ব্যবহারও হয়ে থাকে। জানা যায়, খান আতা পরিচালিত ঝড়ের পাখি চলচ্চিত্রের বিশাল একটা ব্যানার করা হয়েছিল কোলাজের মাধ্যমে।
একটা সময় সিনেমা প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল ব্যানার পেইন্টিং। এটিই মূলত দর্শকদের ওই চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট করত। কাপড়ের বিশাল ক্যানভাসের ওপর উজ্জ্বল সব রঙে সেলুলয়েডের পাত্র-পাত্রীদের অতিরঞ্জিত মুখগুলো আমাদের বাংলা সিনেমার সোনালি দিনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সেদিন আজ গত। বাংলাদেশে এই শিল্পের সুসময় ছিল মূলত পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত। নব্বই দশকের সূচনাকাল থেকে এই শিল্পে ধস দেখা দেয়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারণার সুবিধা, ব্যানার চিত্রে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যবহার, চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার প্রবেশ ও শিল্পীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে বিলুপ্তির পথে বাংলাদেশের পাবলিক আর্টের এই অনন্য ধারা। এখন একটা ব্যানার আঁকা স্টুডিও আর অবশিষ্ট নেই। তবে খুব বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পাবলিক আর্ট থেকে এটি এখন স্থান বদলে গ্যালারি আর্ট হিসেবে বিভিন্ন এক্সিবিশনে উপস্থাপিত হচ্ছে- ভিন্ন রুচিতে, পৃথক সাজে। সম্প্রতি দেশ-বিদেশে বেশ কিছু গ্যালারিতে বাংলাদেশের ব্যানার শিল্পীদের কাজ প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বিদেশের কয়েকটি গ্যালারি সেসব সংরক্ষণও করেছে।
বাংলাদেশের সমকালীন অনেক শিল্পীর কাজেই ব্যানার চিত্র-শৈলীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়- যেমন চন্দ্রশেখর দে, শিশির ভট্টাচার্য্য, আবদুস সালাম, সুমন ওয়াহেদ ও মানিক বণিক। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের এই শিল্পশৈলীকে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে মাধ্যমটির উন্নতি ঘটবে বলে অনেকেই মনে করেন।

লেখক : চলচ্চিত্রকর্মী
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top