ফিচার I তাঁতশিল্পের ইতিবৃত্ত
বাঙালির হাতে বোনা বস্ত্রের কদর ছিল বিশ্বজুড়ে। দুই হাজার বছর আগেও। ঔপনিবেশিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই শিল্প ফিরেছে নতুন রূপে। লিখেছেন মনীষা উজ্জয়িনী
খ্রিস্টজন্ম-পরবর্তী শতকগুলোতে ভারতবর্ষে কুটিরশিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল। সেসবের মধ্যে তাঁতশিল্প উল্লেখযোগ্য। প্রায় পুরো পাশ্চাত্যে অত্যন্ত সমাদর পেত এই অঞ্চলের তাঁতবস্ত্র। ভারত মহাসাগরীয় এবং দক্ষিণ সমুদ্র-উপকূলবর্তী সব দেশেই সেগুলোর ব্যাপক চাহিদা ছিল।
বিশেষ করে সুতি কাপড় উৎপাদনে এই অঞ্চলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীজুড়ে। কটন ও রেশম বস্ত্র তখন পাশ্চাত্যে রপ্তানি হতো। সেখানকার দেশগুলোতে এসবের কদরও ছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের ভারতীয় বিভিন্ন বইতে নানা রঙে ছাপা সুতির কাপড় ও পোশাকের উল্লেখ রয়েছে। ইউরোপীয় লেখকেরা জানিয়েছেন, ভারতীয় সুতিবস্ত্র ছিল খুব হালকা, রঙে ছোপানো এবং সুতোর বুনটও ছিল অন্যান্য দেশে তৈরি কাপড়ের চেয়ে সূক্ষ্ম ও টেকসই। বারানসিতে বোনা রেশম বস্ত্রের বিশেষ আকর্ষণ ছিল বিদেশে। এমনকি বাংলাদেশে তৈরি মিহি সুতির কাপড়ও সমান আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পশমি বস্ত্রও তৈরি হতো। সেসবের চাহিদাও ছিল বিভিন্ন দেশে। কিন্তু প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারব্যবস্থা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে বাংলার গৌরবময় এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মোগল আমলে বাংলার ঐশ্বর্য এবং সম্পদ ধ্বংস হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ কোম্পানি এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকারের শাসনকালে ভারতবর্ষের তাঁতশিল্প প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে তখন ইংল্যান্ডে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার ও বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহারে নবযুগের সূচনা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ ও সম্পদ সে দেশে নিয়ে যাওয়ার ফলে শিল্পবিপ্লব (ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন) দ্রুত সমৃদ্ধ হতে পেরেছিল। এসব কারণে সেখানে অল্প সময়ে অনেক কাপড় উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁতে বোনা বস্ত্রের চেয়ে সেগুলোর দামও ছিল কম। তাঁতিদের হাতে তৈরি এই কাপড় টেকসই, আরামদায়ক এবং উন্নত হলেও সেগুলো কলকারখানার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তথাপি, ইংরেজ সরকার ক্ষমতার জোরে এ দেশের কুটিরশিল্প ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যেন শিল্পজাত সব পণ্যের ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে।
পলাশি যুদ্ধের পর ভারতবর্ষের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের কারণ ইংরেজ কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশির জোর। তাদের এই তৎপরতার বিরুদ্ধে মীরকাশিম প্রতিবাদ করায় তাকে রাজ্যচ্যুত হতে হয়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর ক্ষমতা পুরোপুরি হাতে পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের স্বার্থবিরোধী নানা রকম আইন তৈরি করে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে নতুন সনদ অনুসারে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য বন্ধ হলেও ইংল্যান্ডের যেকোনো প্রতিষ্ঠান বিনা শুল্কে বা নামমাত্র শুল্কে বিভিন্ন সামগ্রী এ দেশে আমদানি করতে পারত। অন্যদিকে বাংলার পণ্য সে দেশে রপ্তানি করতে হলে চড়া শুল্ক দিতে হতো। একই সঙ্গে তাঁতিদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চলতে থাকে। তারা মালপত্র ইংরেজ ছাড়া অন্য কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে দেওয়া হতো না।
তাঁতিরা বাংলাদেশে উৎপন্ন কার্পাস সুতা ব্যবহার করত। সেসব প্রয়োজনমতো উত্তর প্রদেশ থেকে নদীপথে আমদানি করা হতো। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি সব সুতার ওপর শতকরা ৩০ টাকা শুল্ক নিত, যাতে সুরাট হতে সমুদ্রপথে তাদের আমদানি করা সুতা তাঁতিরা কিনতে বাধ্য হয়। এ দেশের কাপড় ভারতের বাইরে বসরা, জেদ্দাসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হতো, এমনকি সেখানকার বণিকেরা এখানে আসত। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে সেই বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যায়।
ফরাসি রত্নবিশারদ ও পরিব্রাজক তাভার্নিয়ে সতেরো শতকে বাংলার মসলিন নিয়ে লিখেছেন। এই বস্ত্র সম্পর্কে কিংবদন্তি কে না জানে। কথিত আছে, ইংরেজরা মসলিনশিল্পীদের হাতের আঙুল কেটে দিয়েছিল, তারপর হারিয়ে যায় অতি সূক্ষ্ম এই বস্ত্র। জোয়াখিম জোসেফ আ কাম্পোস হিস্ট্রি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল বইতে উল্লেখ করেছেন, একসময় ঢাকার সাতগাঁও এলাকা থেকে রপ্তানি করা মসলিন কাপড় পরতেন রোমান নারীরা। তখন বাংলার মসলা ও অন্যান্য দ্রব্য মিসর হয়ে রোমে যেত। সেসব বস্তু অত্যন্ত সমাদৃত ছিল এবং বিক্রিও হতো চড়া দামে।
দুই
দেশভাগের পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে দেশজ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়ে। তারই পথ ধরে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের দমন-পীড়নও এই বদলের পালে বাতাস দিয়েছিল। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উদযাপন, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, উদীচী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েও বাঙালির যে জাগরণ ঘটে, সেখানে কুটিরশিল্পের পুনরুৎপাদনও একটি বড় ঘটনা ছিল। লালপাড়, সাদা শাড়ি, খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি, জামদানি এখানকার বাঙালিদের আইকনিক পোশাক হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরে, সত্তরের দশকে তা আরও ব্যাপকতা পায়। বলা যেতে পারে, তারই ধারাবাহিকতায় ছোট পরিসরে হলেও, এ দেশে তাঁতশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটে। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, কুমারখালী, নরসিংদীসহ অনেক এলাকায় প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই শিল্প নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে টাঙ্গাইলে তাঁতশিল্প গড়ে ওঠে। কারিগরেরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিনশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ঢাকার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। এই শিল্পীরা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইলে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তারা নকশাবিহীন কাপড় প্রস্তুত করতেন। ১৯০৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের কলে তৈরি কাপড় বর্জন করার সময় তাঁতশিল্পের কদর বাড়ে। ১৯২৩-২৪ সালের দিকে এসব বস্ত্রে নকশার প্রবর্তন করা হয়, যা এখন পৃথিবীজুড়ে টাঙ্গাইলের জামদানি হিসেবে বিখ্যাত।
সিরাজগঞ্জ, কুমারখালী বা নরসিংদীর তাঁতশিল্পও এ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। অঞ্চলভেদে কাপড়েরও রয়েছে ভিন্নতা। এসব তাঁতবস্ত্র বিশে^র দেশে দেশে সুনাম অর্জন করেছে। সিরাজগঞ্জের লুঙি, শাড়ি বিখ্যাত। আবার কুমারখালীর চাদর, গামছা, থান কাপড়ের খ্যাতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়েছে। একইভাবে নরসিংদীর তাঁতবস্ত্রেরও রয়েছে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। তা ছাড়া পার্বত্য বা সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদেরও আছে নিজস্ব তাঁতশিল্প। সেসবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং বাইরের দেশগুলোতে তার চাহিদা একেবারে কম নয়।
তিন
কিন্তু তাঁতিদের অবস্থার পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। পারিবারিক ঐতিহ্য ছেড়ে তাদের অনেকেই ভিন্ন পেশা গ্রহণ করছে। ফলে তারা সংখ্যায় কমছে। শোষণ, বাজারের স্থিতিশীলতা না থাকা, চাকচিক্যময় বিদেশি কাপড়ের সহজলভ্যতা ইত্যাদি কারণে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সার্বিক অবস্থা খুব আশাপ্রদ নয়।
দেশীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁতশিল্পের সঠিক বিকাশে এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ছবি: সংগ্রহ