ফিচার I জাতভাই
চা-বাগানের বাইরে অনেক উদ্ভিজ্জ উপাদান দিয়ে তৈরি হয় এই পানীয়। মূলত পথ্য হিসেবে এগুলোর প্রচলন
চা নামের পানীয়টি এখন চা-পাতায় সীমাবদ্ধ নেই। চা-গাছের পাতা (Camellia sinensis) ছাড়াও আরও অনেক গাছের কন্দ, ছালবীজ এবং কিছু ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে গরম পানিতে গুলে পান করা হচ্ছে। সেগুলোও পরিচিতি পাচ্ছে চা হিসেবেই। তবে ব্যপারটি নতুন নয়। এমনকি চা-গাছের আগেও সেগুলোর উপস্থিতি ছিল। একসময় তৃণ-গুল্মের নির্যাস মূলত ঔষধি হিসেবে পান করা হতো। আজকাল তা চায়ের সমার্থক হয়ে উঠেছে। ৪ হাজার ৮০০ বছর আগে চৈনিক স¤্রাট শেনং তার শাসনকালে অভিজ্ঞদের নিয়ে ৩৬৫ ধরনের ঔষধি গাছ ও গুল্ম খুঁজে বের করেছিলেন। বেশ কটির নির্যাসও পান করা হতো। এখনো চীনের জনপ্রিয় কিছু চায়ের মধ্যে রয়েছে চেরি গ্রেইন চা, জাওগুনা চা ও ডিটক্স গোয়াভা চা। পেট পরিষ্কারক হিসেবে তারা পেয়ারা পাতার চা-ও পান করে। তা ছাড়া টুও চা-ও জনপ্রিয় সে দেশে।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে এক গ্রিক চিকিৎসক ‘ডি মাটেরিয়ামেডিকা’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। তাতে ঔষধি গাছ ও গুল্মের নির্যাসযুক্ত পানীয়ের বর্ণনা মেলে। আছে অক্সালিস চায়ের উল্লেখ। এই উদ্ভিদ মূলত তিন-চারটি পাতাবিশিষ্ট। পাতাগুলো প্রজাপতির ডানার মতো দেখতে। তাই এর থেকে পাওয়া চা-কে প্রজাপতি চা বলে। উৎপত্তি আমেরিকায় হলে সারা বিশ্বে ৮৫০ প্রজাতির অক্সালিস রয়েছে। তবে সব কটি থেকেই চা হয় না। কেবল হলদে ফুলের বিশেষ প্রজাতিটি থেকেই বানানো হয় এটি। গরম পানিতে এক চা-চামচ অক্সালিসের পাতা ফুল ও বীজ ফুটিয়ে নিলেই তৈরি হয় এ চা।
২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বানাচ্ছে পাটের চা। গরম পানিতে মধ্যে এই চা-পাতা ঢেলে দিলেই চা তৈরি। অথবা কাপে গরম পানি নিয়ে তাতে এক চামচের তিন ভাগের এক ভাগ পাটের চা নিয়ে ২-৩ মিনিট রেখে দিলেই হয়ে যাবে। ফুল দিয়েও এমনটি হয়। তবে তা স্বাস্থের জন্য নিরাপদ হওয়া চাই। হাতে গোনা কয়েকটি ফুলের চা সুস্বাদু। যেমন জুঁই, চন্দ্রমল্লিকা, জবা, গোলাপ, অপরাজিতা, গাঁদা ইত্যাদি। এসবের পাপড়ি সংগ্রহ করে চা তৈরি করা যেতে পারে। তা ছাড়া অনলাইন কিংবা সুপারশপেও ফুলের শুকনা পাপড়ি মেলে। বাড়িতেও ফুল শুকিয়ে চা তৈরি করা যায়। এসব চায়ে সুগন্ধি যুক্তও হয়। যেমন জুঁই চা। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে চীনাদের মধ্যে এর চল ছিল। বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়ে সতেরো শতকের দিকে। উত্তর চীনের বাসিন্দারা অতিথি আপ্যায়ন করে জুঁই ফুলের চা দিয়ে। এটি প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি। ফলে বাড়তি চিনি যোগ করতে হয় না। পান করা যায় গোলাপ চা-ও। এর পাপড়ি শুকিয়ে কিংবা তাজা অবস্থাতেই চা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পাত্রে পানি ও গোলাপের পাপড়ি দিয়ে অল্প আঁচে ফোটাতে হয় প্রায় পাঁচ মিনিট। এরপর জ্বাল নিভিয়ে আদা ও দারুচিনি গুঁড়া মেশালে ভালো হয়। কেউ কেউ এলাচি গুঁড়াও দেন। তারপর মিশ্রণটি এক মিনিট ঢেকে রাখলে হয়ে যায় পান উপযোগী গোলাপ চা।
নীল চা নামে পরিচিত অপরাজিতা চা। গরম পানিতে এ ফুলের শুকনা পাপড়ি ফুটিয়ে নিলে ধীরে ধীরে চা নীল রং ধারণ করে। তারপর কয়েকটি পুদিনাপাতা যোগ করে চুলা থেকে নামাতে হয়। মধু দিয়ে এই চা পান করলে বেশ স্বাস্থ্যোপকারিতা মেলে।
তা ছাড়া বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে নিম-চা পান করা হয়। নিমের পাতা সেদ্ধ করে এই পানীয় তৈরি হয়। পুদিনাপাতা দিয়েও চা হয়। পেটে সমস্যা হলে এ পাতার চা পানে উপকার পাওয়া যায়। আছে রসুনের চা-ও। যদিও তা সুস্বাদু নয়। তবে মেক্সিকো ও স্পেনে সর্দি-জ্বরের পথ্য হিসেবে এই চায়ের চল আছে। চীনের লোকেরা চন্দ্রমল্লিকার চা পান করে ঠান্ডাজনিত রোগের পথ্য হিসেবে। মৌরি বীজের চা খেলে অ্যাসিডিটি কমে। আমাদের দেশে জ্বর ও কাশির সমস্যায় তুলসী চা পান করা হয়। এমনকি ধনেপাতার চা-ও রয়েছে। এটি ডেটক্সিফাইয়ার হিসেবে পরিচিত, যা হজমে সহায়তা করে। বিশ্বজুড়ে ক্যামোমাইল চায়েরও বেশ কদর। ক্যামোমাইল পাতা দিয়ে তৈরি হয় এটি। এমনকি শুধু আদা দিয়েই চা হয়। যদিও আমাদের দেশে লিকারের সঙ্গে আদার কুচি দেওয়া হয়। রোজমেরির পাতা, ড্যান্ডেলিয়ন শিকড় এমনকি ডামিয়ানা গাছের পাতা ও ফুল থেকে হয় চা। এসব ছাড়াও লেমন বার্গামট, ল্যাভেন্ডার, ক্যামেলিয়া ইত্যাদি ফুল দিয়েও সুস্বাদু পানীয় হয়।
চা যেমন উপকারী, তেমনি এর কিছু ক্ষতির দিকও রয়েছে। তরল হওয়ায় এটি শরীরের ওপর দ্রুত প্রভাব ফেলতে পারে। তাই যেকোনো প্রকার চা পানের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। তা ছাড়া মন চাইলেই যেকোনো ফুল, লতা, বাকল জ্বাল দিয়ে চা-বানিয়ে পান করা অনুচিত নয়। তবে অনেক কোম্পানিই এখন অর্গানিক চা তৈরি করে। সেগুলো মূলত চা-পাতার সঙ্গে বিভিন্ন ভেষজ যুক্ত করে তৈরি করা। উল্লিখিত চাগুলোর সঙ্গে চা-পাতা যুক্ত না করলেও চলে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ