ফিচার I আদি খাবারে বারণ
সনাতন শাস্ত্র কিছু কিছু খাদ্যে সম্মতি দেয় না। তবে তা সর্বজনীন নয়। বিভিন্ন ভাগের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে বৈচিত্র্য
মোটামুটি সব ধর্মেই কোনো না কোনো খাদ্য গ্রহণে বিধিনিষেধ আছে। হোক তা সেমিটিক কিংবা নন-সেমিটিক। তবে একেবারেই যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়। একই ধর্মের বিভিন্ন ভাগে খাদ্যের বৈধতার পার্থক্য আছে। খাদ্যভেদে বিধিনিষেধ মেলে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে। আছে সনাতন ধর্মেও। আপস্তম্ব ধর্মসূত্র, বৌধায়ন ধর্মসূত্র, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র, লৌগাক্ষিগৃহ্ম সূত্রাণি, গৌতম ধর্মসূত্র, মার্কন্ডেয় পুরাণ, বিষ্ণু স্মৃতি, মনু স্মৃতি, মহানির্বাণ তন্ত্র, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ইত্যাদিতে খাবারের বিধিনিষেধ বিষয়ে তথ্যাদি পাওয়া যায়। তবে এসব বিধিনিষেধ সব সনাতন ধর্মাবলম্বীর জন্য না-ও হতে পারে।
উল্লিখিত শাস্ত্র অনুসারে যেসব খাদ্যের ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে, সেগুলো নিয়েই এই নিবন্ধের আলাপ। যেমন সনাতন ধর্মে কিছু কিছু শ্রেণির মানুষের জন্য উট ও ভেড়ার দুধপান নিষেধ। এমনকি এক খুরবিশিষ্ট প্রাণীর দুধপানেও বারণ আছে। যেমন ঘোড়া। বিশেষ ক্ষেত্রে গরু, মহিষ ও ছাগলের ক্ষেত্রেও নিষেধ করা হয়েছে; বাচ্চা প্রসবের পরের ১০ দিন এসব প্রাণীর দুধপান করা মানুষের জন্য বারণ। কুকুর, বিড়াল, বাঘ, সিংহ ও শৃগালের দুধ পানও নিষেধ আছে শাস্ত্রে। কিছু প্রাণীর মাংস খাওয়ায় সনাতন ধর্মের কারও কারও জন্য মানা। যেমন সাপ, কুমির, ঘড়িয়াল, শুশুক, সাপের মতো মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদি। ইল, কুঁচে, হাঙর, তিমি খেতেও বাধা আছে। বারণ আছে জলজ শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি ভক্ষণে।
পাখি খাওয়ার ক্ষেত্রেও শাস্ত্রে কিছু বিধিনিষেধ আছে। মাটিতে আঁচড় কেটে যেসব পাখি খাবার খোঁজে, সেগুলোর মাংস খেতে বারণ করা হয়েছে কিছু শাস্ত্রে। এমনকি রাজহাঁস, সারস, পানকৌড়ি, বক, কাক, পায়রা, টিয়া, ঘুঘু, তিতির, বাজ, চিল, শকুন, বাদুড়, ময়ুর, স্টার্লিং, দোয়েল, চডুই, কাঠঠোকরা, মাছরাঙা খেতেও বাধা মেলে। নিশাচর পাখির মাংস খেতেও নিষেধ রয়েছে কয়েকটিতে। মাংসাশী পাখির মাংস খেতেও মানা।
অল্প বয়স্ক পশু এবং যেগুলোর দুধ দাঁত ভাঙেনি সেসবের মাংস খেতে নিষেধ করা হয়েছে। এক চোয়ালে দাঁত আছে, তেমন পশু খাওয়াও বারণ। বাঁকা পা-বিশিষ্ট প্রাণীর মাংস খেতেও বাধা রয়েছে। এসব প্রাণীর মধ্যে রয়েছে শজারু, খরগোশ, কচ্ছপ, গুইসাপ ইত্যাদি। নরমাংস এবং প্রায় মানুষের মতো দেখতে যেসব প্রাণী রয়েছে, সেগুলো খেতেও বারণ রয়েছে।
যেসব শূকর গ্রামে পালন করা হয়, সেগুলো খেতে মানা করা হয়েছে। কেননা, সেসব প্রাণী খুব নোংরা স্থানে পালন করা হয়। এরা কাদায় মাখামাখি হয়ে থাকে। ফলে এদের গায়ে পরজীবী বাসা বাঁধে। এমনকি এদের মাংসেও সিস্ট থাকতে পারে। ফলে প্রাচীনকালে এ প্রাণীর মাংস খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে গৃহপালিত শূকর খেতে নিষেধ নেই।
মানুষের উপকারে আসে এমন গবাদির মাংস খেতেও নিষেধ করে কিছু কিছু শাস্ত্র। তা ছাড়া বনগরু, ষাঁড় ইত্যাদির মাংস খাওয়া বারণ। মাংসাশী পাখির মতোই মাংসাশী প্রাণীর মাংস খাওয়া নিষেধ। যেমন বাঘ, সিংহ, শিয়াল, বন্য কুকুর ইত্যাদি। তা ছাড়া বিড়াল, বানর ও মহিষের মাংস খেতেও নিষেধ করা হয়েছে কয়েকটি শাস্ত্রে। নিরামিষের মধ্যে ব্যাঙের ছাতা ও শালগম খাওয়ার নিষেধের কথা মেলে। পচা খাবার এবং যে খাবারে কোনো পশু মুখ দিয়েছে, তেমন কিছু খাওয়াও বারণ। যেসব খাবারে পোকা জন্মেছে, সেগুলোতেও মানা রয়েছে।
পেঁয়াজ-রসুন নিয়েও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে তা বিতর্কিত। আপস্তম্ব ধর্মসূত্র, মনু স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র মতে, পেঁয়াজ ও রসুন খেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু বৈদিক আয়ুর্বেদশাস্ত্রে চিকিৎসার কাজে পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার হয়েছে বলে জানা যায়। বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুসারী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ‘চতুর্মাসে’ পেঁয়াজ ও রসুন খায় না। এমনকি কিছু কিছু সনাতন ধার্মিক এ সময় বেগুনও ভক্ষণ করে না। পুষ্টিমার্গী সম্প্রদায়ের অনুসারীদের কেউ কেউ পেঁয়াজ, মাশরুম ও রসুন খান না।
প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণেরাও পেঁয়াজ ও রসুন খেতেন না। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় আছে, রজঃ বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভূত কামই মানুষকে পাপে প্রবৃত্ত করে। তা থেকেই লোভের উৎপত্তি। তা ছাড়া তমঃ বৈশিষ্ট্য থেকে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ তৈরি হয়। ফলে রজঃ ও তমঃর প্রভাবে পাপে প্রবৃত্ত না হওয়ার উদ্দেশ্যে শাস্ত্র অনুসারীরা পেঁয়াজ-রসুন পরিত্যাগ করত। মনুসংহিতায়ও মনু মানবজাতিকে পেঁয়াজ-রসুন খেতে বারণ করেছেন। তার মতে, এগুলো খেলে কৃচ্ছ্রসাধন করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। মানে, এক রাত পূর্ণ উপবাস করা লাগে।
মাছ খেতেও বিধিনিষেধ ছিল। আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি বাঙালির মাছের প্রতি ভালোবাসাকে সুনজরে দেখেনি। এই অঞ্চলের ব্রাহ্মণেরা প্রাণীটি খেত না বলে জানা যায়। তাদের জন্য সব ধরনের মাছ খাওয়ার অনুমোদন ছিল না। যেসব মাছ কাদার গর্তে বাস করে, যেগুলোর মুখ দেখতে সাপের মতো এবং যেটির আঁশ নেই, সেগুলো খাওয়া বারণ ছিল। পচা ও শুকনা মাছও নিষিদ্ধ ছিল তাদের জন্য।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট