skip to Main Content

ফিচার I শাস্তিবৃত্তান্ত

সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন দন্ডের প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু এসব সাক্ষ্য দেয় বর্বরতার। অন্যদিকে বহু নিরপরাধ ও জ্ঞানী ব্যক্তি এ ধরনের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন। লিখেছেন কনক বিশ্বাস

সমাজ গড়ার সঙ্গে মানুষ কিছু নিয়মকানুনও তৈরি করে। সেগুলো ভঙ্গ করলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকে। প্রাচীনকালে সেসব ছিল প্রতিশোধমূলক। তা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি ভয়ানক। ধারণা করা হয়, অপরাধ দমনের জন্যই কঠোর শাস্তির প্রচলন করা হয়েছিল।
শাস্তি দুই রকমের হতে পারে। একটি হচ্ছে সংশোধনমূলক। এতে অপরাধীকে অল্প সাজা দিয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়, যাতে সে ওই অপরাধ আর না করে। আর চরিত্রেরও সংশোধন করে। আরেক রকম শাস্তি হচ্ছে প্রতিশোধমূলক। এটি অতি ভয়ংকর। এর ফলে অপরাধীর মৃত্যুও ঘটে। আবার এই সাজা দেখে অন্য লোকের অপরাধপ্রবণতাও কমে।
একসময় গুরুমশাইরা পাঠশালায় ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য নানা রকম শাস্তি দিতেন। বেত মারা, কান মলে দেওয়া, চুল বা জুলপি ধরে ঝাঁকুনি দেওয়া—এসব তো ছিলই। কিল, চড়, ঘুষি, চিমটি কাটাও এসবের মধ্যে পড়ে। এ ছাড়া হাঁটু গেড়ে বসা, কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চেয়ার হয়ে বসা, হাতের ওপর ইট নিয়ে নাড়ুগোপাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, কান ধরে ওঠবস করার চলও ছিল। এখন এসব শাস্তি উঠে গেছে।
প্রাচীনকালে দুই ধরনের শাস্তির চল ছিল। একটি হলো দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। এ জন্য মাথা মুড়িয়ে, নেড়া মাথায় ঘোল ঢেলে অপরাধীকে উল্টো গাধার পিঠে চাপিয়ে এলাকার বাইরে এমনকি দেশের সীমান্ত পার করে দেওয়ার রীতি ছিল। আর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পদ্ধতি ছিল ভয়ংকর—যেমন শূলে চড়ানো, গর্দান নেওয়া বা শিরশ্ছেদ ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল গর্ত খুঁড়ে তাতে কাঁটাওয়ালা গাছ রেখে অপরাধীকে ফেলে তার ওপর আবার কাঁটা গাছের ডালপালা দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া, অর্থাৎ জীবন্ত সমাধি। ছিল গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার প্রথা। তখন রাজাবাদশাদের একজন করে ঘাতক পুশত। সম্রাটের হুকুম হলেই সে অপরাধীকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে তার শিরশ্ছেদ করত।
অনেক সময় ঠিক করা যেত না, লোকটি অপরাধী কি না। প্রাচীন ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য নানা রকম পরীক্ষা হতো। যেমন সীতাকে সতীত্ব প্রমাণের জন্য অগ্নি-পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত ব্যক্তি না পুড়লে ধরে নেওয়া হতো সে পবিত্র।
মাটির কলসির মধ্যে একটি বিষধর সাপ রাখা হতো। তারপর তাতে একটি আংটি ফেলে দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কলসির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তুলতে বলা হতো। সে সময় তাকে সাপে না কামড়ালে ধরে নেওয়া হতো, সে নিরপরাধ।
বৈদিক যুগেও অতি ভয়ানক ও নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন ছিল। শঙ্খমুণ্ডিক দন্ড ছিল এমন একটি প্রথা। এতে প্রথমে মাথার পাশ থেকে কানের নিচ পর্যন্ত চারধারে সমান করে চামড়া কেটে ফেলা হতো। তারপর মাথার চুল একত্রে এনে ঝুঁটি বাঁধার নিয়ম ছিল। এই ঝুঁটির ভেতর দিয়ে একটি লাঠি চালিয়ে ওপর দিকে টান দেওয়া হতো। তাতে চামড়াসহ চুল উঠে আসত। তখন সেই চর্মশূন্য মাথা কাঁকরবালি দিয়ে মেজে শাঁখের মতো করার ভয়ানক শাস্তি পেতে হতো অপরাধীকে। সে যুগের এমন আরও শাস্তি হলো অন্ধদন্ডক, হত্থজ্জোতিক, জ্যোতিমালিক, খারায় তচ্ছিক, পালিখ পরিবত্তিক ইত্যাদি।
পালিখ পরিবত্তিক দন্ডে অপরাধীকে মাটিতে শুইয়ে একটা লোহার শিক তার দুই কানের মধ্য দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে তার মাথা মাটিতে পুঁতে দেওয়ার চল ছিল। তারপর দুই পা ধরে অপরাধীকে ঘোরানো হতো।
কয়েদ, শিরñেদ অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো শাস্তি প্রায় সব দেশেই ছিল। কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘোরানো, মাটি কোপানো ইত্যাদি কাজ করানো তো হতোই। কোনো কোনো দেশে তাদের দিয়ে বড় বড় পালের জাহাজে দাঁড় টানার কাজ করাত।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে আইন করে সন্দেহভাজন ডাইনিদের পুড়িয়ে মারার শাস্তি ছিল। অনেক নিরপরাধ লোককে এভাবে ডাইন বা ডাইনি মনে করে সে সময় আগুনে দগ্ধে মারা হয়েছে। ধারণা করা হতো, এসব অপরাধীর সঙ্গে শয়তানের যোগাযোগ আছে এবং তারা অশুভ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে। সে দেশে লঘু অপরাধের জন্য ছিল তুড়–ংকল। একরকম কাঠের যন্ত্র। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এর খুব প্রচলন ছিল। দুটো কাঠের মধ্যে পা গলাবার ফুটো থাকত। তাতে দুই পা আটকে অপরাধীকে রাজপথের ধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন বসিয়ে রাখা হতো। আরেক রকম কাঠের যন্ত্র ছিল—পিলরি। এতে অপরাধীর দুই হাত ও মাথা আটকে তাকে রাজপথের ধারে দাঁড় করিয়ে রাখার প্রথা ছিল। সাধারণত রাষ্ট্রের শত্রুদের এভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। কথিত আছে, সাহিত্যিক ড্যানিয়েল ডিফোকে এই সাজা দেওয়া হয়েছিল। ১৮৩৭ সালে আইন করে এসব শাস্তি বন্ধ করা হয়।
ভারতবর্ষে মোগল আমলে নাক, কান কাটা, দাড়িতে আগুন লাগানো, গর্দান নেওয়া—এসব শাস্তি ছিল। আবার লঘু অপরাধের জন্য অপরাধীদের দুজনের দাড়ি একসঙ্গে বেঁধে নাকে নস্য দেওয়া হতো। হাঁচিতে দুজনের শ্মশ্রুতে টান পড়ত আর দর্শকেরা তাদের দুর্দশা দেখে হাসত।
রোমানদের শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল ভয়ংকর। তারা অপরাধীকে সদ্য ধরে আনা সিংহের মুখে ছেড়ে দিত। তাকে বাঁচার জন্য লড়াই করতে হতো এই হিংস্র পশুর সঙ্গে। এই দৃশ্য দেখার জন্য বহু লোক জড়ো হতো। লড়াইয়ে অপরাধী জয়ী হলে সে মুক্তি পেত। অন্যদিকে ফরাসি বিপ্লবের প্রথমে রাজা লুই আর তার রানিকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। তখন অপরাধীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তাদের শিরচ্ছেদের জন্য এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে হয়েছিল। এর মধ্যে মাথা গলিয়ে দিলে ওপর থেকে ধারালো ফলা নেমে আসত। অপরাধীর গলা সঙ্গে সঙ্গে কেটে যেত। ১৭৮৯ সালে ফরাসি চিকিৎসক জোসেফ ইগনেস গিলোটিন [১৭৩৮-১৮১৪] এই যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এর ধারালো ফলাটি তিন কোণা। দড়ি ধরে টানলে ফলাটা নেমে এসে মুহূর্তে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলত।
প্রাণদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ক্ষুদিরামকে এভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এমন অনেককে তখন প্রাণ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া তখন শাস্তি ছিল দ্বীপান্তরে পাঠানো। স্বদেশি আন্দোলনের বহু কর্মীকে সে সময় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল আন্দামান দ্বীপে।
ইউরোপে শাস্তি দেওয়া হয়েছে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করে। অসংখ্য ইহুদি হিটলারের আমলে এভাবে প্রাণ দিয়েছে। এতে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত লোকদের জানালা-দরজা বন্ধ একটি ঘরে ঢুকিয়ে তাতে নাইট্রোজেন গ্যাস ছেড়ে দেওয়া হতো। এতে তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেত। ছিল বৈদ্যুতিক চেয়ার। অপরাধীকে এতে বসিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ ছেড়ে তখনি তার মৃত্যু ঘটানো হতো। এখন অবশ্য এ ধরনের প্রাণদন্ড মানবতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে সেসবের দৃষ্টান্ত দেখা যায় না।
তবে অপরাধ না করেও মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে কঠিন শাস্তি। এমনকি মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। ক্রুশ কাঠে পেরেক ঠুকে যিশুর প্রাণ নেওয়া হয়। সক্রেটিসকে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছিল হেমলক বিষপানে। ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী জোয়ান অব আর্ককে ডাইনি সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে কেটে টুকরা টুকরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অগ্নিদগ্ধ করে গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে মারা হয়। সাধু সেবাস্টিয়ানকে গাছের সঙ্গে বেঁধে তীর মেরে হত্যা করা হয়েছিল। এরা কেউই অপরাধী ছিলেন না। রাষ্ট্র এবং সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মে তাদের অনৈতিক শাস্তি পেতে হয়েছিল।
ছবি:ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top