skip to Main Content

ফিচার I কালো শুক্রবারের ভালো জাদু

কল্পনার চেয়েও বেশি সস্তায় পছন্দের পণ্য কেনার ধুম পড়ে যায় ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে। নভেম্বরের শেষ শুক্রবার দিনটি চিহ্নিত হলেও এর রেশ রয়ে যায় আরও বেশ কিছুদিন। এদিনের কথা লিখেছেন আশিক মুস্তাফা

ব্ল্যাক ফ্রাইডের আক্ষরিক অনুবাদটা বেশ মজার—‘কালো শুক্রবার’! এই কালো মানে অশুভ থাবা নয়; বলা যায়, পায়রা ওড়ানো দিন। কেনাকাটার পায়রা ওড়ে এই দিনে। বিশেষ এই দিনটির ডানা ঝাপটানি শোনা যায় নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থেকেই।
বসন্তের কোকিলের মতো ফ্যাশনে ভর করে দুনিয়া দাবড়ে বেড়ানো তরুণেরা এই ডানা ঝাপটানি শুনেই নড়েচড়ে বসেন। তাদের মনে লাগে উচ্ছ্বাসের হাওয়া। সেই হাওয়া তাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে শপিং মলে। তারা ঘড়ির কাঁটার কাছে নিজেদের চোখ বন্ধক দিয়ে রাখেন। তিন কাঁটা রাত বারোটার ঘরে এলেই শুরু হয় তোড়জোড়! বয়সে নুয়ে পড়া ফ্যাশনেবল মানুষগুলোর শরীরেও যেন নতুন পাতা গজায় এ সময়ে। তাই তারাও কম যান না! তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাগ বসান ব্ল্যাক ফ্রাইডের ডানায়!
যেভাবে এলো
বলা হয়ে থাকে, তরুণেরা যেদিকে যান, সমকালও যেন হেলে পড়ে সেদিকে। তাই বাদ পড়েন না কেউ। সাধারণ মানুষ থেকে প্রাসাদে বসবাসকারীরাও এই দিনের প্রতীক্ষায় প্রহর গোনেন। অপেক্ষায় থাকেন ব্যবসায়ীরাও। কেন এই প্রতীক্ষা? কবে এবং কী করে এলো এই মন ভালো করা কালো দিন?
সে অনেক আগের কথা! ১৮৬৯ সাল। আমেরিকায় তখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা। সেই মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি বিশেষ দিবসের কথা ভাবছিলেন ব্যবসায়ীরা। ভাবতে ভাবতে তারা ঠিক করলেন, ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশেষ ছাড়ে পণ্য বিক্রি করবেন। তা-ই করলেন এবং সেই ছাড়ে তারা ভয়াবহ লোকসানে পড়লেন। হিতে বিপরীত হওয়া সেই দিন ছিল শুক্রবার। তাই দিনটি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামে পরিচিতি পায়।
ইতিহাসে চোখ রাখলে আরও দেখা যায়, ১৯৫০ সাল থেকে ফিলাডেলফিয়া রাজ্য পুলিশ থ্যাংকস গিভিং ডের পরের দিনকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে ডাকে। কারণ, এই দিনে আমেরিকায় বছরের সবচেয়ে বড় লেনদেন এবং বছরের সবচেয়ে আলোচিত ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হতো। ফলে ফিলাডেলফিয়ার শহরের রাস্তায় নেমে আসত মিরপুর-ফার্মগেটের জ্যাম! এই জ্যাম সামলাতে হিমশিম অবস্থা হতো স্থানীয় পুলিশের। তাদের জন্য এমন বাজে দিন আর ছিল না তখন। তাই পুলিশই দিনটির নাম দিয়েছিল ব্ল্যাক ফ্রাইডে।
আমেরিকা থেকে চোখ তুলে অন্য দেশে তাকালে দেখা যায়, এই দিনে ঘটে গেছে রাজ্যের ঘটনা। যেমন ধরুন, ১৯৭৮ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানের ময়দানে জালেহে বিক্ষোভকারীরা গণহত্যার শিকার হন। ১৮৮১ সালে হারিকেনের আঘাতে স্কটল্যান্ডের আইমাইথে প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারান। ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে নারীর ভোটাধিকারকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। ১৯১৬ সালে লেইক এরিতে প্রচন্ড ঝড়ে চারটি জাহাজ ডুবে যায়। ১৯৮৭ সালে কানাডায় ভয়াবহ টর্নেডো আঘাত হানে। ১৯৯৩ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলা হয়। ২০১৫ সালে ফ্রান্স, কুয়েত, সোমালিয়া, সিরিয়া ও তিউনিসিয়ায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। দুনিয়াজুড়ে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে এই কালো দিনে। যদিও এসব কাকতালীয়। তবু এগুলো কালো কালিতে লেখা আছে এই কালো দিনের ডায়েরিতে।
অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ
ব্ল্যাক ফ্রাইডে শুরু হয় মধ্যরাত থেকে। ক্রেতার লাইনও শুরু মধ্যরাতে। অন্ধকারে শপিং মলের গেট খোলা হয় আর দিনের আলো ফোটার আগেই ক্রেতা হুড়মুড়িয়ে সব কিনে দোকান খালি করে দেন; তাই এর নাম ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল। ব্ল্যাক ফ্রাইডের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশে চোখ বোলালে দেখা যায়, যেসব বিক্রেতার বিক্রি-বাট্টা কমতে কমতে হিসাবের খাতায় লাল দাগ নেমে আসে, এই দিন বিক্রির পর তা কালো কালির আঁচড়ে আসে ফিরে। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বলছে, এক ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে যে পরিমাণ বেচাকেনা হয়, তাতে এই এক দিনেই আমেরিকার অর্থনীতির সূচক এক লাফে চূড়ায় উঠে যায়!
নেই কাঁটাতার
আমেরিকা থেকে ধীরে ধীরে ব্ল্যাক ফ্রাইডে ছড়িয়ে পড়ে কানাডা, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো, রোমানিয়া, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়। কয়েক বছর আগেও শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর সেল থাকত এই বিশেষ দিনে। কিন্তু বর্তমানে দেশের কাঁটাতার ছিঁড়ে দিয়েছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও এই কালো দিনের আলোমাখা ভোর দেখতে পান। বিশেষ ছাড়ে কিনতে পারেন পছন্দের পণ্য। ব্ল্যাক ফ্রাইডে ধারণা দোকানভিত্তিক হলেও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন তা ভার্চ্যুয়াল দোকানেও চলে এসেছে। আর করোনা মানুষকে শিখিয়েছে অনলাইন কেনাকাটার মানবিক ও আয়েশি গুরুত্ব! তাই তো অনলাইনে তোড়জোড় এখন ব্ল্যাক ফ্রাইডের। অনলাইন কেনাবেচায় ব্ল্যাক ফ্রাইডের নেতৃত্ব দিচ্ছে দুই ই-কমার্স জায়ান্ট—আমাজন ও আলিবাবা।
আসে সুদিন!
২০০৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে দিনটি বছরের ব্যস্ততম শপিংয়ের দিন হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাংকস গিভিং ডে হিসেবে পালিত হয়। এর পরের দিন, মানে প্রতি নভেম্বরের শেষ শুক্রবার ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে পরিচিত। এই ব্ল্যাক ফ্রাইডের সঙ্গে এখন আমাদের ফ্যাশনেবল তরুণেরা পরিচিত; সেই সঙ্গে বড়রাও। এই দিনে ব্যবসায়ীরা পণ্যে ৭০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেন। ন্যূনতম এক ভাগ হলেও ছাড় দেওয়া হয়।
মূলত ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উপলক্ষে কেনাকাটা শুরু হয়। কেউ কেউ মনে করেন, বড়দিন উপলক্ষেই এই ছাড় দেওয়া হয়। তবে ইতিহাস তা বলে না। আর বললেই-বা কী! লাভের আশায় লোহার বোঝা না টেনে একটা ব্ল্যাক ফ্রাইডে কাজে লাগাতে পারলেই কেল্লা ফতে! ইতিমধ্যে যে সেই সুযোগ অনেকেই নিয়ে ফেলেছেন, সে কথা আর বলতে!

ছবি : ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top