skip to Main Content

ফিচার I শৈত্য সুবাস

আর্দ্রতাকে রঙিন করে তোলে শীতের ফুল। প্রকৃতির মলিনতা হটিয়ে মানুষের মনে সৌন্দর্যের পিপাসা মেটায়। ফুলপ্রেমীদের কাছে শীত এক বিশেষ মোহ নিয়ে হাজির হয়

শীতে প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে ওঠে। এই দুর্নাম কাটাতেই হয়তো এ ঋতুতে এমন সব ফুল ফোটে, যা প্রকৃতিকে শোভিত করে। পাপড়ির রঙের বৈচিত্র্য দিয়ে সাজিয়ে তোলে শীতে মুষড়ে পড়া ধরণীকে। দেশ-বিদেশে শীতের ফুলগুলো আলাদা। তবে কৃষির উৎকর্ষে সীমানা এখন আর সৌন্দর্যের বাধা হতে পারে না। এক দেশের ফুল অন্য দেশে হরহামেশাই চাষ হয়, ফোটে। যেমন ডালিয়া। আদি নিবাস মেক্সিকোতে হলেও সেটি স্বদেশ ছেড়ে শিকড় গেড়েছে ভিনদেশেও। আমাদের উপমহাদেশে এই পুষ্পের আগমন ১৮৫৭-৬০ সালের দিকে। লাল, হলুদ, সাদা, বেগুনি, গোলাপি—নানান বর্ণের ডালিয়া শীতের কুয়াশার সঙ্গে সখ্য গড়ে দারুণ এক আবহ তৈরি করে।
মেক্সিকো থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া শীতের আরেকটি ফুল কসমস। সাদা, গোলাপি, হলুদ, কমলা, বেগুনি ইত্যাদি রঙে মেলে আট পাপড়ির এই ফুল। ছেঁড়ার পর অন্যান্য পুষ্পের চেয়ে এটি তুলনামূলক বেশিক্ষণ টেকে। ফলে ফুলপ্রেমীদের কাছে এর কদর একটু বেশিই। সদ্য ফোটা ফুলে সামান্য সুগন্ধ থাকে।
বাংলাদেশে বহুল পরিচিত শীতের ফুল গাঁদা। জাতে ভিন্নতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন বাগানে কিংবা শৌখিন মানুষদের বারান্দা ও ছাদে এটি সৌন্দর্য ছড়ায়। সাধারণত হলুদ ও কমলা রঙের হয়। দেশে বিয়েশাদিসহ বিভিন্ন পূজা-পার্বণে গাঁদার কদর অনেক। সারা বছরই এর চাহিদা থাকে। ফলে এটি শীতের ফুল হলেও গরম ও বর্ষায় ফোটানোর প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। তবে এই ফুলও মেক্সিকান মাটির দান। সে দেশ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এমন আরেকটি ফুলের নাম জিনিয়া। শীতকালেই ফোটে। তবে অন্য ঋতুতে ফোটানোর প্রযুক্তিও বেরিয়েছে। মৌসুমি ফুলগুলোর মধ্যে এটি ফুলপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। সাদা, কমলা, হলুদ, লাল, বাদামি, সবুজ, বেগুনি রঙে প্রায় ২০টি প্রজাতি আছে জিনিয়ার। গাছে থাকলে অনেক দিন পর্যন্ত নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারে। অন্যদিকে, ফ্লক্স ফুলও নিউ মেক্সিকোর। শীতে ফোটে। সড়কসজ্জায় সেটির ব্যবহার বেশি। সাদা, লাল, গোলাপি ও বেগুনি ছাড়াও আরও নানান রঙে সৌন্দর্য ছড়ার ফ্লক্স।
হালকা শীতে বাংলাদেশে মেলে চন্দ্রমল্লিকা। এশিয়ান ফুল। অনেকের মতে চৈনিক। ফুলদানিতে খাড়াভাবে সাজিয়ে রাখার জন্য লম্বা ডাঁটাসহ ফুলটি তোলা হয়। আমাদের দেশে এর তিনটি প্রজাতি মেলে: তিন রঙা চন্দ্রমল্লিকা, মালীর চন্দ্রমল্লিকা ও তোরা চন্দ্রমল্লিকা। সাধারণত সাদা, নীল হলুদ, বেগুনি, লাল প্রভৃতি বর্ণের হয়। শীতকালে অন্দরসজ্জায় চমৎকার আবহ আনতে পারে ন্যাস্টারশিয়াম। দেয়ালে কিংবা গ্রিলে ঝুলে থাকে টকটকে লাল ফুলগুলো। দেখে মনে হয় যেন কনকনে শীতে ঘরের দেয়ালে আগুন জ্বলে আছে!
একটা সময় ইংল্যান্ডে সুগন্ধি সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হতো শীতের ফুল ক্যালেন্ডুলা। এটিকে অনেকে জিনিয়া ভেবে ভুল করেন। এই পুষ্পের উৎপত্তি ইউরোপেই। তবে সেই আবহাওয়া ছেড়ে এখন অন্য জায়গার আবহাওয়াতেও ফুলটি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। গাঢ় কমলা, হলুদ কিংবা লাল—শীতে ক্যালেন্ডুলার রূপ বেশ দৃষ্টিসুখের।
শীতের ফুল কারনেশনের বাংলা আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায়—স্বর্গীয় ফুল। নামেই এর রূপের স্বরূপ আঁচ করা যায়। শীতপ্রধান দেশের প্রকৃতিতে এটি কল্পিত স্বর্গের উদ্যানের মতো শোভা নিয়েই ফোটে। খ্রিস্টের জন্মের পর কারনেশন ফুটত ফ্রান্সে। সুগন্ধি তৈরির উদ্দেশ্যে ৬০০-৭০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা আরবে চাষ হতে থাকে। এই ফুলে লবঙ্গের মতো সুবাস রয়েছে। শীতে শিশিরাবৃত প্রকৃতিতে এই সুগন্ধ এক প্রকার ভিন্ন আমেজ তৈরি করে। সাধারণত হলুদ, গোলাপি, লাল ও সাদা হয় ফুলগুলো। রং ও রূপের জন্য গোলাপের পরেই কারনেশনের মর্যাদা।
১৭৯১ সালে জার্মান উদ্ভিদবিদ যোসেফ গার্টনার একটি বই লিখেছিলেন। নাম De Fructibus et Seminibus Plantarum। সেটির দ্বিতীয় খন্ডে আফ্রিকান এক প্রকার ফুলের হদিস মেলে। পুষ্পটির নাম গাজানিয়া। শীতের ফুল। সকালের রোদে ফোটে; বিকেলে স্তিমিত হয়। তবে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সারা বছর এর দেখা মেলে। এই ঋতুর আরেকটি ফুল ডেইজি। নানান দেশের মানুষ পুষ্পটির সঙ্গে ধৈর্য, সরলতা, পবিত্রতা ও নিষ্পাপ গুণের মিশেল ঘটিয়েছে। ফুলটির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। ধারণা করা হয়, চার হাজার বছর আগের পুষ্প এটি। ক্রিট দ্বীপবাসী এটিকে চুলের কাঁটা হিসেবে ব্যবহার করতেন। মিসরে প্রাচীনকালে এই ফুল দিয়ে বাসন সাজানো হতো।
শীতের ফুল হিসেবে প্যানজিও খুব জনপ্রিয়। বলা হয়, এটিই শীতের সবচেয়ে সুন্দর ফুল; যদিও সৌন্দর্য একটি আপেক্ষিক বিষয়। পাতাগুলো কিছুটা ভারী। ফুলের গঠনটিই এর রূপের প্রধান উদ্দীপক। ওপরের দিকে দুটি এবং নিচে তিনটি পাপড়ি থাকে। পাপড়িগুলো গড়নেও ভিন্ন। রঙের মিশ্রণেও ফারাক আছে। ফুলপ্রেমীদের কাছে এই ফুল এতই পছন্দের যে স্থানভেদে এটি চার শতাধিক নামে পরিচিত!
টকটকে লাল ফুল সিলভিয়া। শীতে ফোটে। মঞ্জরিতে ফুলগুলো নিচ থেকে ফুটতে ফুটতে ওপরের দিকে ওঠে। বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে তা চাষ করেন শৌখিন মানুষ। উজ্জ্বল রঙের কারণে দূর থেকেই এটি লোকের নজর কাড়ে।
ক্রিসমাস গিফটের জন্য শীতকালীন বিশেষ ফুল অ্যাজালিয়া। ধারণা করা হয়, এর আদি নিবাস চীন, তিব্বত কিংবা জাপান। সাদা, কমলা, গোলাপি ও লাল রঙের হয়। গুচ্ছভাবে ফোটায় ফুলদানিতে বেশ মানায়। আমাদের দেশে শীতের ফুল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দক্ষিণ আমেরিকার ফুল ভারবেনা। নীল, সাদা, লাল, বেগুনি ও গোলাপি রঙে মেলে পুষ্পটি। এর পাতাও বেশ নয়নাভিরাম। শীতের ফুল সূর্যমুখীকেও আমাদের দেশের শৌখিন মানুষেরা বেশ কদর করেন। এই ঋতুতে সূর্যমুখী বাগানে গিয়ে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। শীতাবৃত মাঠে শত শত সূর্যমুখী দেখে মনে হয়, যেন অসংখ্য সূর্য মাটিতে নেমে এসেছে। কৃষ্ণকলি ও দশবাইচন্ডীকে বাংলাদেশের নিজেদের শীতকালীন ফুল বলা হয়। কৃষ্ণকলি ফুলটি সাদা ও গোলাপি। দশবাইচন্ডী ফুল সাধারণত নীল। ছোট গাছে এ ফুল ফোটে। অনেকটা প্রজাপতির মতো দেখতে। এটি হলুদ ও গোলাপিও হতে পারে।
বিশ্বে আরও অনেক প্রজাতির ফুল রয়েছে, যা বিভিন্ন দেশে শুধু শীতেই ফোটে। যদিও ব্যাপক চাহিদার কারণে সেগুলোতে প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সারা বছর ফোটানোর ব্যবস্থা করা হয়।

 লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top