ফিচার I রসিক বীরবলের গল্প
আকবরের রাজসভা মাতিয়ে রাখতেন তিনি। তবে সেখানেই আটকে থাকেনি। তার গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়েছে লোকমুখে। লিখেছেন মনোজ দেব
এই উপমহাদেশে হাসির রাজা বলে যারা খ্যাতিমান, তাদের মধ্যে বীরবল উল্লেখযোগ্য। শোনা যায়, তিনি ছিলেন বাদশাহ আকবরের দরবারের কবি ও গায়ক। কিন্তু সেসব পরিচয়ের চেয়েও তিনি বিখ্যাত ছিলেন অসাধারণ রসবোধ আর উপস্থিত বুদ্ধির জন্য। কৌতুকের মধ্যে বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরতে পটু ছিলেন। তার এই খ্যাতি দ্রুত রাজদরবার থেকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রসিকতার জন্য তিনি ক্রমেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন।
ধারণা করা হয়, বাদশাহ আকবরের শাসনামলের শেষ দিকে তার এবং বীরবলের মধ্যকার মজার ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। সেগুলো লোকমুখে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি পুরো ভারত উপমহাদেশে তার সেসব হাস্যরসাত্মক গল্প ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসব কাহিনির মধ্যে বীরবলের তীক্ষè বুদ্ধির পরিচয় মেলে। একদিকে যেমন গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলো কিংবদন্তি হয়ে আছে রসিকতার সঙ্গে উপস্থিতি বুদ্ধির জোরে, তেমনি বীরবলের এসব কাহিনিও এই উপমহাদেশের মানুষের মনে গেঁথে আছে নির্মল আনন্দের উৎস হিসেবে।
কিন্তু কে এই বীরবল? এটি কি তার আসল নাম? নাকি তিনি কোনো ব্যক্তি নন? গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে যেমন মানুষের মনে অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে, তেমনই এই রসিক ব্যক্তি সম্পর্কেও মানুষের কৌতূহল সীমাহীন। তিনি বাঙালিকে হাসিয়েছেন ও ভাবিয়েছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তার আসল নাম মহেশ দাস ভট্ট। যদিও এই নামে তার কোনো পরিচিতি নেই। বীরবল হিসেবে প্রসিদ্ধ এই ব্যক্তি ১৫২৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কল্পি গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আবার লোকশ্রুতি আছে, তার জন্মস্থান যমুনা তীরবর্তী তিকাওয়ানপুর গ্রামে। তার বাবা গঙ্গা দাস এবং মা অনভা দেবী। অনেকের মতে, বীরবল পারিবারিকভাবে একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠেন। সাহিত্যের প্রতি তার পরিবারের সদস্যদের আগ্রহ ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন হিন্দি, সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় পারদর্শী। কবিতা ও সংগীত রচনায়ও তার কৃতিত্বের কথা শোনা যায়। ব্রজবুলি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। একসময় বীরবল মধ্যপ্রদেশের রেওয়াতে রাজপুত রাজা রামচন্দ্রের রাজসভায় সেবাকাজে নিয়োজিত ছিলেন বলে কথিত আছে।
বীরবল নামটি এসেছে ‘বীর বর’ থেকে। এর মানে সাহসী এবং মহান। কিন্তু ইতিহাস বলে, তিনি রণকৌশলে তেমন দক্ষ ছিলেন না। সম্রাট আকবর সনাতন ধর্মাবলম্বী সভাসদদের তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী নাম দিতেন। ঐতিহাসিক এস এইচ হোদিভালার মতে, নামগুলো বেতাল পঞ্চবিংশতি থেকে নেওয়া হতে পারে। কারণ, এই বইয়ে বীর বর নামক চরিত্র রয়েছে।
আকবরের রাজদরবারে সভাসদ হলেও বীরবল সুনাম অর্জন করেছিলেন মেধার জোরেই। বুদ্ধির জন্যই তাকে সমীহ করা হতো। লোকশ্রুতি আছে, বাদশাহর সঙ্গে নাটকীয় পরিচয়ের পর, ১৫৫৬ সালে তাকে রাজসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঘটনাটি এমন-
আকবরের ছিল শিকারের ঝোঁক। একবার দলবল নিয়ে তিনি শিকার থেকে ফিরছিলেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাই ক্ষুধায় অস্থির। চলতে চলতে একসময় বুঝতে পারলেন, তারা পথ হারিয়ে ফেলেছেন। যেতে যেতে শিকারি দল তিন রাস্তার মোড়ে এসে পড়ে। কোন রাস্তা দিয়ে রাজধানী আগ্রায় পৌঁছানো যাবে বোঝা মুশকিল। এমন সময় এক তরুণের দেখা পাওয়া গেল। স¤্রাট তাকে ডেকে সঠিক রাস্তার হদিস জানতে চাইলেন।
যুবক মুচকি হেসে বলল, হুজুর, সবাই জানে, রাস্তা কখনো নিজে চলাচল করে না। ফলে সে আগ্রা বা অন্য কোথাও যাবে কেমন করে। এ কথা বলে সে হেসে উঠল।
সবাই চুপ। কেউই কোনো কথা বলছে না। যুবক আবার বলে, মানুষই তো কোথাও না কোথাও যায়। রাস্তা নিজে কোথাও যায় না। তাই নয় কি?
সম্রাট ছেলেটির বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে চমৎকৃত হলেন। তার মুখে সমঝদারের হাসি ফুটে উঠল। তিনি যুবকের নাম জানতে চাইলেন, তাকে নিজের আঙুল থেকে খুলে একটি আংটি উপহার দিলেন। তারপর রাজকীয় গাম্ভীর্যে বললেন তার পরিচয়। আংটি দিয়ে তিনি ছেলেটিকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। যুবক তখন আগ্রার সঠিক পথ দেখিয়ে দিল।
এই ছেলেটিই পরবর্তীকালে সম্রাটের গুরুত্বপূর্ণ সভাসদের আসন পায়। আকবর তার নাম দেন বীরবল এবং রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। তারপর থেকে তিনি এই নামেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। প্রায় ত্রিশ বছর তিনি এই রাজসভায় কাজ করেন। তবে সেখানে বীরবল কোন দায়িত্ব পালন করতেন, তা নিয়ে আছে নানান মত। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী, কারও মতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অনেকের ধারণা, তিনি ছিলেন আকবরের পরামর্শক। পাশাপাশি শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ও সেনাবাহিনীর দেখভাল করতেন। অসাধারণ রসবোধ ও প্রখর বুদ্ধির জোরে খুব অল্প সময়েই তিনি উচ্চ পদ পেয়ে যান। যে কারণে রাজসভার অনেকেরই ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হন তিনি। সম্রাট আকবরের দরবারে গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে নয়জন ছিলেন বিশিষ্ট। তাদের বলা হতো নবরত্ন। এদের মধ্যে সবচেয়ে সপ্রতিভ ও উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন বীরবল। অন্য রত্নরা হলেন টোডর মল, মানসিংহ, ভগবান দাস প্রমুখ।
সম্রাট তার প্রাসাদ চত্বরে এই সভাসদকে একটি দ্বিতল বাড়ি উপহার দেন। আর কেউ এই সম্মান লাভ করেনি। এমনকি আকবরের প্রাসাদের সাতটি দরজার একটির নাম ছিল ‘বীরবলের দরজা’। তাকে কেন্দ্র করে যত লোকশ্রুতি রয়েছে, সব কটিতেই তিনি যে বেশ চতুর, তা প্রমাণিত। এসব গল্পে দেখা যায়, তিনি আশপাশের সবাইকে, এমনকি সসম্রাটকেও বোকা বানাচ্ছেন। কথিত আছে, বীরবল সব সময় তার বুদ্ধিমত্তা ও বাকচাতুর্যের সাহায্যে স¤্রাটের ওপর ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত প্রভাব খাটাতেন। তবে তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলেনি।
১৫৮৬ সালে আকবর তাকে এক অভিযানে ভারতের উত্তর-দক্ষিণ অঞ্চলে, অর্থাৎ এখনকার আফগানিস্তানে পাঠান। সেখানে, ইন্দু নদীর তীরে ইউসুফজাই উপজাতি মোগল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। অনেক সৈন্য মারা যাওয়ার পর সম্রাট এক সেনাদলের সঙ্গে কমান্ডার জইন খানকে সহযোগিতার জন্য পাঠান। কিন্তু এই অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহী উপজাতিদের আক্রমণে প্রায় আট হাজার সৈন্যসহ বীরবল মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। এতে সম্রাট এতটাই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, তিনি দুই দিন কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করেননি। বীরবলের মৃত্যুতে তিনি যে সম্মান দেখান, তা আর কারও জন্য করেননি।
আকবরের শাসনামলের প্রায় এক শ বছর পর এই গল্পগুলোর উদ্ভব হয়। মোগল বীরদের জীবনীকার মহাথির আক-উমরার রচনায় বীরবল সম্পর্কিত বর্ণনা রয়েছে, তার বুদ্ধিমত্তার কারণে আকবরের শাসনামলে কিছুটা সাম্যাবস্থা এসেছিল। তার কাহিনিগুলো নানা ভঙ্গিতে প্রচলিত। সেগুলোর একটি হলো আরব্য রজনী। বিশ শতকে সেসব কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটক, চলচ্চিত্র। প্রকাশ পেয়েছে নানান বই, কার্টুন, কমিকস ইত্যাদি। সালমান রুশদির উপন্যাস দ্য এনচ্যান্ট্রেস অব ফ্লোরেন্সে বীরবলের চরিত্রটি রয়েছে। এ ছাড়া তার ৫০টি চতুরতার গল্প নিয়ে দিল্লির পুস্তক মহল প্রকাশ করেছে একটি সংকলন।
ছবি: ইন্টারনেট